নীরবে ভালোবাসি পর্ব - ২৩

 love silently part 23

আগের পর্ব পড়ুন 

নীরবে ভালোবাসি পর্ব - ২৩


বাইক চালাতে চালাতে অভি জিজ্ঞাসা করলো , কি আমার সাথে যেতে ভয় করছে ম্যাডাম? 

শ্রী দুরু দুরু বুকে সাহস সঞ্চয় করে বললো, রাস্তায় কেউ দেখে ফেললে যদি বাড়িতে বলে দেয়, তাই ভয় করছে। তোমার  কি বলার আছে এখনই বলো । আমি বাড়ি যাবো। আমার ভয় করছে খুব। 

- শ্রী লতা এত ভয় পেলে কি করে চলবে। আচ্ছা, দাঁড়াও ওই বড়ো পুকুরটার সামনে দাঁড়াই।

বড়ো পুকুরটার সামনে থাকা বিশাল  কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অনেক ছেলে- মেয়ে রাই জোড়ায় জোড়ায় এসে গল্প করে। স্কুল আসা যাওয়ার পথে এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। আজ এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে শ্রী ও তার মনের মানুষটার সাথে দাঁড়াবে। কথা বলবে। শ্রী এর এইসব ভেবেই মনে রোমাঞ্চকর উন্মাদনা র সৃষ্টি হলো।

- কি হলো নামবে তো বাইক থেকে? 

শ্রী একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল তাই নিজের ব্যবহারে নিজেই এখন লজ্জিত বোধ করলো। বাইক থেকে নেমে মাথা নিচু করে অভির সামনে এসে দাড়ালো।

- তারপর বলো কেমন আছো? 

অভির এইরকম সিধেসাধা কথায় শ্রী একটু অস্বস্তি বোধ করলো। মনে মনে ভাবলো এ আবার কেমন ছেলে রে বাবা! ক্যাজুয়ালী তাকে জিজ্ঞাসা করছে কেমন আছো? নিজেই তো সকাল বেলা বলেছিল কি সব কথা বলার আছে। আর এখন এখানে এসে এমন ভাব করছে যেন মনে হচ্ছে ওরা যেন একে অপরের অনেক দিনের পরিচিত। তবুও শ্রী মৃদু গলায় বলল, ভালো। সকাল বেলায় কি বলবে বলছিলে ? 

ঠোঁট চেপে একটু মুচকি হেসে স্ট্যান্ড করা বাইকে হেলান দিয়ে অভি বললো, এত কিসের তাড়া ম্যাডাম।

শ্রী এইদিক ঐদিক তাকিয়ে দেখলো স্কুলে র ছেলে- মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। চুরিদারের ওড়নার আঁচল দুটো পিছন থেকে সামনে নিয়ে হাতের সাথে জড়িয়ে অস্থির হয়ে শ্রী বললো যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো। না হলে আমি চললাম।

মুখ থেকে একটা বিরোক্তিসূচক শব্দ বার করে অভি বললো, আরে চললে কোথায়? আসল কথা গুলোই তো তোমায় বলা হয় নি।

- কি কথা? 

আসলে শ্রী লতা,  প্রথম যেদিন তোমায় দেখি প্রবাল স্যারের বাড়ি থেকে বেরোতে সেদিনই তোমায় আমার ভালো লেগে যায়। তারপর সত্যি বলতে কি আজ বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই আমি তোমায় সেইদিন এর পর থেকেই রোজ ফলো করতে শুরু করি। তুমি হয়তো সেটা লক্ষ্য করে থাকবে।

শ্রী কিছু জবাব না দিয়ে নত মুখেই অভির বলা কথা গুলো শুনতে থাকলো।

তারপর এইতো আগের সপ্তাহে তোমায় একা রাস্তায় দেখতে পেয়ে তোমার নম্বর চাইলাম। তুমি দিতে চাইলে না, আমার নম্বরটা নিতে বললাম তাও রাজি হলে না। কিন্তু ভাগ্গিস আমি নম্বর টা একবার তবু মুখে বলেছিলাম। তুমি শুনে আমায় তারপর দিন ই মিস কল দিলে। তাহলে এটা তো আমি ধরে নিতে পারি একবার বলাতেই যখন নম্বর মনে রেখেছো তখন নিশ্চই আমাকে তোমার মনে ধরেছে? 

শ্রী সব টুকু রাগ উগড়িয়ে বললো, না ! মনে ধরে নি। আমি জানি তোমার সাথে তিতির দির একটা সম্পর্ক আছে। 

তিতির নাম টা শ্রী এর মুখ থেকে শুনে অভি প্রথম টায় একটু নীরব হয়ে শ্রী এর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজেকে  একটু সামলে নিয়ে বললো, তোমায় কে বলেছে এইসব কথা? 

শ্রী ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকিয়ে বললো, আমি নিজে থেকেই জেনেছি। তোমায় আর ওকে পাড়ার মোড়ে অতনু দার ফুচকার দোকানে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে ফুচকা খেতে দেখেছি। 

শ্রী এর কথায় সায় দিয়ে পুনরায় অভি বললো, আচ্ছা আমায় ফুচকা খেতে দেখেছো একটা মেয়ের সাথে এতদূর মানলাম।

কিন্তু মেয়েটার নাম যে তিতির তা করে জানলে? 

এবার শ্রী খানিকটা চোটে গিয়ে বলল, আমি দেখেছি, জানি এতোটুকুই যথেষ্ট। এর বাইরে বেশি আমি কিছু বলতে চাই না তোমায়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি। 

শ্রী এর চলার পথের সামনে দাঁড়িয়ে অভি বললো, দাঁড়াও শ্রী লতা কিছুটা যখন জানো, তখন পুরোটা জানার অধিকার ও তোমার আছে বই কি

শ্রী আশ্চর্য হয়ে অভির মুখের দিকে তাকালো।

- তুমি হয়তো আমার আর তিতির এর সম্পর্কের কথা শুভ্র , রক্তিম ওদের কাছ থেকে জেনে থাকবে। 

শ্রী কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু অভি হাত তুলে বাধা দিয়ে বললো, থাক শ্রী লতা, তুমি কার থেকে একথা জেনেছ না জেনেছো সেইসব কথা শোনার আমার কোনো দরকার নেই। কিছুটা যখন জানো তখন পুরোটা জানার অধিকার ও তোমার আছে। তিতির আর আমি একই সাথে কলেজে পড়ি। দুজনের সাবজেক্টও এক। ওর সাথে আমার সত্যিই একটা রিলেশন ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ওর দেখাশোনা করে অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। এরপর আমি ওর লাইফ থেকে সরে আসি। আমি এখন শুধু তোমায় ভালোবাসি শ্রীলতা। বিশ্বাস করো আমার তোমাকে ভীষণ ভালো লাগে। 

এই প্রথম শ্রী কে তার পছন্দ মতো কেউ প্রপোজ করলো। 

শ্রী এর ঠোঁট দুটো ঈষৎ কেঁপে উঠলো। শরীরে একটা অদ্ভুত উন্মাদনার সৃষ্টি হলো। লজ্জায় সে অভির দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলো না। ইচ্ছা করছিল এক ছুট্টে ওখান থেকে চলে আসে। কিন্তু পা যেন সামনের দিকে এগোতে চাইছিল না।

- কি হলো শ্রীলতা? তুমি কিছু বলছো না যে? আমি তো আমার সম্পর্কে সবটাই তোমায় খুলে বললাম। এবার তোমার কি মতামত সেটা জানতে চাই। 

- আমার অনেকটা লেট হয়ে গেছে। আমি পরে কথা বলবো। 

- আচ্ছা। ফোনেই না হয় জানিও তোমার মতামত টা। চলো বাইকে বসো। তোমায় তোমার বাড়ির কাছে এগিয়ে দিয়ে আসি। 

- না, না! তার আর দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব। 

- আচ্ছা, ঠিক আছে আজ আসি। ফোনে কথা হবে

 এই বলে অভি বাইক স্টার্ট দিলো।  ঠিক ওইসময় টাই শুভ্র দের দলটা সাইকেলে চেপে   ফিরছিল স্কুল থেকে। অভির সাথে শ্রী কে কথা বলতে দেখে রক্তিম , সায়ন রা হা হয়ে গেল। শুভ্রর ভিতরটা একটা অজানা ব্যাথায় চিন চিন করে উঠলো।

 শ্রী ওদের দেখে দ্রুত হাটতে শুরু করলো।


দীপক বাবুর অফিস থেকে ফিরতে আজ - কাল অনেকটাই লেট হয়ে যায়। সেইসময় শ্রী পড়াশোনা করে তাই কথা বলার তেমন একটা সুযোগ পান না মেয়ের সাথে। তবে প্রতিদিন ই মেয়ের খবর নেন চৈতি দেবীর কাছ থেকে। আজ ও অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে চৈতি কে জিজ্ঞাসা করলো, 

- কি গো শ্রী কেমন পড়াশোনা করছে, একবারও ওর প্রাইভেট স্যার এর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়েছ এই কদিনে? 

চৈতি দেবী হাতের কাজ গুলো সারতে সারতে ঠোঁট বেকিয়ে একটা বিরোক্তিসূচক  শব্দ করে বললেন, আমায় যেতে দিলে তো ও? 

দীপক বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, চৈতি দেবীর কথা শুনে বললেন, - যেতে দিলে মানে টা কি? তুমি ওর মা শ্রী কেমন পড়ছে না পড়ছে তুমি জানবে না? মেয়ে বারণ করল আর তুমি তাই শুনে এতদিন হাত পা গুটিয়ে বাড়িতে বসে রইলে? 

বাইরে থেকে মা- বাবার কথাকাটাকাটি শুনতে পেয়ে শ্রী পড়া থেকে কান টা একটু ঐদিকেই দেওয়ার চেষ্টা করলো। 

- দেখছি আমাকেই অফিস ফেরত স্যারের বাড়ি যেতে হবে। 

বাবার কথা শুনে শ্রী মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গেল। ইদানিং ও যে কোনো স্যারের কাছেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায় নি সে কথা ভেবেই ওর শরীর টা কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাছাড়া স্যারে রা মাঝে মধ্যে পরীক্ষা নেয় সে কথাও ও বাড়িতে জানায় নি। শ্রী বরাবরই বিছানায় পড়তে বোসতো। চেয়ার এ বসে পড়লে নাকি ওর খুব পিঠে লাগে। সুতরাং বিছানা ছেড়ে নেমে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এলো পুরোটা শোনার জন্য। দীপক বাবু সেই মুহূতেই ব্যস্ত হয়ে শ্রী এর ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। দুজনেই প্রায় ধাক্কা হয়ে যাচ্ছিল। শ্রী চমকে গিয়ে থতমত খেলো।

-শ্রী তুই  মা কে কেন স্যার এর বাড়ি দেখা করতে যেতে বারণ করেছিস? তুই কি চাস? মাধ্যমিকেও খারাপ রেজাল্ট করতে? 

দীপক বাবুর রক্তবর্ণ চক্ষু দেখে শ্রী আর চোখ তুলে চাওয়ার সাহস পেলো না। এইসুযোগেই চৈতি দেবী তাল মিলিয়ে বললেন, ঠিক মতো বাড়িতেও পড়তে বসে না। সব ওই কাল হয়েছে তোমার দেওয়া ফোন টা হাতে পেয়ে। দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ফোন টাকে কাছার মেরে ফেলে দিতে। তবে যদি আমার গায়ের জ্বালা মেটে। সারাদিন শুধু ফোন ই ঘেঁটে যাবে। কি আছে ওই ফোনে কি জানি বাবা! 

চৈতি দেবী নিজেকে সামলাতে না পেরে শ্রী এর দিকে তেড়ে এলো।

- ওহ! চৈতি ওতো বড়ো মেয়ের গায়ে কেউ হাত তোলে? 

শ্রী একটু সাহসে ভর দিয়ে বললো, ফোন এ কি শুধু চ্যাট ই হয় নাকি ... পড়াশোনা টাও তো হয়। 

হাত নাড়িয়ে চৈতি দেবী শ্রী কে বললেন, তুমি কত ভালো জিনিস দেখবে তা আমার জানা আছে। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ভালো কথা বলছি শুনছো, এখনো সময় আছে, আমার কথা শোনো পরীক্ষা এখনো বেশ কিছুদিন দেরি আছে। এখনই ওর থেকে ফোন টা নিয়ে নাও। তবে যদি পড়াশোনায় ওর মন বসে। 

মায়ের কথা শুনে শ্রী প্রমাদ গুনলো। সর্বনাশ! ফোন কেড়ে নিলেই তো এখন কেলেঙ্কারি। কি ভাবে সামলাব এখন এই পরিস্থিতি টা! বাবাও তো আছেন, ভীষণ চোটে। 

শ্রী যতটা সম্ভব ধীর স্হির হয়ে বলল, বাবা ফোন টা কেড়ে নিও না। মা না বুঝুক তুমি তো বোঝ ফোন টার দরকার আছে। 

- বেশ, কিন্তু পড়তে বসার সময় হাতের কাছে ফোন নিয়ে তোকে পড়তে বসতে হবে না। সুইচ অফ করে রাখবি। পড়া হয়ে গেলে খুলিস। 

শ্রী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়াল। 

- নে, পড়ে নে।

দীপক বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আবার পিছন ঘুরে জিজ্ঞাসা করলেন, কাল ভাবছি অফিস থেকে ফিরে একবার দুটো স্যার এর সাথেই দেখা করে আসবো। ওই সময় স্যার বাড়ি থাকেন কি জানিস? 

শ্রী চিন্তা করল, প্রবাল স্যারের কাছে ও নিত্যদিনই অংক নিয়ে একটু আধটু বকা খায়। তাই কায়দা করেই ও বললো প্রবাল স্যারের সন্ধে বেলা তেও ব্যাচ থাকে। তুমি রোথিন স্যারের সাথেই দেখা করে নিও। আর প্রবাল স্যারের সাথে দেখা করতে গেলে স্যার বলেন, সকাল বেলার দিকে গেলেই ওনার সুবিধা হয়। 

দীপক বাবু বিড়বিড় করে বললেন, সকালের দিকটা আবার আমার তাড়া থাকে। দেখি তোর মা কেই একবার বলে পাঠাতে হবে।

শ্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বাবাকে স্যার কিছু বললে বাড়িতে এখন থমথমে পরিস্থিতি র সৃষ্টি হবে। মা যাবে তবু ভালো। মা এর রাগ কোনো রকমে ম্যানেজ করে নেবে  ও।

চলবে....


ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ