ভুল সিদ্ধান্তে অনিশ্চিত জীবন
আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টার অপেক্ষা। ভোরের আলো ফুটলেই ঝিমপুর থানা থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কোর্টে। অপরাধের সাজা ঘোষণা হবে আদালতে। আমার বারো বছরের কনস্টেবল জীবনে এই প্রথম লক্ষ্য করলাম কোনো আসামী আদালতের চূড়ান্ত সাজা ঘোষণার আগের রাতে ও এতটা উদাসীন, ভাবলেশহীন হয়ে কিভাবে থাকতে পারে।
রাত্রিকে অবশ্য আমরা গ্রেফতার করে নি। ও নিজে এসেই আত্মসমর্পণ করেছিল দিনপনেরো আগে। গত ৪ঠা মার্চ মধ্যরাতে একজন যুবতী বিধ্বস্ত রক্তমাখা অবস্থায় হন্ত দন্ত করে থানায় পা রাখা মাত্রই জ্ঞান হারায়। প্রাথমিক চিকিৎসায় তার জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তার জবানবন্দির ভিত্তিতে তার ঠাঁই হয় এই জেলখানায়। তিনি ই হলেন আগামী কালের সাজাপ্রাপ্ত আসামী রাত্রি। রাত্রি ঘোষ। তার থেকেই শুনেছি তার জীবনের মর্মান্তিক, করুন কাহিনী।
বছর চব্বিশের মেয়ে রাত্রি। সম্প্রতি এম.এ পাশকরেছে। বাবা ,মায়ের একমাত্র সন্তান । বাবা সরকারি কর্মচারী। মা একটি স্বেচ্ছা সেবী সংস্থার সাথে যুক্ত। কলেজে পড়াকালীন রাত্রির সাথে অরণ্যের বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পূর্ণতা পায়। অরণ্য ছিল রাত্রির কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। বন্ধুত্ব থেকে এই সম্পর্ক যখন প্রেমে পরিণতি পায় তখন রাত্রির চলন, সাজগোজ, পোশাকের আমূল পরিবর্তন কিছুই তার মা অনিলা দেবীর দৃষ্টি এড়ায় নি। আর রাত্রীও কখনও তার মাকে লুকিয়ে কিছু করার পক্ষপাতী ছিল না। সুতরাং মায়ের চোখে ধরাপড়ার সাথে সাথেই তার আর অরণ্যের সম্পর্কের কথা অনিলা দেবীকে নির্ভয়ে বলে দেয় সে। মেয়ের এরূপ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তিনিও খুশি ই হয়েছিলেন। এবং রাত্রির থেকে অরণ্যের বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে রসিকতা করে ই রাত্রিকে বলেছিলেন কাজের ফাঁকে যদি সময় পায় কখনো তাহলে হবু জামাইয়ের বাড়ি ঘুরে আসবেন। আসলে রাত্রি ও তার মায়ের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক ছিল তা হলো বন্ধুত্ব। কিন্তু এই বন্ধুত্বের ইতি ঘটতেও বেশিদিন সময় লাগে নি। রাত্রি র থেকেই জেনেছি-
দিন পনেরো আগে রোজকার দিনের মতো অনিলাদেবী সংস্থার অফিসিয়ালি কাজ গুলো সেরে বৈকাল ৪টে নাগাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় বাড়ির উদ্দেশে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও বাসের পাত্তা না পেয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন অরণ্যের বাড়ি যেহেতু এই এলাকাতেই তাই ওর ঠিকানায় খোঁজ করে একবার ওনাদের বাড়ি গিয়ে আলাপ পরিচয় টা সেরে আসবেন।
অগত্যা অনিলা দেবী পিচ রাস্তা পেরিয়ে সিমেন্টের বাঁধানো রাস্তার মোড়টার সামনে একজন যুবকের কাছে গুরুপ্রতাপ পাল মানে অরণ্যের বাবার নাম টা বলতেই সে ইশারায় দুটো বাড়ির পর একতলা হলুদ বাড়িটি দেখিয়ে দেয়। বাড়ির সামনে এসে অনিলাদেবী সদরের গেট টা খুলে ডোর বেল বাজাতেই একজন ষাট উর্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ইনিই অরণ্যের বাবা। কিন্তু ঘরে ঢোকা মাত্রই ঘরের বেহাল অবস্থা দেখে অনিলাদেবী রীতিমতো ঘাবড়ে যান । কাঁচ বিহীন ড্রেসিং টেবিল, বেসিনের অংশ ভাঙা, টেবিল চেয়ারের অবস্থাও খুব শোচনীয়।একটা চেয়ারে বসতে বলে অরণ্যের মা মলি দেবী শরবত আনতে রান্নাঘরে যান। এরপর নিজের পরিচয় টা দিয়ে কথায় কথায় রাত্রির সাথে তাদের ছেলের প্রণয়ের প্রসঙ্গ তোলেন অনিলা দেবী। যদিও অরণ্য সেইসময় বাড়ি ছিল না। মলীদেবী চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের কুলাঙ্গার ছেলের অপকাহিনী শোনাতে থাকেন। অরণ্য এর কলেজ পাশ করার পর থেকেই তার স্বভাবের বিপুল পরিবর্তন ঘটে। সে প্রতিরাতে আড্ডা দিয়ে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। বাবা, মাকে গালিগালাজ দেয়। সদ্য রিটায়ার্ড বাবার গায়ে হাত তোলে। শুধু মদ ই নয় গাজা, ড্রাগেও সে আসক্ত। এখানেই শেষ নয় । বেশ কয়েক বার মেয়েদের শীলতাহানির অভিযোগে তাকে থানা তেও নিয়ে যায় পুলিশ।
এইসব শুনে অনিলাদেবী শংকিত, ও আশাহত হয়ে বাড়ি ফেরেন রাতে। বাড়ি ফিরে আসা মাত্রই রাত্রিকে ওবাড়ির অবস্থা, ও অরণ্যের ঘৃণ্য মানসিকতার কথা বলে তাকে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেন। রাত্রির তখন তার মায়ের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় নি। তখন তো সে ভালোবাসার মোহে পুরোপুরি অন্ধ। তাই বন্ধুর মতো মাকেও সে সন্দেহ করতে ছাড়ে নি। তার মনে হয়েছিল তার মা হয়তো সব কিছুই মিথ্যে, সাজিয়ে বলেছে। তার প্রেমের গভীরতা তখন তার মায়ের ভালোবাসার চেয়েও অধিক। সেইদিন রাতেই রাত্রি অরণ্যের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মতো অরণ্য কে ফোন করে রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে যায় নতুন সুখের খোঁজে।
তারপর অরণ্য কাছাকাছি একটি মন্দিরে গিয়ে রাত্রিকে বিয়ে করলেও সেই রাতে বাড়ি নিয়ে যেতে চায় নি। শেষ পর্যন্ত তারা এক হোটেলে রাত টা কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হোটেলেই যে তার বিপদ আগে থেকে লুকিয়ে ছিল তা সে বুঝতে পারে নি। ভাবতেও পারে নি অরণ্যের ভালোবাসার উল্টোপিঠে কি ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতার রূপ লুকিয়ে আছে।
হোটেলের ঘরে ঢুকেই রাত্রি প্রথমেই ওয়াশ রুমে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আর সেখান থেকেই শুনতে পায় ফোনে কথোপকথনে অরণ্যের জঘন্য পরিকল্পনার কথা। রাত্রি ওয়াশরুমে দরজায় কান পেতে শোনে অরণ্য তাকে হোটেলে নিয়ে এসেছে ২লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে সদ্য সিঁদুরে রাঙা স্বপ্ন ছারখার হয়ে যায়। প্রথমে সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই মুহূর্তে নিজের মায়ের সাবধান বাণী বার বার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সে কত টা ভুল পথে চালিত হয়েছে।
তৎক্ষতাৎ রাত্রি নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে সংকল্প করে তার মতো আর কোনো মেয়ের ভালোবাসা, অন্তর নিয়ে যাতে অরণ্য এইরকম না করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এসে টেবিলে থাকা কাঁচের জাগ দিয়ে সজোরে পিছন থেকে মারে অরণ্য কে। মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত অরণ্যের শরীর টা মাটিতে লুটিয়ে পরে মেঝেতে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে চুরিদারের ওড়না দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে , সেই রাতেই সিঁথিতে রাঙা সিঁদুর নিজের হাতে মুছে থানায় আত্মসমর্পণ করে সে।
কাল আদালতে তার শাস্তির শুনানি। তবু তার মধ্যে কোনো অনুশোচনার লেশ মাত্র চোখে পড়লো না। শুধু এটুকুই তার বক্তব্যে ফুটে উঠলো-' আমি রক্ষা করেছি অনেক মেয়ের প্রাণ, ভালোবাসা, তাদের মন। নাহলে এইরকম নরোপিশাচের হাতেই দিনের পর দিন শেষ হতে হতো অনেক প্রাণ। আমি কোনো ভুল করি নি।চাই মহামান্য আদালত ও আমায় উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই আমায় দোষী সাব্যস্ত করুক। মায়ের স্নেহ, বন্ধুত্ব কে তুচ্ছ করে যে মেয়ে ভালোবাসার মোহে ঘর ছাড়ে তার শাস্তি হওয়া টাই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।

1 মন্তব্যসমূহ
2E5C3C4C59
উত্তরমুছুনTakipçi Satın Al
Whiteout Survival Hediye Kodu
Coin Kazanma
Pokemon GO Promosyon Kodu
Avast Etkinleştirme Kodu