বাড়ি ফেরার সেই রাতে
একপশলা বৃষ্টিতে মাটিতে পুরোপুরি প্রাণ না ফিরে এলেও অধভেজা মাটির শোধা গন্ধে মনটা ভোরে গেল গোপালের। বুক ভরে প্রকৃতির সৌরভে সে নিজেকে আরো প্রাণবন্ত করে নিলো। মনে মনে ভাবল গোপাল, এ যেন অক্সিজেন এর বিকল্প রূপ। বেশি দিন শিক্ষার মধ্যে সে নিজেকে অবশ্য আবদ্ধ রাখতে সে পারেনি। তবু পদার্থ বিদ্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের কিঞ্চিৎ মাত্র সুযোগ হয়েছিল বৈকি। সেই সুবাদেই অক্সিজেন শব্দ টা সম্পর্কে কিছুটা অভিজ্ঞান তার আছে বলা যেতে পারে।সে যাই হোক আধ ভেজা মাটির শোধা গন্ধে অর্ধভজনে পূর্ণ গোপাল, বাড়ি ফিরেই সদর দরজার পাশে বেড়ে ওঠা অর্ধ বয়স্ক পেয়ারা গাছ টার গায়ে সাইকেল খানা হেলান দিয়ে রেখেই হনহন করে ঘরে ঢুকলো।
এই অসময়ে ঘরে ঢুকতে দেখে গোপালের বউ সরলা, উৎকণ্ঠায় চেঁচিয়ে রান্না ঘর থেকেই জিজ্ঞাসা করলো-" হ্যাঁ গো শরীর টরির খারাপ হলো নাকি? কি হয়েছে? কি গো বাক্কি করছো না যে বড়ো? ঘরের ভিতর জিনিসপত্র ফেলে ছড়িয়ে কি করছো? মুখে কুলুপ আটলে না কি"? একটুতেই অকারণে বেশি কথা, আর কৌতূহল দুটোই সরলার চরিত্র, ব্যাবহার দুটোকেই কুলষিত করে। এলোপাথাড়ি কথার বর্ষণ সহ্য করতে না পেরে গোপাল ঘর থেকেই গলা খাকরি দিয়ে বলে " ভাঙা ক্যাসেডের রেকর্ডিং টা এবার বন্ধ করো তো"। আবার নিজের খেয়ালে বলতে থাকে গোপাল, "ঢং এর গিন্নি হয়েছে , দরকারী জিনিস গুলো যে হাতের কাছে গুছিয়ে, সাজিয়ে রেখে দেবে তা নয় সারাদিন শুধু হেঁসেলেই পরে আছে, আর বকর বকর করে যাচ্ছে।"গোপালের এইরূপ গজরানি শুনতে পেয়ে সরলা পিড়ি ছেড়ে উঠে , হাতটা কাপড়ের আঁচলে মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে রণমূর্তি ধরে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই তুলকালাম-
সরলা : বলি, যদি মুখে কুলুপ এঁটেই থাকো তা বুঝবো কি করে তোমার কোনটা চাই, না চাই। আর এই ভরসন্ধে বেলায় তাসের আসর ছেড়ে চললেই বা কোথায়? শরীর যে চনমনে আছে , তা তো ফিটফাট সাজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
গোপাল : সে বলবো পরে।সারপ্রাইজ আছে। আগে আমার হাত ঘড়ি টা কোথায় আছে এনে দাও দেখি। আলমারি থেকে হাতঘড়ি তা বার করে দিয়ে গোপাল কে শুধায়
সরলা : "ওসব সারপায়িজ ওতো শত আমি বুঝি না। কিগো -আমার পিকুর কিছু খবর নাকি? বলছো না কেন? বলো না? কিচ্ছু টি লুকোবে না বলে দিলাম। এই আমার মাথার দিব্যি রইলো। অগত্যা-
গোপাল: আচ্ছা, ঠিক আছে সারপ্রাইজ তুলে নিলাম। ( পিকুর কথা মনে পড়ায় সরলার জলে চোখ ছলছল করছিলো মুছে দিলো গোপাল)। পিকু ফোন করে বললো, ও রাত ৯:৪০ এর ট্রেন টায় আমাদের কদমপুর স্টেশনে নামবে। ওকে আনতে যেতে হবে। শুনে সরলার আনন্দে চোখে আবার জল চলে এলো। কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো -" পিকু টা ঠিক তোমার মতোই হয়েছে। সব কিছু তেই সারপায়িজ। মেয়ে রা মায়ের মতো হয় না। বাবার মতোই হয়। না না! আর কথা বাড়াবো না। দেরি করো নাগো পিকুর বাবা। তাড়াতাড়ি রও না দাও। স্টেশন পৌঁছাতে তো তোমার প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লেগে যাবে। মেয়ে টা ও যে কি না।" খানিক টা আনন্দে ,কিছুটা উৎকণ্ঠায় সরলা বলতে থাকে - "পিকু ভাবছে বেঙ্গালুরুর মতোই হয়তো ওদের গ্রাম টা ও উন্নত হয়ে গেছে। রাতবিরেতেও লোক এর আনাগোনা থাকবে। আসবে যখন ঠিক করেছে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে তাহলে বেলাবেলি আসতে পারতো তো"। ঘড়ি তে প্রায় ৮ টা বাজে। গোপাল সাইকেল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পিকুকে আনতে। সদরে দাঁড়িয়ে "দুগ্গা দুগ্গা" তিন বার আওড়িয়ে সরলা ঘরে ঢুকলো।
সাইকেল নিয়ে মাটির রাস্তা পেরিয়ে পিচ রাস্তায় এসে দাঁড়ায় গোপাল। সাইকেল টা রেখে বাস ধরবে, কিংবা অটো, টোটো যা হোক কিছু। কিন্তু এত রাতে কোনো কিছুরই পাত্তা না পেয়ে অগত্যা সাইকেলে চেপেই স্টেশন এর উদ্দেশে এগোয়। রাস্তায় একাকী সাইকেল চালাতে চালাতে সে ভাবে নিজের পড়াশোনা টা বেশিদিন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নি । কিন্তু বিদ্যাবতী মেয়ে আমার সে শখ পূরণ করেছে। সামান্য চাষীর মেয়ে হয়েও প্রতিবার স্কলারশিপ পেয়ে নিজের জায়গাটা ঠিক ও করে নিয়েছে। ওতো নিজের চেষ্টা তেই ,নিজের মনোবলেই বেঙ্গালুরু তে ফিজিক্সে পি.এইচ .ডি করছে। পরের বছর পাশ করেই আবার কিসব যেন পরীক্ষা দিয়ে বাইরের দেশে চলে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত গতিতে সাইকেলে প্যাটেল চালায় গোপাল। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে ৯:২৫। জোরে প্যাটেলে চাপ দিতেই কিসে যেন ঘসরা খেয়ে সাইকেল টা খোরাং খোরাং আওয়াজ করতে থাকে। নিচু হয়ে দেখতেই চোখ কপালে উঠলো গোপালের। আসলে সাইকেলের চেন টা গেছে পড়ে। কদমপুরের মতো গ্রাম্য এলাকায় কোনো দোকান ও এতো রাতে খোলা নেই। পকেট থেকে ফোন টা বার করেই পিকু কে সে ফোন করে। পিকু বলে "এবার নামবো বাবা। "
গোপাল: মা রে সাইকেলের চেন টা গেছে খুলে। কিচ্ছুটি চিন্তা করিস না । আমি এখুনি আসছি । একটু দাঁড়া মা আমার। ভয় করিস না মা।"
ফোন টা রেখেই গোপাল রুদ্ধশ্বাস এ ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে সদ্য ষাট পেরোনোর গোপাল এর শরীর হাঁপিয়ে যেতে থাকে। এত টা ধকল আর যেন শরীর টা নিতে পারে না। স্টেশনে পৌঁছেই একনজরে পিকুর ট্রলিটা দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। তারপর ভয়ে আচ্ছন্ন পিকুকে ধরে কাঁদতে থাকে।
আসলে মেয়ের এইরূপ সারপ্রাইজ এর কথা জানতে পেরে গোপাল খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অতীতের কিছু স্মৃতি তাকে ভীত তটস্থ করে রেখেছিল এতক্ষন। তাই সরোলাকে সেই অতীতের কথা না বলেই তড়িঘরি বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। মনের ভয় কে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সারারাস্তা শুধু পিকুর কথাই ভেবেছে সে। কিন্তু হঠাৎ সাইকেলের চেনটা পরে যাওয়ায় সেই অতীতের মর্মান্তিক স্মৃতি আবার তাকে ঘিরে ধরে। তার মনে পড়ে তার ই বন্ধু প্রভাবশালী তরুণ হালদারের মেয়ে এর ও এমনি একটা রাতে ফেরার কথা ছিল। স্টেশনে আনতে যেতে খানিক বিলম্ব হওয়ায় মানুষ রূপী জানোয়ার গুলোর হাতে শেষ হতে হয়েছিল সদ্য ডাক্তারী পাশ করা তরুণ বাবুর মেয়ে মাধবিলতাকে।
গোপাল মেয়ের হাত ধরে ট্রলি ব্যাগ টা টানতে টানতে স্টেশন পেরিয়ে রাস্তার সামনে পৌঁছায়। "বাপ বেটি বেঁচে থাকো। বেঁচে থাকুক তোমাদের পবিত্র সম্পর্ক" আচমকা অন্ধকার রাতে এমন উক্তিতে থমকে দাঁড়ায় তারা। আলো আধারী তে গোপাল স্পষ্ট দেখতে পায় -এ আর কেউ নয় তরুণ হালদার। হাতে কাটারী আর লণ্ঠন। সহসা দাঁড়িয়ে পরায় স্টেশন মাস্টার হেঁকে বলেন- "ভয় নেই এগিয়ে যান। কাটারী দিয়ে কিছু করবে না ও।ও পাগল। কাটারী এমনি ই সঙ্গে থাকে ওর।"

1 মন্তব্যসমূহ
C2EF8467DF
উত্তরমুছুনtakipçi satın al
Telegram Coin Botları
Garantili Takipçi
Kaspersky Etkinleştirme Kodu
Instagram Takipçi Arttırma