আগের পর্ব পড়ুন
নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১১
স্যারের অপ্রতিভ প্রশ্নে শ্রেয়ার মুখ মুহূর্তের মধ্যেই পানসে হয়ে গেল। শ্রী সেদিকে তাকিয়েই খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, ওর বাবা নেই স্যার। মুহূর্তের মধ্যে রবিন স্যারের চোখে- মুখেও বেদনার ছাপ ফুটে ওঠে।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। আজকে তোমরা এসো। আগামী মঙ্গল বার থেকে তোমাদের ব্যাচ শুরু করবো । সেইদিন আসবে তাহলে। আমি কোন কোন সাবজেক্ট পড়াই জানো নিশ্চই।
শ্রেয়া মাথা নিচু করেই ঘাড় হেলিয়ে ও মুখে বললো, হ্যা স্যার জানি। বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল।
- আচ্ছা বেশ। জানো তাহলে দেখছি। তাহলে তো আর কোনো সমস্যা নেই। এবার তাহলে এসো।
আবার অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে শ্রী জিজ্ঞাসা করলো, স্যার কত টাকা মাইনে দিতে হবে? রবিন বাবু বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, কিছুই দিতে হবে না। তবে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করবে তোমরা, বড়ো হয়ে মা, বাবার পাশে দাঁড়াবে শুধু এটুকুই চাই। আমার কাছে অনেক দুঃস্থ ছেলে- মেয়েরা পড়াশোনা করেছে। তারা আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। রাস্তা- ঘাটে যেখানে ই দেখা হোক না কেন দাঁড়িয়ে কথা বলে, আমায় সন্মান করেন। আমার এই টুকুই প্রাপ্তি। আর কিছু চাই না। তাছাড়া অনেক অবস্থা পূর্ণন ছেলে- মেয়েরাও আসে পড়তে। আগামী মঙ্গল বার আসলেই দেখতে পাবে। আমি কেউ কেই আলাদা ভাবে দেখি না। কিংবা কাউকেই আলাদা ভাবে পড়া বোঝাই না। আমার কাছে সবাই সমান।
আশা করি তোমরাও আমায় সন্মান ও শ্রদ্ধা করবে ও বাবা- মায়ের কষ্ট লাঘব করবে। শ্রী আর শ্রেয়া মাথা হেলিয়ে নত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। দুজনেই সম স্বরে বললো,
- তাহলে আজ আসি স্যার।
- এসো।
স্যারের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে তারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আসলে দুজনেরই মনে ভয় ছিল স্যার কি বলবেন, আদেও মাইনে নেবে কিনা ; উপরন্তু শ্রী এর অংকে নুম্বর কম থাকায় আরো একটু বেশি চিন্তিত ছিল ও। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওরা একদল ছেলের হাসির শব্দ ও পায়ের শব্দ শুনতে পেল। একটু এগিয়ে আসতেই দেখলো শুভ্র, পিকাই, সায়ন, রক্তিম আসছে। ওদের কে দেখে শ্রী রা রাস্তার একটু এক পাশ ঘেষে হাঁটতে শুরু করলো ঠিকই কিন্তু মাথা নামিয়ে মিচকে হেসে শ্রী হাতে একটা চিমটি দিল শ্রেয়ার। শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে গলা নামিয়ে বললো তোর কি স্বভাব বলতো? ওকে দেখলেই আমায় ওমন করিস কেন? ঐদিক থেকে ততক্ষনে হাসির ফোয়ারা আরো বেড়ে গেছে। শুভ্র কেও ওর বন্ধুরা বেশ রাগাছে।
- শুভ্র কেন সকালে ফোন তুললো না আর কেনই বা সকালে এখানে এলো না এবার বুঝতে পারছি। পিকাই এর মাথায় একটা চাটি মেরে শুভ্র বললো, তুই একটু চুপ করবি। দেখছিস না ওরা সামনা সামনি এসে পড়েছে, শুনলে কি ভাববে বল তো?
- আরে, মনের কথাটা যখন তুই নিজেই না বলতে পারছিস আমাদেরই তো উচিত তোর হয়ে তোর মনের কথাটা বলা তাই না?
শুভ্র রক্তিম এর মুখটা চেপে ধরে তার মুখ টা বন্ধ করলো। ততক্ষনে শ্রী আর শ্রেয়া ওদের সামনে এসে পড়েছে। শুভ্র কিছু না বলে একটু অন্যমোনস্কতার ভান করে স্যার এর বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। শ্রী ও শ্রেয়ার সাথে আগে থেকেই শুভ্র ও ওর তিন বন্ধুদের সাথে পরিচিত ছিল। কারণ তারা একই স্কুলে পরে ও একই স্যারের কাছে সায়েন্স গ্রূপ ও পড়তে যায়। সুতরাং তাদের চোখাচোখি হতেই সায়ন বললো,
-কিরে তোরাও বুঝি রবিন স্যারের কাছে পড়বি তাই দেখা করতে এসেছিস তাই তো?
শ্রী একটু ভেনচে বললো, তা দেখে কি মনে হচ্ছে তোর ?নাচ শিখতে এসেছি?
শ্রী এর এই অসভ্য আচরণে সায়ন কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল, কিছুটা ওর রাগ ও হলো। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু শ্রী এর ভেংচানিতে পিকাই রা হো হো করে হেসে উঠলো। শ্রেয়া ফিসফিস করে শ্রী এর কানের কাছে এসে বললো কি অসভ্য তামি হচ্ছে তোর? সোজা একটা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিতে পারিস না? শ্রী কে এই কথা বলে চোখ টিপে আলগা ধমক দিয়ে শ্রেয়া শান্ত গলায় বলল, হ্যা আমরাও পড়তে আসবো বলেই স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি।
-তাহলে তো খুবই ভালো। শুভ্র রও ভালো।
আচমকাই বেখায়েলে পিকাই এই কথাটা বলে ফেললো।আবার সকলে মুখ টিপে হেসে ফেলল। শুধু শুভ্র আর শ্রেয়া ছাড়া। শ্রেয়া আর কথা না বাড়িয়ে শ্রী এর হাত খানা ধরে হেচকা মেরে ওদের ক্রস করে এগিয়ে এলো।
-খুব তো মধুর কণ্ঠে বললি " হ্যা এখানেই পড়তে আসবো।" দিলো তো শুভ্র কে নিয়ে ঠেস দিয়ে কথা শুনিয়ে। শ্রী এর কথার কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়েই শ্রেয়া বিনাবাক্য ব্যয় এ হনহন করে রাস্তা দিয়ে হাট তে থাকলো। শ্রেয়ার থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে শ্রী আর তাকে রাগাতে সাহস পেলো না।
শ্রেয়া, শ্রী চলে যাওয়ার পরও রক্তিম রা শুভ্র কে রাগাতে তখন ও ব্যস্ত। কিন্তু শুভ্র মনে মনে ভাবল শ্রী মেয়েটা কি ভয়ানক রে বাবা, একটা সহজ প্রশ্নকে কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দিলো কি সাংঘাতিক। শুভ্রকে উদাস হয়ে থাকতে দেখে সায়ন বললো, ভাই শ্রেয়ার কথা পরে ভাববি। চল, আগে স্যারের সাথে দেখা করে আসি। শুভ্র মনে মনে বললো, এই অবুঝ গুলো কিস্যু বোঝে না। খালি যাকে তাকে নিয়ে আমায় শুধু রাগাবে। অবশেষে তারাও স্যারের রুমে ঢুকলো।
...............………............................................................
দরজাটা বার তিনেক ধাক্কা দিয়ে শ্রী চেঁচিয়ে বললো, মা দরজা খোলা। তবুও ভিতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। তবে ভিতরে যে উচ্চ স্বরে টিভি চলছে তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। তাতে শ্রী এর মেজাজ টা গেছে আরও বিগড়ে। দাঁতে দাঁত দিয়ে সে গড়গড় করতে থাকলো। ফুল ভলিউমে টিভি চালিয়ে বসে আছে, আর এত করে দরজা ধাক্কাছি শুনতে পারছে না। তার গলার আওয়াজে পাশের বাড়ির প্রণতি আন্টি জানালা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে শ্রী মা দরজা খুলছে না বুঝি? ডোর বেল নস বাজিয়ে দরজা ধাক্কা দিচ্ছ কেন?
-আসলে আন্টি, আমাদের ডোর বেলটা কয়েকদিন হলো খারাপ হয়ে গেছে।
-ও, তাহলে একটা ফোন করো। ভিতরে তোমার মা নিশ্চই টিভি দেখছে। সদর দরজা ধাক্কা দিলে শোনাই তো যাবে না।
-মানে, ফোন তো আমার কাছে নেই আন্টি। আমাদের তো দুটো ফোন একটা বাবার কাছে, একটা বাড়িতে থাকে। আজ শ্রেয়ার সাথে একটু বেরিয়েছিলাম ওর কাছে যেহেতু ফোন ছিল তাই নিয়ে যাইনি।
-ও ...তুমি এক কাজ করো শ্রী আমাদের বাড়ি এসো। আমি তোমার মা কে কল করছি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে আন্টি। তোমায় ওতো ব্যস্ত হতে হবেনা। তুমি শুধু ফোন টাই মা কে করে দাও তাহলেই হবে।
-আরে, এসো তো। সন্ধে হয়ে গেছে। বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছ । দু মিনিট আমাদের বাড়ি আসলে তোমার এমন কিছু সময় নষ্ট হবে না।
শ্রী বাধ্য হয়ে প্রণতি আন্টির বাড়ি ঢুকলো।
-হ্যালো, শ্রেয়া আমি চৈতি আন্টি বলছি, এতক্ষন ফোন ধরছিলিস না কি করছিস তোরা এত সন্ধে অবধি? ফোন করছি ফোন টাও এতক্ষন পর ধরলি।
-কিন্তু আন্টি আমি তো বেশ কিছুক্ষন আগেই চলে এসেছি। শ্রী এরও তো এতক্ষন বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। আমি বাড়ি এসে হাত-পা ধুচ্ছিলাম, তাই ফোনটা ধরতে পারি নি।
-সে কিরে, তাহলে মেয়েটা গেল কোথায়।
-আমিও তো সেটাই ভাবছি আন্টি।
ওদিকে প্রণতি আন্টি বার বার ফোন করলেও ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছে। এতে শ্রী এর রাগ আরো দ্বিগুন হয়ে গেল। প্রণতি আন্টির সাথে সেও জানালা ধারে এসে বসেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে , আজ বাবা ফিরুক তারপর মা এর নামে সব রিপোর্ট করবো।
চৈতি দেবী কি করবেন ভেবে না পেয়ে ফোন টা না চেক করে রেখেই টিভিটা অফ করে সদর দরজা খুলে বাইরে এসে দাড়ালো।
-ওই তো শ্রী তোমার মা বেড়িয়েছেন । আচমকাই প্রণতি দেবীর গলায় শ্রী চমকে উঠলো। প্রণতি আন্টির গলা চৈতি দেবীর কানে আসতেই প্রায় ছুটে এসে তিনি বললেন, শ্রী তুই এখানে আর আমি তোর জন্য ওয়েট করে বসে আছি। চিন্তায় তো আমার হার্ট বিট সব ঠান্ডা হয়ে আসছিল।
চলবে....
0 মন্তব্যসমূহ