আগের পর্ব পড়ুন
নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১২
চৈতি দেবীর উত্তেজনামূলক কথায় শ্রী আরো রেগে গেল। তড়িঘড়ি প্রণতি আন্টির ঘর থেকে বেরিয়ে ঠোঁট বেকিয়ে বললো, হ্যা, কতটা উতলা হয়েছিলে তা বোঝাই যাচ্ছে। এ কথা বলেই শ্রী মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো। শ্রী এর সাথে প্রণতি আন্টিও ওর পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি শ্রী কে খানিকটা ধমকের সুরে বললেন, শ্রী ঐভাবে কেউ মায়ের সাথে কথা বলে? তোমার মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো তো উনি কতটা চিন্তায় ছিলেন।
- সত্যি বলছি প্রণতি দি, শ্রী আজকাল আমার একটাও কথা শোনে না। মুখে মুখে তর্ক করতে শিখেছে। কথায় কথায় আমায় ভুল বোঝে। আচ্ছা আপনি ই বলুন মায়েরা কি কখনো সন্তানের খারাপ চায়? আমি ভাবছি এই হয়তো আসবে কলিং বেল বাজাবে। ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম। মন দিয়ে দেখতেও পাই নি। খালি ঘড়ি দেখছি।
- আহঃ কলিং বেল যে কদিন ধরে খারাপ হয়ে বসে আছে সেই টুকু হুশ নেই তোমার? কিছুটা ব্যাঙ্গের স্বরে শ্রী বললো তার মাকে।
- ইস রে...আমি একদম ভুলে গেছি। তুই আসছিস না দেখে আমি আবার শ্রেয়া কে ফোন করলাম। ওকে একটা ফোন করে বলে দিস চলে এসেছিস।
- আসি গো প্রণতি দি। খুব ভালো করলে গো আমায় ফোন টা করে।
একগাল মিষ্টি হেসে শ্রীও প্রণতি আন্টিকে টাটা করে চলে গেল মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে।
-হ্যালো, শ্রেয়া
-হ্যা, বল। এতক্ষণ কোথায় ছিলিস? তোর মা আমায় ফোন করেছিলেন।
-আরে, ব্যস্ত হোস নি। তোর শুভ্র কে নিয়ে পালিয়ে যাই নি। ওই রকম বেইমানি আমি আমার বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে কখনোই করবো না।
-তুই সবসময় খালি ওকে নিয়ে আমায় রাগাস। এইরকম সব সময় বললে আমি তোর সাথে একদম কথা বলবো না।
-আরে, চটছিস যে বড়? আমি কি শুধু একা রাগাই। পড়ার ব্যাচের সবাই তো ঐরকম করে।
-ও সব ছাড়। কোথায় ছিলিস বল? চিন্তা তো আমার ও হচ্ছিল । আন্টির কাছ থেকে ফোন টা পেয়ে।
-আরে, মা ভেবেছিল আমি আসলে কলিং বেল বাজাব, ওটা যে খারাপ হয়ে পড়েছিল সেটা খেয়াল নেই। ফোন ও ছিল না যে ফোন করবো। তাই পাশের বাড়ির প্রণতি আন্টির বাড়ি থেকে ফোন করলাম।
-ওহ, তাই বল। আমি ভাবলাম কি জানি কি হলো।
- হ্যা রে, শ্রেয়া নতুন স্যারের সাথে দেখা করে এলি কেমন লাগলো স্যারকে? স্যার কি বললেন?
- কি আবার বলবে মা, রেজাল্ট দেখলেন। আর পরের সপ্তাহে মঙ্গল বার থেকে ব্যাচ শুরু হবে বললেন।
- আর, মাইনে পত্রর কথা কিছু...
- না, মা নেবেন না বললেন।
একথা শুনে আশা দেবী দু হাত জড়ো করে কপালে তুললেন। বেশ প্রসন্ন হয়ে হাসি মুখে বললেন , যাক এতদিনে ঈশ্বর আমাদের ওপর মুখ তুলে চাইলেন। আশা দেবীর এইরূপ প্রশান্তিপূর্ণ আচরণে শ্রেয়ার মুখে বিরক্তির ছাপ প্রকোট হয়ে উঠলো। ও মায়ের পাশ থেকে সরে জানালার ধারে এসে দাড়ালো। এই খান থেকে তাদের গলির রাস্তাটা খুব ভালো ভাবে দেখা যায়। এখানে ও সন্ধের দিকটা রোজই বসে। এক কাপ চা একটু মুড়ি মাখা, বা চিড়ে ভাজা নিয়ে। ল্যাম্প পোস্টের স্হির আলোর দিকে নীরবে চেয়ে চায়ে এক- দু চুমুক দেয়। নিজের অজান্তেই এক খাবল করে মুড়ি মুখের ভিতর চালান করে। কুকুর গুলো জটলা দিয়ে একে অপরের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত সেইসব উপভোগ করে। তাদের কামড়াকামড়ি, একে অপরের গা চাটা দেখে নিজের খেয়ালই হেসে ওঠে। পাশের বাড়ি র টিভি সিরিযালের শব্দ তার কানে ভেসে আসে। শ্রেয়া টিভি দেখতে অভ্যস্ত নয়। বরং তার চেয়ে শরৎ, রবি ঠাকুর, কিংবা সুনীল, বুদ্ধদেবে ই ডুবে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু আশা দেবীর এতে চরম আপত্তি। শ্রেয়ার গল্পের বই এর প্রতি এইরূপ ঝোঁক দেখে তার মাঝে মাঝে রাগ হয়। কিন্তু এই রাগের কারণ টা কি সে ঠিক বোঝে না।
আজ ও শ্রেয়া খানিক্ষণ জানালার ধারে বসে চা খেয়ে সন্ধ্যে বেলায় সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসেছিল।শ্রেয়া কে দেখেই আশাদেবীর মনে চাপা ক্ষোভ ধেয়ে আসে।
- শ্রেয়া, সন্ধ্যে বেলা পড়ার বই ছেড়ে গল্পের বই নিয়ে কেন বসেছিস?
বই থেকে মুখ না সরিয়েই একটা পাতা উল্টে মা এর দিকে না ভ্রূক্ষেপ করে ও বলে, এটা গল্প বই না মা,এটা একটা উপন্যাস এর বই।
-রাত দিন ওসব পড়তে তোকে নিষেধ করেছি শ্রেয়া। কাল থেকে তোকে আর লাইব্রেরি যেতে হবে না।
বই খানা সজোরে বন্ধ করে শ্রেয়া রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মা আমি পড়ার বাইরের কিছু বই পড়লে তুমি ঐরকম কেন করো বলো তো?
-জানি না। - এই বলে আশাদেবী শ্রেয়ার ভাবমূর্তি দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন। শ্রেয়া দ্রুত বিছানা ছেড়ে এসে তার মায়ের হাতটা ধরলো, আশাদেবীর মনে একটা অজানা আশঙ্কা তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরলো।
-মা, তোমায় আজ বলতেই হবে।
-সে অন্য আর একদিন না হয় বলবো।
-তোমার দিব্যি মা , আমি শুনতে চাই।
তীব্র ধমকের স্বরে আশা দেবী বললেন, এখন আবার কথা য় কথায় দিব্যি ও দিতে শিখেছিস তাই না?
- তুমি যতই প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করো। আমি আজ কারণ টা শুনেই তারপর তোমায় ছাড়বো।
আশা দেবী আর থাকতে না পেরে - বিছানার উপর উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন , ওরে, তোর বাবাও যে গল্প বই না দেশ বিদেশের বই, নানারকম বই পড়তে ভালোবাসতেন । ওই বইই এর জন্যই ধীরে ধীরে আমার সাথে তোর বাবার দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
-মা, কি সব আবল তাবোল বকচ বলতো? বই কখনো সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
অত্যন্ত জোর গলায় আশা দেবী বললেন - হ্যা পারে, একশো বার পারে। শ্রেয়া কৌতূহল পূর্ণ মুখে আশা দেবীর অশ্রু সজল দৃষ্টির দিকে একভাবে চেয়ে রইলো।
তখন আমি স্কুলে ফাইনাল ইয়ারে পড়তাম। হটাৎ স্কুল থেকে এসে দেখলাম আমাদের পাশের বাড়ির ললিতা কাকিমা, আর মা মিলে খুব আড্ডা দিচ্ছে। আমায় দেখেই ললিতা কাকিমা আমার মায়ের হাতে একটা চিমটি কাটলো। ঘরে ঢোকার মুহূর্তে আমি আর চোখে দেখলাম। ভেবেছিলাম নিজেদের কথার প্রসঙ্গেই হয়তো । সেদিন মা আমায় বললেন, মুখ-হাত-পা ধুয়ে নে আশা। খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। খেয়ে- দেয়ে এখানে একবার আসিস। তোর ললিতা আন্টি তোকে কি সব বলবে বলছেন। আমি তখন দরজা বন্ধ করে স্কুলের ইউনিফর্ম টা ছাড়ছিলাম। হাক দিয়ে বললাম, ঠিক আছে মা। তারপর খেয়ে দেয়ে মা - আর ললিতা কাকিমা যেখানে আড্ডা দিচ্ছেলেন সেখানে এলাম।
- কি বলবে বলছিলে বলো ললিতা কাকিমা। আমি আবার এখুনি বিশাখা দের বাড়ি যাবো দরকার আছে।
- সে দরকার পড়ে হবেখুনি। এখন দু-দণ্ড একটু স্হির হয়ে বোস। তোর সাথে কিছু কথা আছে।
- কি কথা ?- আমি বেশ ছটফট করছিলাম। ভাবছি কখন ললিতা কাকিমার কথা বলা শেষ হবে, আর আমি এক ছুট্টে বিশাখা দের বাড়ি যাবো।
- আমার অস্থিরতা দেখে ললিতা কাকিমা বললেন, আজ -বাদে কাল বিয়ে হবে এখনো ধীনগী পোনা গেল না দেখছি।
তার কথা শুনে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বেশ এক রাশ রাগ নিয়ে বসলাম।
- বলি, মেঘে মেঘে তো বেলা অনেক হলো।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। হা করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-মানে বলছি বয়স তো অনেক হলো। এবার তো বিয়ে থা করতে হবে নাকি ? না বই -খাতা য় সব সময় মুখ গুজে থাকলেই চলবে।
সেদিন ললিতা কাকিমার কথা শুনে আমি এক মুহূর্তের জন্য হলেও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এর আগে আমায় বাড়ির কেউই এইরকম ভাবে আমার বয়স নিয়ে খোটা দেয় নি। তাছাড়া তখন আর কতই বা বয়স সবে আঠেরোয় পরেছি। ললিতা কাকিমার কথা শুনে আমার চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে এলো। সেদিকে লক্ষ্য করেই মা বললেন, আরে, দেখো মেয়ের কান্ড বিয়ের কথা শুনেই চোখে জল চলে এলো। সবে তো ললিতা কাকিমা বিয়ের একটা সন্মন্ধ এনেছে। তা বলে এখনই কি বিয়ে হচ্ছে? দু- পক্ষ আগে দেখুক মতের মিল হোক তারপর তো।
- কিন্তু মা, আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।
- বেশ তো। বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।কথা তেই আছে লাখ কথার কমে বিয়ে হয় না। আচ্ছা, তুই যা যেখানে যাচিলিস।
মায়ের অনুমতি পেয়ে সেদিন এক ছুট্টে বিশাখাদের বাড়ি না গিয়ে ঘরে ঢুকে খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু তার মাস দুয়েকের পরেই ললিতা কাকিমা আমার জন্য ছেলের বাড়ির লোকজন কে নিয়ে আসে। লোকজন বলতে তোর ঠাম্মা, আর তার একজন ভাই মানে আমার মামাশশুর। তারা এক বার দেখেই আমায় পছন্দ করেন। মা এরও তাদের দেখে খুব ভালো ই মনে হয়েছিল। আমার ওপরে তোর বড় মামা, আমার ভাই মানে তোর ছোট মামা তখন নাইনে পড়তো। সুতরাং বাবার পক্ষে এই তিন জন এর ভরণ পোষণ , পড়াশোনা সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না।
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ