নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১০
শুভ্রর বাবা একজন সরকারি কর্মচারী। মা গৃহবধূ। তার বাবার বরারবরই ইচ্ছা শুভ্র কে হায়ার স্টাডি করিয়ে অধ্যাপক করানোর। শুভ্ররও তাই ইচ্ছা। ক্লাসে প্রথম থেকেই রাঙ্ক করা শুভ্র প্রথম থেকেই অঙ্ক সাবজেক্ট টাকে ভালোবেসে এসেছে। আর ইদানিং তার মনে অঙ্ক ছাড়াও আরো একজনকে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ও স্বভাবে খুবই লাজুক। বান্ধবীদের সাথে দরকার ছাড়া কথাও খুব একটা বেশি বলে না। তবে ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেশ ওস্তাদ। ইদানিং শ্রেয়ার সাথে ওর কথা বলাটা ওর বন্ধুরা অন্য চোখে দেখছে। ও নিয়ে ওকে খুব রাগাচ্ছেও।
- শুভ্র বেলা হয়ে গেল যে, এখনো বিছানা কামড়ে পরে আছিস? তোর বাবা যে বলে গেল তোকে আজকের সবজির বাজারটা তোকে করে আনতে। আর তুই...
- ধুর মা! বিরক্ত কোরো না তো । উঠছি আর দশ মিনিট পর।
- কি এখনো দশ মিনিট! তারপর ব্রাশ করবি, চা খাবি , হেলতে দুলতে তোর যেতে যেতে বাজারের সব সবজি শুকিয়ে যাবে। না ! তুই এখনই ওঠ শিগগিরই।
- উফফ ! মা তোমার ক্যাসেট একবার শুরু হলে সেটা আর থামবে না যতক্ষন না আমি উঠছি। আজকেই তো লাস্ট দিন । একটু বেলা করে ওঠার। রেজাল্ট তো বেরিয়ে গেল। এবার সারাটা বছর শুধু পড়া আর পড়া।
একরাশ বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে শুভ্র বিছানা ছাড়লো। ব্রাশ এ পেস্ট টা লাগিয়ে ব্যালকনির সামনে বসার জায়গাটায় ও একটু বসলো। শুভ্রর মা রেণুকা গেলেন চা এর জল বসাতে। বেলা তখন প্রায় আটটা বেজে গেছে। চারিদিকে সূর্যের আলো তার সকাল বেলার মিষ্টি তেজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্ট গুলোর সাথে লাগানো তার গুলোয় সারি সারি কাকের মেলা। না জানি কোন খেয়াল এ আগত বিপদকে তুচ্ছ করে তারা সভায় বসেছে। একটা মাছ ওয়ালা দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে হাকতে হাকতে বেরিয়ে গেল। শুভ্র মনে ভাবল এত বেগে সাইকেল চালিয়ে হাকার দিয়ে চলে গেলে লোক বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই তো মাছ ওয়ালাকে আর দেখতে পাবে না। চোখের পলক না ফেলতেই সে ভ্যানিশ। গলার স্বর টা একটু হাই লেভেলের তাই বোঝা গেল একটা মাছ ওয়ালা গেল। ঘর এ থাকলে বাইরে এসে ওই আওয়াজ টুকুই শুনতে পাবে। মাছ ওলাকে আর পাবে না। ওদের কি করে বিক্রি হয় তাহলে কি জানি । হয়তো ধরাবাধা খদ্দের আছে। তাদের বাড়ি গুলোর সামনেই শুধু হয়তো দাঁড়ায়। এই সব ভাবতে ভাবতেই শুভ্র ব্রাশ করছিল। হঠাৎই কলিং বেল এর শব্দে শুভ্র খানিকটা চমকে উঠলো।
-শুভ্র দেখ তো কে এলো?
-মা, আমি তো দাঁত ব্রাশ করছি। তুমি খোলো।
আমিও তো চায়ের জল বসিয়েছি। তাও গ্যাসের আঁচ টাকে মিডিয়ামে করে রেখে রেণুকা দেবী গেলেন দরজা খুলতে।
- ও মা! সায়ন, পিকাই, রক্তিম তোরা এত সকালে দল বেঁধে যে? আয় আয় ঘরে আয়।
- আগে বলো আন্টি ওই কুম্ভকর্ণ টা কোথায়? বাড়িতে আছে নাকি নেই? ফোন করছি সকাল থেকে ফোনটা তোলার নাম নেই।
পিকাই এর কথার প্রত্যুত্তরে রেণুকাদেবী বললেন , হ্যা শুভ্র বাড়িতেই আছে। এই মিনিট দশেক আগে ঘুম ভেঙেছে তার। তাও কত বার ডেকে ডেকে। এখন ব্রাশ করছে। যা তোরা ঘরে গিয়ে বোস। আমি জলখাবার আনছি।
-কিরে সকাল সকাল বিনা নিমন্ত্রনে যে আমার বাড়ি চলে এলি গিলতে নাকি? ওয়াশ রুম থেকে ফিরে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে শুভ্র বললো।
-ওকি ! ও আবার কি কথা অসভ্য দের মতো।
-আন্টি , এইসব ইয়ার্কি, ঠাট্টা আমাদের বন্ধু দের মধ্যে হামেশাই চলতে থাকে।
- মা, তুমি আমাদের কিছু জল খাবার করে নিয়ে এসো।
রেনুকা দেবী চলে গেলেন রান্নাঘরে।
তারপর বল সকাল সকাল তিন মূর্তির চরণ ধূলি পড়লো আমার বাড়িতে কি ব্যাপার।
-তুই কি সব গুলে খেয়ে বসে আছিস নাকি ? না কি দিনরাত ওই শ্রেয়াকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছিস। শুভ্রর মাথায় একটা গাট্টা মেরে রক্তিম বললো।
-কি যা তা বলছিস বলতো? ওর সাথে দু- একটা কথা বলি মানেই কি ওকে আমি ইয়ে... করছি নাকি ?
-ইয়ে মানে? এ ভাই শুভ্র এই ইয়ে টিয়ে কেস টা কি বলতো? একটু ঝেড়ে কাস তো ?
-সায়ন তুই কিন্তু দেখছি এবার খুব বার বারছিস দেখছি। রান্না ঘরে মা আছে। শুনতে পেয়ে গেলে কি হবে বলতো ?
-সেই জন্যই তো বলছি মানে মানে আমাদের কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দিলে হয় না? মানে বলতে চাইছি এই ইয়ে টিয়ে কেস আদেও বিয়ে অবধি গড়াবে তো?
-তোরা না একদম যা তা হয়ে গেছিস। এবার দেখছি আমার প্রেস্টিজ এ একদম ঢিলে করে ছাড়বি।
-আরে, ইয়ার্কি ছাড়, আসল কথাটা তো আগে বলতে দে। আচ্ছা শুভ্র আজ সকাল বেলায় রথ তলা মোড়ে রবিন স্যারের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তো ? হ্যা কি না বল?
এক হাত জিভ বার করে মাথায় হাত দিয়ে শুভ্র বললো, সরি রে, পিকাই। একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
-তোকে আমরা কতবার কল করেছি একবার মোবাইল টা চেক কর।
ফোন টা হাতে নিয়ে পাসওয়ার্ড এর লক টা খুলেই ও দেখলো পিকাই, রক্তিম, সায়ন প্রত্যেকেরই নাম্বর থেকে পাঁচ টা করে মিস কল।
-এই তাহলে কি হবে? এখন যাবি?
-না, না এখন আর এত বেলায় গিয়ে লাভ নেই। বিকাল এর দিকে যাবো।
সকলেই সায়ন এর কথায় সায় দিলো।
- সবাই ডাইনিং এ চলে আয়। গরম গরম লুচি, আলুরদম একদম রেডি। বাইরে থেকে খাবারের গন্ধ ঘরের ভিতরে আসা মাত্র ই চারজনই হুড়মুড় করে এসে বসে পড়লো খেতে।
-আন্টি তুমি আলুরদম টা না হেব্বি করো। জাস্ট ফাটাফাটি।
-তোদের জন্যই তো এইসব করতে ইচ্ছা করে। তাছাড়া এখনোই তো বয়স এইসব খাওয়ার। একটু বয়স বাড়লেই ডাকরারের পরামর্শ মতো এখন এই খাওয়া বারণ, সেই খাওয়া বারণ । নিকুচি করেছে।
-আন্টি তবে তোমার কাছে আমাদের আর একটা ট্রিট বাকি রইল কিন্তু।
-কিসের ট্রিট রে পিকাই।
-আছে, কিন্তু সেটা এখনই তোমায় বলা যাবে না আন্টি।
-কিরে শুভ্র বলবো নাকি আন্টিকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে আচমকাই শুভ্র ওর পাতে থাকা একটা বড় রসগোল্লা পিকাই এর মুখে দিলো ভোরে। তখনকার মতো কথাটা ধামাচাপা পড়তে শুভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। পিকাই মুখে এর একটা গোটা রসগোল্লা দেখে সকলেই তখন হাসতে ব্যস্ত , রেণুকা দেবীও ট্রিট এর কথা গেলেন বেমালুম ভুলে।
রথ তলার মোড়ে পৌঁছে শ্রী এ দের রবিন স্যারের বাড়ি খুঁজতে একদমই অসুবিধা হলো না। যাওয়ার পথে রাস্তায় অনেক ছেলে মেয়েদের ই দেখছিল দলে দলে গল্প করতে করতে তারা ঐদিকেই যাচ্ছে।
- শ্রেয়া এত সব ছেলে মেয়েরা যাচ্ছে এরা বোধ হয় সব রবিন স্যারের স্টুডেন্ট তাই না রে?
- শ্রেয়া কৌতূহল বশত রাস্তার দিকে তাকিয়েই শ্রী কে উত্তর দিলো
- হবে হয়তো।
অবশেষে তারা একটি হলুদ দো তোলা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। বাড়ির সামনে একগাদা সাইকেল এলোমেলো ভাবে দাঁড় করানো আছে। দরজার সামনে অসংখ্য জুতোর মেলা। শ্রী আর শ্রেয়া অবশ্য সাইকেল নিয়ে আসে নি। তাদের বাড়ি থেকে রথ তলার দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাও পায়ে হেটে মিনিট পনেরো লাগে। আসার আগে শ্রেয়াই বলেছিল গল্প করতে করতে হেটেই চলে যাবো। সাইকেল নেয়ার দরকার নেই। স্যার এর বাড়ির সামনে এসে এত হইহল্লা, জুতোর মেলা, সাইকেলের পাহাড় দেখে শ্রী আর শ্রেয়ার র বুক টা ধুক পুক করছিল।
-হ্যাঁ রে শ্রেয়া এইবাড়ি টাই তো?
-হ্যা রে বাবা। সৌরভ দার কথা মতো ঠিকই এসেছি। এত ভিড় দেখে বুঝতে আর অসুবিধা নেই এটা রবিন স্যারেই বাড়ি।
-তবু একবার আশেপাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করবি?
-ধ্যাৎ, তুই এত ঢং করিস না কি বলবো।
-চল, ভিতরে চল।
-ওরে বাপরে, আমার ভীষণ ভয় করছে। এখন দেখছি বাবাকে আনলেই ভালো হতো।
শ্রী এর ন্যাকা ন্যাকা কথায় শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে উঠলো।
-কিরে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে তোরা? ভয় পাচ্ছিস না কি ?
নয়ন তারার গলার আওয়াজ পেয়ে ওরা দুজনেই চমকে গেল। দেখলো নয়নতারা ছাড়াও ওদেরই কয়েকজন স্কুলের বন্ধু বান্ধবী রবিন স্যারের বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে কেউ জুতো খুঁজতে এবং পরতে ব্যস্ত। আর কেউ কেউ সাইকেল বার করতে ব্যস্ত। তাদের দেখে শ্রেয়া আর শ্রী এর আড়ষ্ট ভাবটা অনেকটা কেটে যায়।
-স্যার কে রেজাল্ট দেখালে খারাপ নম্বর পেলেও পড়তে নেবে বলছে নয়ন ?
-ধুর....তুই সব কিছুতেই এত টেনশন নিস না তো। ফ্রেশ মনে ভিতরে যা। স্যার এত ভালো কিছুই বলবেন না। আর হ্যাঁ, পরের সপ্তাহ থেকেই স্যার আমাদের ব্যাচ স্টার্ট করে দেবে বলেছেন। স্যার খুবই যৎ সামান্য মাইনে নেন। আমাদের ব্যাচেই অনেক স্টুডেন্ট হয়ে গেছে স্যার বলছিলেন। আর হয়তো বেশি জনকে নেবে না। তাড়াতাড়ি যা ভিতরে। পিছনে আরো সব স্টুডেন্ট আসছে। নয়নতারার কথায় তারা বেশি দেরি না করে ভিতরে ঢুকলো। ঘরের ভিতরটা বেশ বড়। একদিকে একটা সোফা আছে। সেখানেই একপাশে স্যার বসে আছেন। তাঁর পাশে পুরো সোফাটা জুড়ে বই খাতায় ভর্তি। আর সোফার সামনে থেকে মেঝেটা শতরঞ্জি পাতা আছে।কিনতু কেউই বিশেষ বসে নেই। স্যারকে ঘিরে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে মেয়েদের দাঁড়ানোর ফাঁক দিয়ে শ্রী ও শ্রেয়া স্যারকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রথমেই সামনে যেতে সাহস পাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে ভিড় টা একটু কম হতে তারা স্যারের মুখোমুখি হলো। এইসময় টা শ্রী এর মনে হচ্ছিলো যেন সব কিছু ছেড়ে এক ছুটে এখান থেকে পালাই।
-তোমাদের বাড়ি কোথায়?
রবিন স্যারের গম্ভীর অথচ অমায়িক গলার স্বরে শ্রী মৃদু কণ্ঠে বললো, লিচুতলায় স্যার।
- দুজনের ই?
দুজনেই মাথা অবনত করেই ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
- ওহঃ তাহলে তোমাদের মধ্যেই কারোর একজন বাবা আমার সাথে দেখা করে গিয়েছিলেন।
শ্রী আবারো মৃদু স্বরে জবাব দিলো। আমার বাবা স্যার।
এরপর দুজনেই তাদের রেজাল্ট দুটো স্যারের হাতে আগিয়ে দিলো।স্যার রেজাল্ট দেখে তেমন কিছু বললেন না। শুধু দুই জনের নাম জিজ্ঞাসা করলো।
- স্যার আমার নাম শ্রীলতা মজুমদার।
- আর আমার নাম শ্রেয়া চক্রবর্তী।
-তোমার বাবা তাহলে কি করেন শ্রেয়া?
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ