দাদা বোন এর সম্পর্ক যেমন হয়....

 নেহা ও নীল দুই ভাই বোন। তাদের নিত্য দিনের জীবন যাপনের কিছু কিছু ঘটনাবলী নিয়ে আজকের ব্লগ।


 যা, সকাল সকাল লোডশেডিং ধুর, ভালো লাগে না। ঘুমে আড়ষ্ট চোখ দু খানি কচলাতে কচলাতে বিরক্তির সুরে নীল বলে উঠলো। পা বালিশ টা টান মেরে ফেলে দিল। ওটা আবার নেহার মুখে এসে লাগলো। নেহা তো এমনিতেই নীল এর ওপর চোটে ছিল। এবার আরো ক্ষেপে গেল। এবার চিল্লাচিল্লি করে নেহা বলল, 

--- আজ্ঞে, না কারেন্ট চলে যায় নি। আমি ফ্যান টা অফ করেছি। কি করবি এবার শুনি? বেলা আট টা হয়ে গেল, এখনো তো তোর জন্য সকাল আছে...


--- কি !!! তুই তাহলে আমার সকাল সকাল ঘুমের বারোটা বাজালি?

--- ঘড়িতে তাকিয়ে দেখ দাদা, বেলা আট টা বাজে। আমার ডিউটি প্ৰতিদিন বিছানা গুছানোর আর তুই বেলা আট টা অবধি বিছানা কামড়ে পরে থাকিস বলে আমার বিছানা গুছাতে দেরি হয়। আচ্ছা , আমার কি আর কাজ নেই নাকি ? এটাই ভাবিস তুই?

নীল এতক্ষনে উঠে বসেছে। নেহার কথা গুলো জাস্ট এ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ওই কান দিয়ে বের করে বলল, এক গ্লাস জল দে তো? আর সকাল সকাল তোর ধেড়ে গলাটা বন্ধ কর।

--- এটাও তুই নিজে হাতে নিয়ে খেতে পারছিস না। তোর তো পাশেই টেবিল এ বোতল টা রাখা আছে। নিয়ে নে।


-- সোনা বনু আমার। প্লিজ জল টা দে। এই জানিস, কেউ জল চাইলে দিতে হয়। না করতে নেই। 


নেহা গজগজ করতে করতে অজ্ঞতা জলের বোতল টা নীল এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এবার জল টা খেয়ে এই ঘর থেকে বিদেয় হ। আমি এবার ঘর টা ভদ্র ভাবে গুছাই। কি অবস্থা টাই না করে রেখে দিয়েছিস। কেন যে মা, তোর ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব আমায় দিয়েছে। ধুর ভাল লাগে না।


নীল বেরিয়েই যাচ্ছিল ঘর থেকে। এই সুযোগে নেহা কে আরেকটু তাতিয়ে দিয়ে বললো, কারণ তুই তো বাড়ির চাকরানী । তোকে দিয়ে করাবে না তো আমার মতো রাজ পুত্র কে দিয়ে করাবে? 


--- দাদা, তোর আজ হচ্ছে দেখ, নীল দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। নেহা দাদার নাগাল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আবার ঘরের কাজে মন দিল। 


এই হলো নেহা ও নীল এর প্রায় রোজকার সকালের মারামারি, কথাকাটি, খুনসুটি। 

ওদের সামলাতে সামলাতে ওদের মায়ের অবস্হা আরো খারাপ। 


টিউশন পরিয়ে এসে নেহা আরাম করে একটু টিভি দেখতে বসলো। সাথে কিছু মুখ চাট। দু বাড়ি টিউশন পরিয়ে এসে বড্ড বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। বাইরে যা রোদ। জৈষ্ঠ্য মাস। স্নান সেরে পাখার তলায় বসে বেশ নিজেকে ফ্রেশ লাগছে এবার। একটা কার্টুন এর চ্যানেল খুলে খিল খিল করে হাসছিল। আর  কার্টুন দেখছিল। অসময়ে কলিং বেল টেপার আওয়াজে নেহার মেজাজ টা আবার গেল বিগড়ে। উপরন্তু মা, রান্না ঘর থেকে বলল, যা নারে বেল টা বাজছে, দরজা টা খুলে দে। আমার দু হাত ই জোড়া। রিমোর্ট টা বিছানায় রেখে নেহা দরজা খুলল। 

--- কিরে, এই তো গেলি অফিস। এখুনি চলে এলি যে? অসময়ে দাদাকে দেখে বিরক্তির সুরে নেহা বললো।

--  বাড়িটা যেমন তোর, তেমনি আমারও। বুঝলি পুঁটি। পুঁটি? সেটা আবার কে? 

--- আরে, তোকেই বলছি রে। দিন দিন তোর থবরা টা যা হয়েছে না। নেহা নাম টা আর তোকে ঠিক মনাচ্ছে না। পুঁটি নাম টাই পারফেক্ট ঠিক বলছি না মা? 

বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার বোন টার পিছনে লাগছিস তো? সত্যি মাইরি তোদের দুটোকে নিয়ে আর পারা যায় না। কিন্তু তুই এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? অফিস গেলি না? 

--- ট্রেন গন্ডগোল। অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে এলাম। 


এবার এসে সবাই এর পিছনে লাগবে। মুখ বেকিয়ে টিভি দেখতে দেখতে নেহা বললো। 

নীল ধড়াস করে নিজের শরীর টা এলিয়ে দিল বিছানায়। 

নেহা এক ঝটকায় নাক মুখ সিটকিয়ে একটু সরে গেল। 

--- কি হলো সরে গেলি যে? নীল বললো।

---ম্যা...  গো... তোর গা দিয়ে যা ঘাম গন্ধ। ওয়াক... তোর পাশে বসতেই কেমন হচ্ছে। গা টা গুলিয়ে যাচ্ছে। 

নীল হেসে বললো , ওহ! দাঁড়াও বৎস, পিকচার আভি বাকি হ্যায়। উপুড় হয়ে শুয়ে বললো , আমার পিঠের ওপর একটু দাঁড়িয়ে আমার গা হাত টা একটু ম্যাসাজ করে দে দেখি। সেই থেকে তো বসে বসে টিভি দেখছিস। সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে তো মোটা ঢিপসি হয়ে যাবি। 

--- বয়ে গেছে , তোর গা হাত টিপে দিতে। 

--- আচ্ছা, ঠিক আছে। দিতে হবে না। আমি ভাবলাম আজকে তোর স্কিন কেয়ারের টাকা গুলো দিয়ে দেব। না থাক। রেখে দিই আমার কাছে। 

--- সত্যি, সত্যি বলছিস দাদা আজকেই সব টাকা টা দিয়ে দিবি?

--- হুমমম। সেটাই তো ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই তো কাজ করছিস না। কি করে দিই। না থাক । তোকে করতে হবে না।

--- আরে, রাগ করছিস কেন দাদা। এখুনি তোর গা, হাত পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছি। দাঁড়া। 

নীল হাসতে হাসতে মনে মনে বললো, ওষুধে কাজ হয়েছে। 

আধ ঘন্টা ম্যাসাজ করে দেওয়ার পর নেহা অনেকটা উৎসাহ নিয়ে হাত পাতলো। নীল কিছু না বোঝার ভান করে , চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছে।

--- কিরে, দাদা । টাকা টা দিবি তো ?

--- ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে নিল বললো কিসের টাকা? আমি তো কোনো টাকা নিই নি তোর থেকে।

কাঁদো কাঁদো হয়ে, নেহা এবার বললো তুই যে বললি গা হাত পা টিপে দিলে স্কিন কেয়ারের টাকাটা দিবি। আমি তো টিপে দিলাম সুন্দর করে। 

-- ওটা গা হাত পা টিপে দেওয়া হলো? কি খর খরে হাত রে বাবা। যেন আমার সারা শরীরে ঝামা ঘষে দিল। উফফ কি জ্বলছে আমার সারা শরীর। ওহ !! কি ব্যাথা ।

নেহা এবার রাগে ফুঁসছে। চোখ পিটপিট করে নেহার অঙ্গভঙ্গি দেখে নীল মনে মনে খুব হাসছে। নেহার মাথা গেছে গরম হয়ে । সে ইতস্তত ভাবে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। নীল সেটা বুঝতে পারছিল না । কি করতে চাইছে নেহা!! নেহা মুহূর্তে র মধ্যেই নীল  এর অফিস ফেরত আনলায় রাখা প্যান্টের পকেট থেকে মানি পার্স টা বের করে কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট বের করে নিল। নীল ধরমর করে বিছানায় উঠে বসলো। এই এই দিন দুপুরে চোখের সামনে থেকে আমার টাকা চুরি করে নিল গো।

--একদম চুপ। আমি আমার হকের টাকা নিচ্ছি।

---হকের টাকা!!!

-- আলবত হকের টাকা। আমার পরিশ্রমের টাকা। আমি গা হাত পা তোর টিপে দিয়েছি বিনিময়ে টাকা নিয়েছি। আমি কাজ করেছি। টাকা নিয়েছি সোজা হিসাব। 

গট গট করে নেহা চলে গেল। নীল মনে মনে হাসলো। বেচারাকে আজ সকাল থেকে হেব্বি চটিয়েছি। আর রাগানো ঠিক হবে না।

---এই , এই দাঁড়া কোথায় যাচ্ছিস? (নেহা)

--- কি হলো টা কি ? এই ইমার্জেন্সি তে কেউ দাঁড় করিয়ে রাখে ।( নীল)

--- ইমার্জেন্সি মানে?( নেহা)

--- ধুর বাবা!!! সর তো , সর... জোর পটি পেয়েছে। 

--- ইসস ... ছি !! আমি আগে গা ধুতে ঢুকবো । তারপর তুই যাবি। ( নেহা)

--- আমি আগে এসেছি। আমি আগে যাবো। এই বলে নীল আগে বাথরুমে ঢুকে গেল।

বাধ্য হয়ে নেহা অপেক্ষা করছিল। নীল বাথ রুম থেকে বেরোতেই নেহা তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকলো। আবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো। 

-- ছি!! কি গন্ধ রে বাবা। কি খাস রে তুই সারাদিন।

--- তুই যা খাস তাই। তোর ইয়ে তে বুঝি সুবাস আছে। নীল বলে চলে গেল। 

( এই সব সারাদিন খুঁটিনাটি দাদা বোনের মধ্যে লেগেই থাকে)

--- এই তুই তো এতক্ষণ ধরে টিভি দেখছিলিস। এবার আমার হাতে একটু রিমোর্ট দে। আমি একটু খেলা দেখবো। 

-- উমম...আমি তখন কত টুকুই আর দেখতে পেলাম। আমি দেখবো । কার্টুন দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। সারাদিন কলেজ, টিউশন করে আর টাইম ই বা পাই কত টুকু। এই তুই যা তো এখন দাদা ... তুই ... তুই এক কাজ কর মোবাইল এ খেলা দেখ গে যা। যা...

ওরে বোন টার সাথে সারাদিন কেন এত লাগিস বলতো, ওকে একটু কার্টুন দেখতে দে না ...  কতটুকুই বা দেখার সময় পায়। ( মা) 

---- হ্যা তো... আরো প্রশ্রয় দাও তোমার মেয়ে কে। আমার আর কি... ( নীল)


--- এই, এই দাঁড়া দাঁড়া। (নীল)

--- উফফ! বেরোনোর সময় কেন আবার পিছু ডাকিস রে দাদা। যাচ্ছি একটা শুভ কাজে। কি হলো বল।

--- যাচ্ছ যাও। কে তোমায় না করেছে। কিন্তু এটা মনে হচ্ছে আমার টি শার্ট?

--- আমার নয় । বল আমাদের।

---মানে টা কি? আমার টিশার্ট কি করে আমাদের হয়ে গেল বুঝলাম না।

-- আরে, এই টিশার্ট টা ছেলে মেয়ে উভয়ই পড়তে পারে। সো এটা আমাদের। আর বাই দ্যা ওয়ে এই টিশার্ট টা পরে তোকে পুরো গেছো বাঁদর লাগে। আর আমায় দেখ পরে কতটা স্টাইলিস্ট লাগছে।  ( নেহা)

--- কি !!!!! তুই দাদা কে বাঁদর বলছিস?

--- হম্মম , বললাম। কি করবি আমায় ?

- - তবে রে, 

নেহা এক ছুট্টে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

--- তুই আয় তারপর তোর হচ্ছে। 

নেহা বেরিয়ে যাওয়ার পর। নীল মায়ের সাথে চা খেতে বসলো।

চায়ের চুমুকে মুখ দিয়ে নীলের মা বললেন, কেন সবসময় নেহার এত পিছনে লাগিস। মেয়েটা চোটে যায়। 

--- ওকে তো রাগাতে আমার বেশ লাগে । জানো তো মা , ও হাতে, পায়েই বড় হয়েছে শুধু। মন টা এখনো শিশুদের মতো।

--- সেটাই তো ভয় রে নীল। নেহা যে আমাদের বড্ড সাধাসিধে মেয়ে। কোন বাড়িতে যে ওর বিয়ে হবে, কেমন হবে ওর শশুর বাড়ী কি জানি। এখানে তো ও বড় আদরে থাকে। যা চায় তাই পায়। কি জানি ওর কপালে কি আছে। নে, আর কদিন বোনের সাথে খুনসুটি করে নে। আর তো ক বছর পর ওর বিয়ে হয়ে যাবে। তখন এই গুলো খুব মিস করবি।

মুহূর্তের মধ্যেই  পরিবেশ টা বেশ ভারী হয়ে গেল। নীল এর চোখ টাও চিকচিক করে উঠলো। নিজেকে সামলে মায়ের কাছে নিজের চোখের জল আড়াল করে কাপ রাখার বাহানায় নীল রান্না ঘরের দিকে এগোলো।

মা এর মন সবটাই বোঝে। আর কিছু প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে উনিও রান্নার তোড়জোড় করার জন্য সবজি কাটতে বসলেন। 

আসলে পারিবারিক জীবনে ভাই বোনের সম্পর্ক এইরকমই মিষ্টি মধুর হয়। একে অপরের ওপর ভীষণ ভালোবাসার টান থাকে। একে অপরের জন্য তারা প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। এতটাই সুন্দর হয় এদের সম্পর্ক।


সমাপ্ত


ভাই বোনের সম্পর্ক মানেই : 

ভাই বোনের সম্পর্ক মানেই শত মান অভিমানের পরেও একে অপরকে ছেড়ে না থাকতে পারার টান। 


ভাই বোনের সম্পর্ক এমনই একটি সম্পর্ক এই সম্পর্কে কোনো দিন বিচ্ছেদ হয় না।


ভাই বোনের সম্পকের মতো এতটা মিষ্টি সম্পর্ক আর কোনো সম্পর্কে দেখা যায় না।


ভাই বোন মানেই তারা দূরে থাকলে একে অপরকে মিস করে আর কাছে থাকলে সারাদিন ঝগড়া, মারামারি পর্যন্ত করে।


বাবা, মায়ের পর যে বোন টিকে শাসন দিয়ে আগলে রাখে সেই হলো ভাই।


ভাই রা হলো বোনেদের কাছে বাবার প্রতিরূপ।



আমার এই লেখার সাথে কেউ কি আপনাদের জীবনের মিল পাচ্ছেন? কারো কি এই গল্পটি পড়ে নিজেদের ভাই বোনের টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে? আপনাদেরও যদি ভাই বোন সম্পর্কের কিছু মিষ্টি মধুর কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় এই ব্লগ টি পড়ে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে শেয়ার করতে পারেন। 














একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ