নীরবে ভালোবাসি পর্ব -১৫

love silently part 15

আগের পর্ব পড়ুন 

নীরবে ভালোবাসি পর্ব -১৫


- কিরে, নতুন স্যারের কাছে আজ পড়তে গিয়ে কেমন লাগলো শ্রী?

- কেমন আবার লাগবে! ভালোই লাগলো। তুমি চটপট খেতে দাও মা। ভীষণ খিদে পেয়েছে। 

- ও! আজ বুঝি পড়ে ফেরার পথে ফুচকা, পাপড়ি চাট, কিংবা  মোমো খাস নি ? তাই বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই খাওয়ার  তাড়া।

-তুমি না,  মা খুব অদ্ভুত। কখন কি বলো তোমার মতি গতি কিছুই বুঝতে পারি না। বাইরে থেকে খেয়ে এলে গজগজ করবে। বলবে ওই সব বাইরের জিনিস খেয়ে খেয়ে শরীর খারাপ করে ফেলেছি। ফালতু টাকা খরচ করছি। আবার আজ কিছু খেয়ে আসি নি বলছি তাতেও তোমার মন করকর করছে। 

- উফফ! তুই এত চটছিস কেন? কোনো কারণে তোর কি মন খারাপ আজ? 

- জানি না। 

চৈতি দেবী আর কথা না বাড়িয়ে বিস্মৃত মনে রান্নাঘরে গেলেন খাবার আনতে। শ্রী তখন ও বাইরে থেকে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে নি। 

- কি রে ড্রেস চেঞ্জ না করেই বাইরের ড্রেস পরেই কি খেতে বসবি। যা আগে চেঞ্জ করে আয়। তারপর খাবি ।

- মা বললাম তো জোর খিদে পেয়েছে। 

- ড্রেস চেঞ্জ করতে বেশি সময় লাগবে না। যা শীঘ্রই। 

- যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি।

ড্রেস চেঞ্জ করে খাবার টেবিলে শ্রী খেতে বসলো। একটু মুখে দিয়েই চিবোতে চিবোতেই সে বলল মা দারুন করেছ কিন্তু আলুর পরোটা টা। চৈতি দেবী কেবল একবার প্রাপ্তিসূচক  হাসলেন। মুখে কিছু বললেন না। 

- মা জানো তো আজ টিউশন থেকে আসার পথে লক্ষ্য করলাম শ্রেয়ার মুড অফ। আসার পথে আমার সাথে ভালো  ভাবে কথাই বললো না। 

- ও! তাই বল। এটাই তাহলে আসল কারণ তোর মুড অফ থাকার আর বাইরে থেকে কিছু না খেয়ে আসার। সব দিন কি মানুষের মেজাজ ফুরফুরে থাকে। মন খারাপ হতেই পারে। 

- মা একটা কথা বলবো তোমায়? তুমি রাগ করবে না তো? 

- না , বল

- আগে কথা দাও। আমায় বকবে না। আসলে তুমি তো আমায় সবসময় বলো যে, তুমি আমার বন্ধুর মতো। তোমায় সব কথা বলা যায়।

- হ্যা ঠিক ই তো বলি। মা হলো সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তাকে মন খুলে সব কিছু বললে মন ভালো থাকে।

জানো তো শ্রেয়াকে আমাদের ব্যাচের একটা ছেলে খুব পছন্দ করে। নাম শুভ্র। খাবারের দিকে চেয়েই মুখ নিচু করে এক নিঃশ্বাসে শ্রী বললো তার মা কে। 

- কি করে জানলি? 

- স্কুলে, পড়ার ব্যাচে সব ছেলে- মেয়েরা তো ওদের দুজনকে রীতিমতো ক্ষেপায়।

- এখনো এইসব নিয়ে ভাবার বয়স হয় নি তোদের। এখনো মাধ্যমিক পরীক্ষা ই দিলি না । আর এখন থেকেই এইসব আলোচনা করছিস।

- এই জন্যই মা, তোমায় কিছু বলতে চাইছিলাম না।

- এখন পড়াশোনার সময়। এই বয়সটা এই সময় টা পেরিয়ে গেলে আর ফিরে পাবি না। তাই আবারো বলছি পড়াশোনায় মন দে। এই বলে চৈতি দেবী শ্রী এর কাছ থেকে উঠে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 


আজকের সন্ধ্যে টা খুবই আকর্ষণীয় শ্রেয়ার কাছে। পড়ে বাড়ি ফিরে এসে তার মন আজ বেশ ফুরফুরে। হাতে মায়ের তৈরি এক কাপ চা নিয়ে সে ঘরের লাগোয়া জানালার কাছে বসলো। বাইরে রোজকার মতো দুটো কুকুর এখন দুজনের মধ্যে বদমাইসি, খুনসুটিতে মত্ত। শ্রেয়ার কেন জানি মনে হলো ও দুটোতে হয়তো গভীর প্রেম আছে। তাদের রোকমসকম দেখে শ্রেয়া চা এ চুমুক দিতে দিতে আপন মনে হাসতে থাকলো। হটাৎ কুকুর দুটো নিজেদের মধ্যে মারপিট ছেড়ে একে অপরকে চাটতে শুরু করলো। এই দৃশ্য দেখে শ্রেয়ার চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। একটা অজানা ভালোবাসার হাতছানি সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে এখন। তার সারা শরীর জুড়ে একটা শিহরণ এর সৃষ্টি হলো। একটা দমকা হাওয়া আনমনে থাকা শ্রেয়ার এলোমেলো চুলের ওপর দিয়ে আলগোছে বয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার সমস্ত শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। অবিনস্ত, পরিপাটি হীন চুল গুলোকে কোনো মতে দুপাশেরর কানে গুঁজে জানালা দিয়েই আকাশের দিকে সে চোখ রাখলো। দেখলো সেখানেও চলছে তারা দের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা। ওদের দলের লিডার যেন ওই ঘন কালো আকাশ জুড়ে থাকা মস্ত বড় চাঁদ টা। সেও ক্রমাগত তারাগুলোর মতো একবার মেঘের কোলে ভাসছে, একবার মুখ লুকোচ্ছে। আচ্ছা, শুভ্র ও কি এমনই লাজুকে? এত কথা বলার মাঝেও মনের কথাটা বলে উঠতে পারছে না। মনের কোণে এই প্রশ্ন এর উদ্ভব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেয়া আপনা হতেই চমকে নিজের খেয়ালে একবার হেসে উঠলো। নিজের মাথাতেই হালকা চাটি মেরে জানালা টা সজোরে বন্ধ করে বিছানায় এসে শুলো।

-ওমা, চা টুকু খেয়েই শুয়ে পড়লি যে? রান্না ঘর থেকে রান্না করতে করতে কতবার  হাক দিলাম মুড়ি কটা নিয়ে যেতে নিয়েও গেলি না। তোর কি হয়েছে বলতো? 

-কিছু না মা। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। তাই শুলাম। তুমি একটু ঘরের আলো টা নিভিয়ে জিরো লাইট টা জ্বালিয়ে দিয়ে যাও। 

-মাথা ধরেছে নাকি?

-না গো। এমনি কি একটু শুয়ে থাকতে পারি না?

-আচ্ছা ঠিক আছে।

আশা দেবী শ্রেয়া কে আর বিশেষ না ঘটিয়ে জিরো লাইট টা জেলে দিয়ে গেল। 


হোম থিয়েটারে বাজা রবি ঠাকুরের গান টা শুভ্রর একলা থাকার এই নির্জন সন্ধ্যে টাকে আরো মধুর করে তুলেছে। খোলা জানালার এক পাশে বসে উদাসী মেঘের ইতস্তত ছোটাছুটি খেলা দেখতে দেখতে গানটি ও মন দিয়ে অনুভব করছে। শুভ্রর মনে হতে থাকলো সত্যি রবি ঠাকুর সেকালে শুধু  যেন আমার জন্যই এ গান রচনা করেছিলেন।।

"-তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম"

আমি এক নীরব প্রেমিক হয়েই হয়তো এইভাবে তোকে ভালোবেসে যাবো। তোকে যে মনের কথা উজাড় করে বলবো সে সাধ্য যে আমার নেই। আমি এই বেশ ভালো আছি। খুব ভালোবাসি। এ ভালোবাসা প্রকাশ পেলে যদি তাকে চোখে দেখার অধিকার টুকুও হারাতে হয়! তা আমি পারবো না। বরঞ্চ নীরবেই ভালোবাসি। 

তুই চঞ্চল, তুই কিছুটা অগোছালো, তুই খানিকটা নির্বোধ ও বটে। তবে তোকে ওভাবেই মনে গেথেছি। নিজের এই নিজস্ব তা টা কখনো হারিয়ে ফেলিস না যেন। কিন্তু  অন্য দের কথা শুনে আমায় তুই ভুল বুঝিস এতে আমার খুব অদ্ভুত লাগে জানিস তো। আমার চোখের ভাষা, আমার হৃদয়ের গোপন মণিকোঠায় পরিস্ফুটিত প্রেমের আভাস টুকু তুই অন্তত উপলব্ধি করতে পারবি এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু না, তুই ও অন্যদের তালে তাল মিলিয়ে আমায় রাগাস, ক্ষেপাস। বেশ, আমার আর পাঁচটা বন্ধুদের মতো তুই ও যদি অবুঝ হয়ে থাকিস তাতে আমি কি করবো।  আমি যে নিরুপায়। কিন্তু একদিন ঠিক ই খুঁজে পাবি আমার অন্তরের প্রত্যেকটা অনুভূতির ঠিকানা। ততদিন না হয় নীরবেই ভালোবাসি। আমি এই ভাবেই রবি গানে , তোর প্রাণোচ্ছল তাকে ছুঁতে পারি। এইভাবেই গোপনে ভালোবাসি। খুব খুব ভালোবাসি। 

রবি ঠাকুরের গানের সাথে সাথে শুভ্র আজ নিজের মনের কথা গুলো চার দেওযালের ঘরে বসে নিজের মনে নিজের সাথে কথা বলে বেশ তৃপ্তি পেল। যেসব মনের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রেমের হিসাব অন্য কারোর কাছে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তা অন্তকরণের সাথে ভাব বিনিময়ের সাথে তার প্রাণটা যেন হালকা বোধ হলো। একটা মন ভালো করা সন্ধ্যে কখন যে বিদায় নিয়ে রাতের উপস্থিতি ঘটিয়েছে ঘড়ির শব্দ তা জানান দিলো। 

- শুভ্র খাবি আয়। মায়ের চিৎকারে ছোট্ট জবাব দিয়ে গানটা বন্ধ করে শুভ্র খাওয়ার টেবিলে এসে হাজির হলো।

আজ শুভ্রর বাবা বিকাশরঞ্জন বাবু সন্ধ্যে র তাসের আড্ডা সেরে বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই সকলে একসঙ্গে ডিনারে বসবে। 

ঘুঘনি সহযোগে রুটি সাথে গোটা দুয়েক মিষ্টি। এই ছিল রাতের আয়োজন। টেবিলে বসে তিন জনেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। খেতে খেতে বিকাশরঞ্জন বাবু উৎসুক দৃষ্টিতে শুভ্রকে জিজ্ঞাসা করেন, শুভ্র এই জায়গাটা তোর কেমন লাগে রে? 

বিস্ময় ভরা গলায় বলে শুভ্র -ভালোই। হটাৎ এই প্রশ্ন? আমরা তো এখনে বছর ছয়েক হয়ে গেল এসেছি। এতদিন পর এই প্রশ্ন হটাৎ? 

- খেতে খেতেই বিকাশরঞ্জন বাবু বললেন - এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা শুভ্র তোর মধুপুরের কথা কিছু মনে আছে? 

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ