ফিরে পেলাম বৃদ্ধাশ্রমে


I got back to the old age home ফিরে পেলাম বৃদ্ধাশ্রমে

ফিরে পেলাম বৃদ্ধাশ্রমে

নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে জাত, বর্ণ, ধর্মের দোহাই দিয়ে সত্যিই কি বলি দেয়া উচিত? কি জানি জীবন অপরাহ্নে উপনীত হয়েও এর উত্তর খুঁজেছি বহুবার কিন্তু ব্যর্থই হয়েছি বারবার। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আমি যখন একাদশ শ্রেণীতে পাঠরতা আমার মনের দরজা তেও টোকা দিয়েছিল এক উচ্চ বর্ণের ভালোবাসা। আমি ছিলাম, সমাজের দৃষ্টি তে যাকে বলে গোদা বাংলায় নিচু ঘরের মেয়ে। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা, আর সমাজে বসবাস কারী নানা মানুষের ভিন্নধর্মী মতামত - এই দুইয়ের দ্বন্ধে হকচকিয়ে গেলেও সমাজের বিধান কতটা মানুষের বাচা মরার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত - তা পারিপার্শ্বিক ঘটনার মাধ্যমে ভালোই অবগত হয়েছিলাম। 

তবুও সেদিন সূর্য দার প্রেম নিবেদনে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি নি। ও তখন সদ্য কলেজ পাশ করেছে। আমরা প্রায় পাশাপাশি পাড়া তেই থাকতাম। উচ্চ বংশের সন্তান  হওয়ায় প্রথম দিকে তার এই ভালোবাসা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।হয়তো ওর নিষ্পাপ ভালোবাসার মধ্যে ছিল গভীর নির্মলতার প্রলেপ, সুতরাং তার ভালোবাসায় সাড়া না দেয়ার উপায়ও ছিল না। তাই সমাজের সমস্ত রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে গিয়েও এক  অমোঘ ভালোবাসার সৃষ্টির নেশায় মত্ত হয়েছিলাম দুজনেই। কিন্তু এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত পরিণয়ে সমাপ্তি ঘটে নি। অসমাপ্ত ই রয়ে গেল আজ ও জাত, ধর্মের বিদ্বেষ এ। 

সূর্য দার বাড়ি থেকে এই সম্পর্ক কখনই মান্যতা পায় নি। আজ ও স্মৃতিতে অম্লান সেই দিনের ঘটনা - সূর্য দা আমায় তার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল মাসিমা অর্থাৎ তার মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। কি নির্মম, চরম অপইমানের শিকার হয়েছিলাম সেইদিন - কাটা ঘায়ের মতো আজ ও তা দগদগে অক্ষত। শুধু মাত্র নিচু জাতের মেয়ে আমি এই কারণেই ওই বাড়িতে সামান্য জল পর্যন্তও গলা দিয়ে আমার নামে নি মানে খেতে দেয় নি। আর আমি যেন কখনো সূর্য দার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখি এমন হুঁশিয়ার পেয়ে বুকভরা লজ্জা আর আঘাত নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। তারপর আর কখনোই ওই উঁচু মানুষের ধারে কাছে আমি যাই নি। 

এই ঘটনার পর পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে আমায় নিয়ে কানাঘুষা, ব্যঙ্গ রঙ্গ তামাশা - কোনো কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ায় নি। আর সূর্য দার সঙ্গেও কোনোদিন শেষ বারের জন্যও দেখা করার বাসনা মনে জাগে নি। তবে ওর প্রতি আমার অনুরাগ আজ ও চিরন্তন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা য় পাশ করার সাথে সাথেই বাবা, মা সমেত আমরা চলে আসি কলকাতায়। বাবা যদিও আগে থেকেই চাকরিসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। সপ্তায় একদিন গ্রামে আসতেন। তবে ওই ঘটনার পর আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি আমার মানসিক হেনস্তার শোচনীয় অবস্থা সহ্য করতে না পেরে মা -ই সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে আর না থাকার। তারপর থেকেই কলকাতাতেই গড়ে ওঠে আমাদের আস্তানা। স্কলারশিপ পেয়ে কলেজ পাশ করার কিছু পরেই সরকারী স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে যাই। বাবাও ইতিমধ্যে রিটায়ার্ড করেন। দেখতে দেখতে পঁয়ত্রিশ টা বসন্ত গেছে পেরিয়ে। ছাদনা তলায় বসার শখটা কবেই গেছে মন থেকে মিলিয়ে। বাবা, মা ও কখনো এই বিষয়ে চাপ আমায় দেয় নি। 

বাবার জমানো কিছু সঞ্চয়, আর রিটায়ার্ড মেন্টের পর পাওয়া কিছু অর্থ এবং আমার কিছু পুঁজিতে 'শান্তির নীড়' প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি একটি বৃদ্ধাশ্রম। এই মহান উদ্যোগের চিন্তা আসে মায়ের মস্তিস্ক থেকেই। বৃদ্ধাশ্রমে আগত ঠাকুমা, ঠাকুরদা, মাসিমা ,মেসো দের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্যে আমরা তিনজনই চাই বাকি জীবনটা হেসে খেলে  কাটিয়ে দিতে। সন্তান সন্ততি ছেড়ে বৃদ্ধ মানুষ গুলোর মধ্যে একটুকরো রোদেলা আলো আর এক পশলা বৃষ্টিতে তাদের হৃদয়কে ভাসিয়ে দিতে আমাদের আপ্রাণ মন সদা সচেতন। এই বৃদ্ধাশ্রম দেখাশোনার জন্য সেইরকম কোনো কাজের লোক রাখা হয় নি। আমাদের সাথে বহুদিন ধরে থাকা মিনুপিসি আর আমরা তিন জন মিলেই বৃদ্ধাশ্রমের সমস্ত ভারবহন করি পরোমানন্দে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটা নাগাদ  'শান্তির নীড়' এর গেটের বাইরে একটি লাল  গাড়ি এসে দাঁড়ায়। যদিও এটা মিনু পিসির থেকে শুনেছি। গাড়ি থেকে নামিয়ে একজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে আর একজন কমবয়সী মহিলা টানতে টানতে নিয়ে আসে এখানে। আর একজন পরুষ মানুষও ছিল অবশ্য। বৃদ্ধার চোখে তখন ও অশ্রুধারার রেখা প্রবাহমান। আমি বাড়ি ফেরা মাত্রই মিনুপিসি ঝাউ ঝাউ করে সমস্ত ব্যাপার টা বলতে থাকে-' জানো দিদিভাই বৃদ্ধা মহিলাটিকে যারা রাখতে এসেছিল বৃদ্ধার সম্পর্কে বৌমা আর ছেলে। বৌমা টা এখনে এসেও শ্বাশুড়ি মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ কোরে তার জামাকাপড় ভর্তি ব্যাগ টা ছুড়ে ফেলে রেখে , আমাদের এখানে রাখার অফিসিয়ালি কাজ গুলি সেরে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। আর সাথে থাকা পুরুষ মানুষ টা বৃদ্ধার ছেলে। সে তো একপ্রকার গো-বেচারা যাকে বলে ।করুন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে  চলে গেল বউ এর পথ অনুসরণ করে।

মিনু পিসির কথায় মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। চটপট ফ্রেশ হয়ে দ্রুত পা বাড়ালাম , শান্তির নীড়ের দিকে। তিন নম্বর রুমে ঢুকে ওই বৃদ্ধা কে দেখা মাত্রই বুকের ভিতর টা বিদ্যুত চমকানোর মতো চমকে উঠলো। এতবছর পার হয়ে গেলেও, আর একবার ই মাত্র জীবনে দেখা হলেও ভুলতে পারি নি তাঁকে। সেই একই চেহারা, শুধু বয়সের ভারে চুলে পাক ধরেছে , চামড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকানো হয়েছে মাত্র। ইনিই সূর্য দার মা। যিনি সতেরো বছর আগে আমায় জাত ধর্মের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমায় জল টুকু প্রদান না করিয়েই বিতাড়িত করেছিলেন বাড়ি থেকে।

মাসিমা অকস্মাৎ আমায় দেখা মাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে আমায় জড়িয়েধরে বলতে থাকলো-' বড়ো স্বাদ করে অনেক আশা নিয়ে ছেলে মানুষ করেছিলাম জানো তো মা। দেখেশুনে ধর্ম মেনে বিয়েও দিয়েছিলাম। পোড়া কপালে নাতি নাতনির সাথে আনন্দ করা আর জুটলো না। আজ বৃহস্পতি বার ওরা আমায় ভরদুপুরে টেনেহিজরে বাড়ি থেকে বার করে এখানে রেখে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছে মা। এক গ্লাস জল দেবে?' চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে পরম যত্নে নিজের হাতেই জলটা দিলাম খাইয়ে। সতেরো বছর আগের পুরোনো সেই সব স্মৃতি ,এই নিচু বর্ণের মেয়ের অবয়ব সম্পূর্ণ টাই গেছেন ভুলে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। স্বপ্নলোকে যে মানুষটি স্বামী রূপে বিচরণ করেছিল কৈশোরে সে আজ অন্য নারীর অধিকার। তবু মাতৃ রূপে আজ যাকে ফিরে পেলাম তিনি আমার জীবনে অসীম পূর্ণতার পাহাড়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ