নীরবে ভালবাসি পর্ব-৮

 

love silently part 8 to be continue


আগের পর্ব পড়ুন 

নীরবে ভালবাসি পর্ব-৮

- কি হলো তুমি আবার আসতে আজ দেরি করলে কেন? আমি ভাবলাম হয়তো এই ট্রেন টা পাও নি বোধ হয়। 

দরজার সামনে জুতোজোড়া খুলতে খুলতে ঘর্মাক্ত শরীরে  একরাশ ক্লান্তিভরা মুখে হাসির প্রলেপ এঁটে দীপক বাবু বললেন, বা রে, তুমি তো আজব দেখছি। আজ একটু মিষ্টি আর মাংস কিনে আনলাম।  রাতেই রেঁধে ফেলবে মাংসটা । 

নাও, এই গুলো ধরো। এই গুলো কিনতেই এত দেরি হলো। আসলে মিষ্টির দোকানে আজ যা ভিড়। তাই আর কি ? 

- তা কি উপলক্ষে এত ঘটা শুনি? 

চৈতি খুব ভালো করেই জানে আজ শ্রীলতার রেজাল্ট বেরিয়েছে, তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবছর ও শ্রী এর বাবা এইসব কিনেছে। তবু অংকের রেজাল্ট শুনে চৈতির মন যেহেতু অসুন্তুষ্ট হয়ে আছে তাই মনের গহীনে পুঞ্জীভূত চাপা বিরক্তির ঢেউ উপচে পড়ছে মাংস ও মিষ্টির প্যাকেট গুলো দেখে। 

- শ্রী, এবারেও তোর একই হাল অংকের। তুই একটুও শুধরবি না দেখছি। যাক গে, এবার টা না হয় যা হওয়ার হয়েছে।এরপর থেকে ভালো ভাবে চেষ্টা করবি।

দীপক বাবুর কথা গুলো শ্রী খুব বিস্ময় সহকারে শুনছিলো। কারণ দীপক বাবু বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে শ্রী বেশ সজাগ হয়ে তার কর্ণ যুগল বাহিরের দিকে নিক্ষেপ করে রেখেছিল।  সে খুব ভালোভাবেই জানতো তার মা এবার শ্রী এর রেজাল্ট সম্পর্কে আগা গোড়া নম্বর তার বাবাকে শোনাবে। বিশেষ করে অংকের নম্বর। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে তার মা কিছু বলার আগেই দীপক বাবু হাত- পা না ধুয়েই শ্রীলতার সাথে কথা বলতে তার রুমে ঢুকলো এবং তার অংকের নম্বর খারাপ এসেছে শুনেও তার সাথে নমনীয় বাক্যা লাপ করলো। 

এদিকে চৈতিও যে দীপক বাবুর কোমল আচরণে খুব বেশি যে অবাক হয় নি তা নয়। তিনিও চা দিতে এসে খানিকক্ষণ থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইললেন।


মা, মেয়ের মনের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরে দীপক বাবু চা এর কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে একটু গম্ভীর গলায় চৈতির দিকে তাকিয়ে বললেন, কি আর বলবো বলো, ট্রেন থেকে নেমেই শ্রী এর প্রবাল স্যার এর সাথে দেখা। ওনার কাছ থেকেই শুনলাম শ্রী এর অংকের নম্বর। এতদিন শ্রী কে বুঝিয়েও যখন পারলাম না তখন আর মেরে ,ধরে , বকে লাভ নেই বুঝলে চৈতি। প্রসঙ্গত কথা গুলো শ্রী কেই যে শুনিয়ে দীপক বাবু চৈতি কে বলছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওর তো বয়স হয়েছে। চা এর কাপে শেষ চুমুক দিয়ে শ্রী এর উদ্যেশে বেশ রুক্ষ তার সাথে দীপক বাবু আরো এক চোট ধারালো কথা বললেন, 

- ওর ভালো, মন্দ ও এবার নিজেই বুঝে নিতে পারবে । প্রতিবার এককথা বলে বলে আর কি হবে। 

শ্রী এর চোখে সেদিন রাতে আর ঘুম এলো না। বাবার বলা কথা গুলো তার কানে বেদনার সুর তুলে তাকে  মন মরা করে রেখেছে। পা বালিশ খানা জড়িয়ে এপাশ ওপাশ করলেও কিছুতেই সে ঘুমোতে পারলো না। 

বারান্দায় এক খানা সিগারেট  হাতে নিয়ে দীপক বাবু চেয়ার টা টেনে নিয়ে এসে বসলেন। রাত এখন গভীর। বাড়ির সামনের ল্যাম্প পোস্টের আলোটা তীব্র আলোয় তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আশেপাশের বাড়ি গুলো নিঝুম, নিস্তব্ধ। সবাই এখন নৈশ নিদ্রায় আচ্ছন্ন। দীপক বাবুর মনটাও আজ অনেকদিন পর একটু হালকা লাগছে। উন্মুক্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন মিটমিটে তারায় আলোকিত আকাশ টার দিকে তাকিয়ে তিনি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলেন। পরমুহূর্তেই এক রাশ ধোয়া তার বুক হতে গলা সেখান থেকে বেরিয়ে মুখ দিয়ে সজোরে উন্মুক্ত হয়ে বাইরে মুক্তির স্বাদ নিলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে তা বাইরের বাতাসের সাথে  মিলেমিশে তাদের সাথী হয়ে ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে তার অস্তিত্ব কে চিরতরে বিলীন করে দিলো। প্রবাল স্যারের বলা কথা গুলো যেন তার জীবনের ভুল ত্রুটি গুলো আজ এক লহমায় ধূলি স্যাৎ করে দিয়ে গেছে। তার মনের ভ্রান্তি কাটলেও স্বভাব গুনে কম নম্বর পাওয়ায় উপযুক্ত কঠিন কথা গুলো যে তাকে বলতেই হবে রেজাল্টের নম্বর শুনে যেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে ই আজ শ্রী কে একথা গুলো তিনি বেকিয়ে বলেছিলেন। সিগারেটের ছাই টা আঙুলের ধাক্কায় ঝেড়ে দিয়ে তিনি আর এক বার প্রবাল বাবুর বলা উপদেশ গুলো নিজের মনে ঝালিয়ে নিলেন।

-, বুঝলেন দীপক বাবু অংকে শুধু কম নম্বর পেয়েছে বলে 

ভাববেন না শ্রী এর জীবন টা সে নিজেই নষ্ট করে ফেললো। অংকে কম নম্বর ও পায় ঠিক ই। কিন্তু বাকি সাবজেক্ট গুলোয় কিন্তু ও দারুন রেজাল্ট করে। অংক ছাড়া জীবন অচল এইরকম ধ্যান, ধারণা অপনাকে বদলাতে হবে। দুনিয়া এখন অনেক পাল্টাচ্ছে মেয়েরা মন্ত্রী র আসনে সসন্মানের সাথে কাজ করছে, মহাকাশে পারি দিচ্ছে, পাহাড়, পর্বত জয় করছে । প্লেন চালাচ্ছে। সবাই কি তারা গণিতে ভুঁড়ি ভুঁড়ি নম্বর পেয়ে শীর্ষে উঠেছে? তা নয়। সুতরাং মেয়ের অঙ্ক ভালো লাগে না এতে হতাশ হওয়ার কোনো মানে নেই। শ্রী কে আমিও বলি আপনিও বলবেন অন্যান্য বিষয়ের মতো সে যেন অঙ্ক টা তেও একটু মন দেয়। ব্যস এইটুকুই। কিন্তু আপনি তার পরিবর্তে ওর ওপর অংকের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন। ওকে বোঝাতে চাইছেন অঙ্ক ছাড়া জীবন বৃথা। এটা একদমই উচিত নয়। শ্রী আপনার একমাত্র কন্যা তাকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন, স্বাদ থাকতেই পারে। এতে অন্যায়ের কিছু নেই। কিন্তু জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছে টুকু অন্যের ঘাড়ে চাপানো ও যে অনুচিত। সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ তে দীপক বাবু শেষ বারের মতো টান দিয়েই ব্যালকনির রেলিং দিয়ে অবশিষ্ট অংশ টা ছুড়ে ফেললেন। এক চিমটি আগুন মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির লাগোয়া রাস্তা টায় পরেই নিভে গেল। দীপক বাবু সেদিকে একবার দৃষ্টিপাত করেই চেয়ার ছেড়ে ওয়াশ রুমে গেলেন। মুখে , চোখে জল দেওয়ার সময় নিজের মুখ খানি আয়নায় দেখেই নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। 

- আহা...অফিস থেকে ফিরে এসে ই শ্রী কে ওই ভাবে বলাটা আমার উচিত হয় নি। কি জানি মেয়েটা আমার এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি তার বাবার ওপর অভিমান করে বালিশে মুখ গুজরে চোখের জল ফেলছে ।

সাতপাঁচ ভাবনার গভীরে নিজেকে পেঁচিয়ে আনমনে তিনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন শুতে। শ্রী এর ঘরের আলো খানি হঠাৎই তার গতিপথ রুদ্ধ করলো।তিনি পায়ে পায়ে দরজার সামনে এসে স্নেহ মাখা গলায় বললেন,

- শ্রী রাত হয়ে গেছে। এখনো ঘুমোস নি?

আচমকাই বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে শ্রী চমকে উঠলো। চট করে দুহাতের তালুর সাহায্যে জলে সিক্ত গাল জোড়া মুছেই উঠে বসলো।

-ওহ! উঠতে হবে না মা , অনেক রাত হলো লাইট জ্বলছে ঘরে তাই দেখতে এলাম। খানিক টা ইতস্তত করে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে মা তোর বাবার কথায় তুই রাগ করেছিস? 

এইরকম আদুরে  ব্যবহারে শ্রী এর চোখ ছাপিয়ে আবার জল এলো। গলার কাছ টা আবেগে, অপত্য ভালোবাসায় দলা পাকিয়ে উঠলো। শ্রী মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু দুইদিকে  ঘাড় নাড়িয়ে বোঝালো সে  তার বাবার ওপরে রাগ করে নেই।

মেয়ের অবনত মুখের দিকটা তাকিয়ে দীপক বাবুর বুক টা হুহু করে উঠলো। মনটাও বিষণ্ণ হয়ে গেল। পরক্ষণেই মেয়ের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আলগা হেসে বললেন, হ্যা রে মা, তোর মা আজ মাংস টা কেমন রেঁধে ছিল বল দেখি? বেশ খাসা তাই নারে? 

খানিকটা বাচ্ছা দের মতোই ঘাড়টা জোর জোর নাড়িয়ে শ্রী বললো মোটেই ভালো হয় নি। বড্ড বেশি ঝাল দিয়েছিল। 

মেয়ের কথায় পাল্টি খেয়ে এবার দীপক বাবু বললেন , তাই তো...তাই তো... সত্যি ই খুব বাজে হয়েছিল। শ্রী এর যখন ঝাল লেগেছে ভালো লাগে নি। তবে ও রান্না আলবত খারাপ হয়েছে। আমি কালই চৈতি কে বলবো রান্নাবান্নায় ঝাল যেন সে এবার থেকে কম দেয় কেমন?

তৎক্ষণাৎ বাবার হাত দুটো চেপে ভীত কণ্ঠে বললো, না বাবা ও কথা বলো না। মা তাহলে আমায় আর আস্ত রাখবে না।

গলার স্বর একটু নিচু করে, দীপক বাবু তার মেয়ের পাশে বসে অবাক হয়ে বললেন , কেন? বললে কি হবে?

ঠোঁট উল্টিয়ে ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকিয়ে শ্রী বললো, তাহলে তো মা অগ্নিশর্মা হয়ে রে রে করে তেড়ে মেরে আসবে। বলবে মেয়ে মানুষ কে সব কিছু খাওয়া শিখতে হয়। ঝাল, মিষ্টি, টক সব কিছু। না জানি কপালে কি লেখা আছে। যেখানে বিয়ে হবে কি জুটবে না জুটবে। মেয়ে মানুষকে সব কিছু খেতে হয়। অভ্যাস কর ঝাল খাওয়া।

চলবে...
পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ