সবজির বস্তায় ঢাকা জীবন: নেরুনী ও টুপলির মায়ের মানবিক গল্প”

 হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, রাধে রাধে রাধে রাধে রাধে রাধে , ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায়।)

21. 11.2025

শুক্রবার



- এই , সর তো সরে বোস। সব সময় যেন গা ঘেষে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একদম গায়ের উপর।

 আরামবাগ লোকাল ট্রেন টা রিষরা স্টেশন ছাড়তেই একজন মহিলা উঠে সামনে দরজার সামনে মেঝেতে সবজির বস্তা নিয়ে বসলো। বসার সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসে থাকা মধ্য বয়স্ক মহিলাকে বিরক্তির স্বরে বলল।

- এই টুপলির মা, একদম বাজে কথা বলবি না। আমি তোর ঘাড়ে কখন উঠলাম রে? আমি তো বালি স্টেশন থেকে উঠে এখানে বসে আছি। তুই ই তো এখন এসে গোল পাকাচ্ছিস।

- বেশি কথা একদম কোইবে নে নেরুনী। দুদিন কাজে হাত দিয়েছিস কি দিস নি অমনি পাখা গজিয়েছে না? এত দেমাক কোথা থেকে আসে তোর?

- দেখ , আমি তোর সাথে ঝগড়া করতে চাইনা টুপলির মা। ট্রেনে খুব ভিড়। একেই লোকেরা পা দিয়ে আমায় মাড়িয়ে চিরে চ্যাপ্টা করে ফেলছে। তার ওপর আবার তুই...

- যা বলেছিস  রে নেরুনী। এই নিত্যদিন লাথি, গুতনি খেয়ে খেয়ে কাজে যাওয়া আসা আর ভালো লাগে না। 

- আচ্ছা টুপলির মা , বল দিখিন আমরা যদি সবজি ব্যবসা না করে ওই ট্রেনের সিটে বসে থাকা কোন দিদিমণি বা ভালো চাকুরী করতাম। কি ভালোই না হতো? ছোট বেলায় যদি লেকাপরা করার একটু সুযোগ পেতুম ...টা আর কপালে জুটলো কই.. নিজের মা, বাপ এরই ঠিক নেই। 

- আহ ! নেরুনী থাক না ... ওসব কথা।

- থাকবে কেন রে টুপলির মা, 

 দ্রুতগামী ট্রেনের গতিবেগের সাথে হাওয়াও দিচ্ছে প্রবল। সেই হওয়ায় নেরুনীর চোখের জলটা দমকে চোখ থেকে উপচে গালে এসে পড়ল। অপরিস্কার হাতের তালুটাই মলিন কাপড়ে খানিক রোগরে নেরুনী চোখ মুছলো।

টুপলির মা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবু একটু ইতস্ততঃ করে , 

- নেরুনী তোর মা ,বাপ যা করেছে বাদ দে। তুই তো সুখে আছিস বল? নেকা পড়া না জানলে কি সে মানুষ নয়? এই তো তুই খেটে খাচ্ছিস। বুড়ো বাপ টাকে দেখছিস। সে যতই তোর সাথে অবিচার করুক। তুই তো তাকে ফেলা ছেদ্দা করিস নি। যেমন সামর্থ্য খাওয়াছিস। ভিক্ষে তো করিস নি। বেশ্যা গিরি তো করছিস না। সৎ পথে কাজ করছিস। এটাও তো কম কিছু নয় বল?

নেরুনী , আলতো করে মাথাটা টুপলির মায়ের কোলে গুঁজে দিল। পরম লালিত্বের হাত টা মাথায় পড়লো নেরুনী র। ওর খুব মায়ের কথা মনে পরলো।

সেই কোন ছোটবেলায় তখন নেরুনীর বয়স ৭ কি ৮ হবে। নেরুনী র মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। ইহলোক ছেড়ে নয়। তাদের ছেড়ে। মানে নেরুনী কে আর ওর বাপ কে ছেড়ে। বাপ টা বড় খারাপ মানুষ ছিল। রিক্সাচালিয়ে যা পেত মদ খেয়ে উড়িয়ে দিত। বাড়ি এসে বউ কে বিশ্রী গলায় গালাগাল দিত। সংসারে একটা টাকাও দিত না। অভাবের তাড়নায় নেরুনী র মা লোকের বাড়ি ঝি গিরি করতো। সেই টাকাও চুরি করে নিয়ে নিত বাপ টা। জুয়া খেলতো। একরত্তি নেরুনী খিদের জ্বালায় ছটফট করতো। আসে পাশের কারো দয়া হলে দুটি ভাত, মুড়ি দিত। 

যৌবনের এত জ্বালা , অভাব, অত্যাচার নেরুনীর মা আর সহ্য করতে পারে নি। বেরিয়ে গেছে একসময় পর পুরুষের হাত ধরে। কিন্তু নাড়ি ছেড়া ধন নেরুনী কে নিয়ে যায় নি। এক মুঠো সুখের জন্য সব কিছু ছেড়ে চলে গেছে। এ বড় অবিচার নেরুনীর মায়ের। মেয়ের কথা টুকু ভাবলো না। কিন্ত ক্লাইম্যাক্স আরো বাকি। 

যে মা সে তো মা ই হয়। তার মমত্ব কে কি সাধারণ মানুষ বিচার করতে পারে? এখানেও আছে এক অন্তর দৃষ্টি। 


নেরুনীর মা পালিয়ে যাওয়ার দিন সাতেক পর আবার এসেছিল মেয়েকে দেখতে। ওর বাবা এমনকি পাড়ার লোক দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। পরে দেখা হয় টুপলির মায়ের সাথে নেরুনীর মায়ের। প্রথম দেখায় সবজি বাজারে টুপলির মা কথা বলতে চায় নি। কিন্তু তার কথা শোনার পর টুপলির মায়ের নেরুনীর মা এর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আসে। তাকে মনে মনে কোটি কোটি প্রণাম করে। 

 পর পুরুষের সাথে চলে যাওয়ার দিন সাতেক পর একদিন হঠাৎ ই বাজারে ...

- বিন্তু... ও বিন্তু( টুপলির মা )

অকস্মাৎ নেরুনীর মা কে দেখে বিন্তু হনহন করে এগিয়ে যায়। নেরুনীর মা তাকে ধাওয়া করে তার আঁচল ধরে থামায়। 

- ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না বিন্তু।

- কিন্তু কেন? 

- আমার নেরুনী কেমন আছে রে ? বলতে পারিস?

- পর পুরুষের সাথে চলে যাওয়ার সময় মনে ছিল না মেয়ের কথা? সে তো তোমার নিজের নাড়ি ছেড়া ধন। মানলাম স্বামী মাতাল, রোজগার করে না। মারধর করে। কিন্তু মেয়েটা ? মেয়েটা কি দোষ করেছিল গো?

চোখের জল মুছে..

- জানিস বিন্তু মেয়ে দের অনেক বুঝে পা ফেলতে হয়। আমি প্রথম জীবনে অনেক ভুল করেছি। নিজের জীবন টা শেষ করেছি। আমি চাই না আমার মেয়েকে কেউ খারাপ বলুক। আমার মেয়ের কেউ খারাপ করুক। আমি পর পুরুষের সাথে পালিয়েছি মানছি। এটাও মানছি নিজে ভালো খাবো, ভালো পড়বো এই লোভে। কিন্তু পর পুরুষ তো পর পুরুষ ই হয় রে। সে কি নেরুনীর বাবা হতে পারবে? সে যদি কোন দিন ওই পুরুষেরই কামনা লালসার শিকার হয়? তখন পারবো নিজেকে ক্ষমা করতে? না কি পারবো মেয়ে টার সন্মান বাঁচাতে। তাই তো সব ভেবে নিয়ে আসি নি। এই বাজারে তোকে দেখে মনে সাহস এল। তুই এই বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসিস বুঝি?

- হ্যা গো দিদি।

- তবে শোন বিন্তু। আমি তোকে সপ্তাহে সপ্তাহে কিছু কিছু টাকা দেব। নেরুনী কে দিস। মেয়েটা কিছু খেতে পড়তে পারবে। যতই হোক বাপ টা তো ওর জন্মদাতা বল। তাকে যেন ও ফেলাচ্ছেদদা না করে ওকে বলিস। 

এই প্রথম বিন্তুর চোখেও জল নেরুনীর মায়ের প্রতি। 

সেই থেকে টুপলির মা অর্থাৎ বিন্তু , নেরুনী কে চোখে চোখে রাখে। ভালোবাসে। আবার শাসন ও করে।

নেরুনী ও পুঁথি গত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে নি ঠিক কথা। অনেক শিক্ষিত মানুষের চিন্তাধারাকে ও ছুড়ে ফেলে বৃদ্ধ বাবার মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেয়। ওষুধ আনে। যোগ্য কন্যার দায়িত্ব পালন করে। বৃদ্ধাশ্রম এ কিংবা বাবাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে না। 

এটাই প্রকৃত মানুষের শিক্ষা। আসল শিক্ষিত তো নেরুনী। নেরুনীর মা ও  বিন্তু।


আজকের গল্প এখনেই শেষ করলাম। অনেকদিন পর কলম এই ধারায় চলল। আমি ও লিখে খুশি হলাম। আপনাদের কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না। আজ আসি। আবার ফিরবো আগামী কাল নতুন কিছু নিয়ে। ভালো থাকবেন। শুভ রাত্রি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ