নীরবে ভালোবাসি পর্ব -১৪
ঘড়ির কাটা তখন আট টা পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেয়েই একটা ঝড়ো হাওয়া গুমোট পরিবেশটাকে বেশ শীতল করে দিয়েছে। মা- মেয়ে দুজন এই এখন চুপ হয়ে আছে। শ্রেয়া অনেক্ষন ধরে তার মা কে অবান্তর প্রশ্নে পীড়াপীড়ি শুরু করেছিল। ও নিজেই এখন বুঝতে পারছে মা কে এতটা জোরাজুরি করা উচিত হয় নি। মায়ের মুখের পানে চাইতেও এখন যেন ওর অপমান বোধ হচ্ছে। নিজের স্বভাব গুনেই মা কে কত কষ্ট দিয়ে ফেললাম এই ক্লেশ টাই তার অন্তর আত্মা কে এখন অহরহ বেদনায় ভরিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি মুখোমুখি দুজনে বসে থাকলেও এখন দুজনের মধ্যে বাক্ক্যালাপের অনুপস্থিতি ঘর টার মধ্যে থমথমে ভাব নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষন মৌন থাকার পর শ্রেয়া শান্ত গলায় বলল, আচ্ছা ঠিক আছে মা। তোমায় এখন বলতে হবে না। পরে অন্যকোন দিন বোলো। এবার শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে আশা দেবী বললেন, দেখাশোনায় অসুস্থতার কথা শুনে আমি তো কখনোই ওই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। পাত্রপক্ষ দেখে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে শুরু হলো চাপা অশান্তি। বাবা গম্ভীর হয়ে মা কে বললেন, ললিতা কে ওতো টা আশ করা দেওয়া তোমার উচিত হয় নি। আমি গরীব হতে পারি তা বলে যার তার গলায় নিজের মেয়েকে ঝুলিয়ে দিতে পারি না। মা এর ও যে মনে অশান্তি খোচা দিছিলো তা মায়ের মুখ টা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তবু মা আস্বস্ত করে বলেছিল, ও একটু আধটু মাথার দোষ বই পাগল দের থাকে। তাদের প্রকৃত অর্থে ঠিক পাগল বলা চলে না । ওনারা নিতান্তই ভালো মানুষ তাই কোনো কিছু গোপনে রাখেন নি। ওদের জমি - জায়গা অনেক , আমি বলি কি একদিন সবাই মিলে চলো পাত্রপক্ষের বাড়ি ঘুরে আসি। বাবা, যেতে সম্পূন্ন না রাজ ছিলেন। মা এর প্রশ্নের উত্তরে বাবা বললেন , না ! তুমি বরঞ্চ ললিতা কে বলে দিও পাত্র পক্ষকে খবর দিয়ে দিতে আমাদের এই সন্মন্ধ পছন্দ হয় নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার মতা মত কে উপেক্ষা করেই বাবা কেও জোর করে নিয়ে মা ললিতা কাকিমার সাথে গিয়ে হাজির হয়েছিল আমার শশুর বাড়ী। বিষয় সম্পত্তি নেহাত কিছু কম ছিল না। যা বলেছিলেন সত্যই বলেছিলেন। আর পাত্রকে দেখেও মা এর অপছন্দ হয় নি। তোর বাবাকে এমনিতে দেখলে কেউ বুঝতে পারতেন না যে মানুষ টার মাথা একটু গোলমাল। সব কিছুই স্বাভাবিক মনে হতো। খুবই নম্র, ভদ্র , বিনয়ী ব্যবহার।
পাত্রপক্ষ এর বাড়ী থেকে ফিরেই একটা উৎফুল্লতার প্রবাহ দেখা গেল মায়ের চোখে মুখে। তোর ছোট মামা মানে রঞ্জু মা কে বলল , কেমন দেখে এলে মা পাত্রপক্ষের বাড়ি?
- সে বিশাল বাড়ি। হয়তো একটু পাড়া গাঁয়ে এলাকা। তা হোক। কিন্তু এত ভালো সন্মন্ধ আসবে আমি ভাবি নি।
- তাহলে পাত্র কে দেখে কি বুঝলে?
- তাকে তো দেখে তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হলো না। তবে পাত্র মানে জ্যোতির্ময় এর মামা টা কে আমার ঠিক পছন্দ হয় নি।
- কাকে তোমার পছন্দ হলো না হলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না মা। আমি এই বিয়ে করবো না।
কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, মা তুমি জেনে শুনে একটা পাগল এর সাথে আমায়...
- চুপ কর মুখপুড়ি। দেখছিস তো তোর বাবার এই আর্থিক অবস্থা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তার ওপর তোর দাদার কলেজের পড়াশোনা, টিউশন তোর ভাই এর লেখাপড়া কত খরচ বল তো?
- তার জন্য তুমি আমায় দোষারোপ করছো মা?
- দোষারোপ করবো কেন? তোর বিয়ে টা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিতে পারলে আমি একটু স্বস্তি পাই।
- সে তো বলবেই।
- আশা তুই দেখিস এই বিয়ে করলে তুই ঠকবি না। সুখেই থাকবি।
- দাদা তুই ও?
- হ্যা, আমি বলছি। তাছাড়া দেখে তো এলাম। জ্যোতির্ময় কে বাইরে থেকে দেখলে কোনো ভাবেই বোঝা যাবে না উনি একজন...
- কি হলো বল? চুপ করে গেলি কেন ? উনি একটা পাগল তাই তো? বা! তোরা আমায় এইভাবে...
- কাঁদিস না মা, কপালে থাকলে তুই ই একদিন দেখিস রাজনন্দিনী হবি। বাবা আমার চোখের জল মুছে বললেন।
- আশা, তোর বাবার এই অবস্থা ...তোর বিয়েতে কানা করি কিছুই তেমন দেওয়ার আমাদের সামর্থ্য নেই। ওনারা বলেছেন ওনারাই সোনা গয়না দিয়ে তোকে সাজিয়ে নিয়ে যাবেন। তুই আর অমত করিস না।
অগত্যা অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তারিখ আমার বিয়ে হয়ে গেল জ্যোতির্ময় এর সাথে। শুভদৃষ্টির সময় পান পাতা সরিয়ে তাকে সেই প্রথম দেখা।
- খুব ইটেরেস্টিং মা।
- মারবো না এক থাপ্পড়।
- বলো না কেমন ফিলিংস হচ্ছিল তোমার। কেমন লাগছিলো বাবা কে।
- পান পাতা সরিয়ে দেখলাম একটা সরল, সাদাসিধে দুটো চোখ গভীর আগ্রহের সথে তা আমার চোখের ভাষা পড়তে ব্যস্ত। অত্যন্ত ফর্সা, লম্বা, ছিপছিপে চেহারা । গালে তখন হালকা দাড়ির রেশ। দেখতে মন্দ না।আসলে ওর চোখে এমন এক গভীরতা, সরলতা, ছেলেমানুষি চাওনি ছিল যা আমার মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অচিরেই।
- তারপর?
- তারপর আবার কি? কিন্তু এই বিয়ে যেহেতু জোর করেই আমায় দেওয়া হয়েছিল তাই জন্যই আমার যত কষ্টই হোক আমি তোর মামার বাড়ি যাই না। আমার জন্য আমার বড় দাদার পড়াশোনা আটকে যেতে বসেছিল তোর ছোট মামার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমায় বিদায় করলে যদি ওরা সুখে থাকতে পারে আমি আজীবন তাই চেয়ে এসেছি। আজ ও চাই।
- কিন্তু ছোট মামা তো তোমায় প্রায়ই ওখানে যাওয়ার কথা বলে।
- ওই একটা মানুষই বোধ হয় আমায় অন্তর থেকে আমায় আজও ভালোবাসে । আমার ওই পরিবারে বিয়ে হোক সেটা রঞ্জু চায় নি। তবে ও তখন খুবই ছোট। ওর ইচ্ছার অনিচ্ছার দাম কেউই দিত না। তাই ওকে আমি দোষ দিই না রে। কিন্তু চিন্টুর আজ বউ হয়েছে বলে নয়। ও বরাবরই নিজের সুবিধার কথা আগে বুঝে নিত। যাই হোক। অনেক কিছুই তো জানতে পারলি।
- তারপর বাবা কে তুমি হারিয়ে ফেললে কি করে?
- সে ও একটা অনেক বড় কাহিনী।
- বলবো।এত টা যখন বলেছি। নিশ্চই বলবো। তবে আজ আর নয়। এখন খেয়ে ঘুমবি চল।
শ্রেয়া আর দিরুক্তি না করে মায়ের কথা মতো মুখে কিছু দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
- কি রে রেডি হয়ে গেছিস? বেরোবি কখন? বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। প্রথম দিন ব্যাচ শুরু হচ্ছে। দেরি করলে আর হয়তো জায়গা পাবি না।
- বাড়ির বাইরে থেকে ফোনে কথা বলছিস, বাড়িতে ঢুকতে কি হচ্ছে তোর? আমার হয়েই গেছে। এক মিনিট দাঁড়া শ্রেয়া। আসছি।
- এখনো এক মিনিট। আরে ফোনটা না রাখলে বকতে বকতেই তোর সাথে চার মিনিট পার হয়ে যাবে।
ও প্রান্ত থেকে আর কোনো কথা না বলেই শ্রেয়া ফোনটা কেটে দিলো।
- চল। তাড়াতাড়ি একটু পা চালিয়ে চল। শ্রেয়া আর শ্রী হনহন করে হাঁটা দিলো। পিছন দিকে একটু হই হই আওয়াজ শুনে তারা পিছু ফিরে তাকালো। দেখলো শুভ্র রা যাচ্ছে। শ্রী আবার ওদের দেখে মিচকে হাসলো।
রক্তিম, সায়ন, পিকাই আবার আগের মত শুভ্র কে রাগাতে শুরু করে দিলো ওদের দেখে।
- দেখ ভাই, প্লিজ শ্রেয়া কে নিয়ে ঐভাবে আমায় লেগফুল করিস না। আমার ওর প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
- মিথ্যে বলিস না শুভ্র ।এতে কষ্ট তোর বাড়বে বই কমবে না।
- ধুর! তোরা আসল ব্যাপারটাই বুঝতে চেষ্টা করছিস না।
- আমরা, জানতেও চাই না বস। তোর একজন কে ভালো লাগে আমাদের দায়িত্বর তার সাথে তোকে মিলিয়ে দেওয়া। এখন আর এসব কথা নয়। চল পড়তে ঢোক। তখন না হয় নোটস লিখতে লিখতে চোখে চোখে কথা বলিস।
পড়ার ব্যাচে যেখানটা শ্রী, আর শ্রেয়া বসেছে সেখান থেকে শুভ্র দের খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। শ্রেয়া একবার সকলের নজর এরিয়ে শুভ্র কে দেখলো। শুভ্র চোখ তখন খাতার দিকে আবদ্ধ। সকলেই তখন নোটস লিখতে ব্যস্ত। এতদিন শুভ্র কে সে গুরুত্ব ই দেয় নি। আজ কেন জানি শ্রেয়া বারবার সুযোগ বুঝে ওর দিকে তাকাচ্ছে।
বাড়ি ফেরার পথেও শ্রেয়া আজ আড় চোখে সকলের অলক্ষ্যে বেশ কয়েক বার শুভ্র র দিকে তাকিয়েছে। শুভ্র তখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে মশগুল। একবার চোখাচোখি হতে শুভ্র লজ্জায় মুখ টা নামিয়ে নিলো। সহসা চোখে চোখ পরে যেতেই শ্রেয়াও দ্বিগুন লজ্জায় মাথা নোয়ালো। রাস্তায় চলার পথে ও শ্রী এর বকবকানি গুলোও শ্রেয়া মনোযোগ সহকারে শুনলো না। হু , না ছোট বাক্যে সেরে দিলো। শ্রী ভাবলো শ্রেয়ার হয়তো আজ কোনো কারণে মেজাজ ঠিক নেই। সব দিন সকলের মন মর্জিও ঠিক থাকে না। তাই ওকে আর জিজ্ঞাসা বাদ করলো না।
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ