নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে ঘুম চোখে ফোন টা খোঁজার জন্য পাশ ফিরে ইতিউতি হাতরালাম। সহজে খুঁজে পেলাম না। ঘুম ঘুম ভাবটা একটু কাটিয়ে ফোন টা খোঁজার উদ্যেশ্যে বিছানা ছাড়তে যাবো যেই, দেখলাম আমার ছেলে আমার একদম কোলের কাছে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে আছে। একেই নভেম্বর মাস। শীতের আমেজ, তারওপর মায়ের পরশ পেয়ে ছেলেটা আমার কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে। দেখে ভালো ও লাগে আবার মায়াও হয়। ভাবি এই দুস্টু টাকেই সারাদিন কত বকি, কত মারি কত ওর ওপর চিৎকার, শাসন করি। আর এখন দেখ কি সুন্দর শান্ত হয়ে ঘুমু দিচ্ছে। মায়াভরা মুখটায় একটা চুমু এঁকে আবার ফোন টা খুজলাম।
বর বাবু দেখি আমার ফোন টা নিজের কাছে রেখে ঘুমোচ্ছে। আমায় ও বার বার বলে ফোন নিয়ে শোবে না। পাশে ছেলে শোয়। ফোন মাথার কাছে রেখে শোয়া স্বাস্থ্যের জন্য একদম খারাপ। এতে তোমার ও ক্ষতি, ছেলের ও। কিন্তু ওই যে, আমি না নিয়ে থাকতে পারি না। ঘুম ভাঙলেই শুধু ফোনে টাইম দেখি। এই বুঝি সকাল হয়ে গেল। রান্না বান্না, পুজো পাঠ, ছেলে পড়ানো , বর কে অফিসে র খাবার করে দেওয়া এইসব হাজার টা চিন্তা নিয়ে রাতে শুতে যেতে হয়। তাই বার বার ঘুম ভেঙে যায়। সেই জন্য ই ফোন এর দরকার পড়ে ঘুম ভাঙলেই।
বরের কাছ থেকে ফোন টা নিয়ে দেখলাম সবে 1 টা 48 মিনিট। রাত এখন গভীর। কিন্তু আজ এই ফোন খোঁজার চক্করে ঘুম টা গেল একদম চটকে। বর টাকে রাগ ও ধরছে। ওই তো যত নষ্টের মূল। আবার ফোন টা নিজের কাছে নিয়ে শুলাম। কিন্তু ঘুম আর আসে কই। একটু ঘুমোনোর চেষ্টাও করলাম বৃথা। কাজ হলো না। কোল বালিশ টা আলতো করে জড়িয়ে শুলাম। সত্যি ই রাতটা কত টা সুন্দর। দিনের মতো কাজের ব্যস্ততা নেই। আশ পাশের গাড়ি ঘোড়ার শব্দ নেই। নিজের বাড়ির, আসে পাশে বাড়ির বাসন পত্র নাড়ার, কলে জল পড়ার কোন শব্দ নেই। লোক জনের কোন কোলাহল নেই। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম আজকের রাত টা যেন শুধু আমার। না আর শুয়ে থাকা যায় না। বিছানা ছেড়ে জানালা র ধারে এসে দাঁড়ালাম।
ঘর থেকেই জানালা দিয়ে এক ফালি আকাশ টা খুব সুন্দর ভাবে দেখা যাচ্ছে। সামনে বাঁশ বাগানের পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো এসে নরম আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁশ গাছের পাতা গুলো হালকা বাতাসে তির তির করে যেন কাঁপছে। আর চাঁদের আলো যেন তাদের সাথে খেলা করছে। বাঁশ বাগানের পরেই একটা বিশাল পুকুর আছে আমাদের। পুকুর টার নাম চাতরা। পুকুরের জলে দুটো তিনটে করে পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে। ঝিরি ঝিরি জল এর ধরা আলতো করে তাদের ধরে যেন জলময় খেলিয়ে আনছে। কি মনোরম দৃশ্য। আকাশের মেঘ গুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এটা আমি আকাশের দিকে চেয়ে লক্ষ্য করি নি। আমি যে চাঁদের ছটায় মুগ্ধ ছিলাম। ঝরে যাওয়া পাতা গুলোর জলের মধ্যে অবাধ চলাফেরা নজর করতেই চোখে পড়ল পুকুরের জলে মেঘের নাচন।
পুকুরের জলে কি সুন্দর মেঘের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। এত কিছু আছে আমার চারপাশে আমি যেন এত কিছু কোন দিন দেখিয়েই নি। আমি এক ছুট্টে দরজা খুলে ব্যালকনি তে এলাম। জিরো লাইট টা জ্বালালাম। এই আলোকময় দৃশ্য গুলো আরো যেন গভীর ভাবে আমার মন কে ছুল। আমি ব্যালকনিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে নারকেল গাছের পাতার ছায়া আমায় আহ্বান করলো। নারকেল এর পাতা গুলো হওয়ায় দুলছিল। তাই চাঁদের আলো আধারীতে তাদের সেই রূপকথার গাছের মত লাগছিল। মনে মনে ভাবছিলাম ইস যদি ঘুম না ভাঙত এইসব কোন দিন চাক্ষুস ই করতে পারতাম না।
প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির নিবিড় খেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আনমনে তাদের জীবনধারা দেখছিলাম। কখনো আবার ওদের সাথে নিজেকে তুলনা মন চাইলো । কোথাও যেন মিলে গেল ওদের সাথে আমার জীবন চক্র। রাতের প্রকৃতির এ ধারা যেন তাদের দায়িত্ব কর্তব্য। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে চলে তাদের পরিবর্তনশীলতা। এই যে এখন রাতের শেষ ভাগ এর সাথে সাথে ই যেন চাঁদের কার্য শেষ হয় প্রকৃতির মাঝে। কর্তব্য রত সূর্য এত খন ছিল ঘুমের দেশে। আবার উদিত হবে কিছুক্ষন পর ধরাধাম কে আলোকিত করতে। এটাই যে প্রকৃতির নিয়ম, তাদের কর্তব্য। কুড়ি থাকা ফুল ও এত খন চাঁদের আলোর পরশে নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল। সূর্যের আহ্বানে আর খানিক বাদে তারাও প্রুস্ফুটিত হবে। ঠিক যেন আমার মতো। আমাদের মতো।
আমাদের প্রতিটা জীব দের যেমন নিৰ্দিষ্ট কিছু কিছু কাজ আছে, দায়িত্ব আছে, নিয়ম মেনে চলার কড়া শাসন আছে। প্রকৃতি রও আছে। চাঁদ ও ক্লান্ত হয়ে কর্তব্য শেষে। সূর্য ও তার তেজ হারায় অন্তিম কালে। যেমন টা আমাদের শরীরের হয়। আমাদের রোজকার জীবনে কর্ম, দায়িত্বের বেড়াজালে অনেকেই আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। নিজেকে খুব পরিশ্রান্ত লাগে। অনেকসময় আমরা ডিপ্রেশন এও চলে যাই। কিন্তু এ প্রকৃতি?? এদের কোন ছুটি নেই। ছাড় নেই। নিয়ম অনুযায়ী ই গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে আবার শীত এর ও হয় আগমন। রুটিন এর কোন নড়চড় নেই।
আর আমরা এই পৃথিবীতে ছোট ছোট কিছু কার্য করতে আসি। কয়েক বছরের অতিথি হয়ে। তাও আমরা হাঁপিয়ে যাই। অভিযোগ জানাই। আবার কেউ কেউ না পারার গ্লানি ভুলতে না পেরে নিজেদের অকালে হারিয়েও ফেলি। তাই আজ, আমি অনুভব করলাম প্রকৃতি আমাদের নীরবে অনেক কিছু শেখায়। আমরা খালি চোখে প্রকৃতির এত শৃঙ্খলা হয়তো দেখতে পাই না। তার জন্য অন্তরের গভীরতা প্রয়োজন, সুক্ষ চক্ষুর দরকার। আর দরকার উপলব্ধি করার ক্ষমতা। তাহলে আমরা বুঝতে পারব প্রকৃতি শুধু আমাদের জল, হওয়া, বাতাস, খাদ্যই যোগায় না। আরও অনেক কিছু শেখায়। নিজেকে লড়তে শেখায়। আপন কর্ম নীরবে করে যেতে বলে, কাউকে না দোষ দিয়ে নিজের ভুল গুলো শুধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে শেখায়।
আসলে বেঁচে থাকার জন্য সুখী থাকার জন্য প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া টাও খুব জরুরি। ভোরের আকাশকে যেমন উপলব্ধি করতে হবে তেমনি চাঁদের পরশ কেও গায়ে মাখতে হবে। সূর্যের তেজ এর মতই আমাদের জেদ নিয়ে কঠিন পরীক্ষা গুলো নিজেদের অতিক্রম করতে হবে। ব্যর্থতা এলে চোখে জল তো আসবেই। বর্ষার মতোই আমাদের ঝরবে চোখের জল। কিন্তু শরতের পেঁজা তুলোর মতোই একটু একটু করে আবার নতুন ছন্দে জীবন টাকে রাঙিয়ে তুলতে হবে জীবনের ক্যানভাসে। নব ছন্দে আবার জীবন টাকে সাজিয়ে নিতে হবে । হেমন্তের মতো চির সবুজ করে তুলতে আমাদের মন । বয়স যতই বাড়ুক। মন যেন থাকে চির সবুজ। শীতের ঠান্ডার মত নিজের ব্যর্থতা গুলোকে অসফলতার চাদরে মুড়ে রাখতে হবে। ব্যর্থতা থেকে শিখতে শিখতে আবার নতুন করে কাজকে নতুন রূপ দিতে হবে। তবেই তো বসন্তের মতো কচি কচি পাতা গজাবে আমাদেরও জীবনে আমাদের ও কর্মে এবং সর্বোপরি আমাদের মর্মে। কি ঠিক বললাম তো পাঠক বন্ধুরা?
আজকের ব্লগ এত টুকুই। আজকে ঘুম না আসা যাক রাতের অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। আপনাদের ও আছে না কি এইরকম কোন অভিজ্ঞতা? থাকলে জানাতে ভুলবেন না আমার কমেন্ট বক্সে। আজ তবে এত টুকুই। আবার ফিরবো আগামী কাল। নতুন ব্লগ নিয়ে। শুভ রাত্রি।





0 মন্তব্যসমূহ