পুত্র বিদায়

 



রিক ওর বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। একটা বড় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তে বড় পদে চাকরিরত। বয়স ওই পঁচিশ- ছাব্বিশ। দেখতে সুন্দর। ফর্সা, স্মার্ট চেহারা, আকর্ষণীয় ফেস। এহেন উঠতি বয়সী ছেলের প্রেমিকা থাকবে না এমন তো হতে পারে না। রিক এরও গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তবে রিক এর  গার্ল ফ্রেন্ড শ্রেয়া একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। শ্রেয়া আর রিক এর পরিচয় ক্লাস ইলেভেন থেকে। দুজনে একই কোচিং সেন্টারে ইংরেজি পড়তে যেত। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। পরে প্রেম। তারপর দুজনের আলাদা আলাদা কলেজে ভর্তি হওয়া। সেই যাই হোক, আলাদা স্টিম হলেও আলাদা কলেজ হলেও তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক টা রয়ে গিয়েছিল। রিক এর বাড়ী থেকে ওদের সম্পর্কে র কথা প্রথম থেকেই ওর বাবা মা জানতো। রিক এর মা প্রিয়ারও খুবই পছন্দের পাত্রী শ্রেয়া। সুতরাং শ্রেয়ার কোনো অসুবিধা হয় নি কোনো দিন রিক এর বাড়ী আসতে। শ্রেয়াও ওর মা, বাবার একমাত্র মেয়ে। শ্রেয়ার বাড়ি থেকে প্রথম দিকে রিক আর শ্রেয়ার এই সম্পর্কে র কথা জানত না। রিক এর মা প্রিয়াই বলতে বারণ করেছিল প্রিয়া কে। কারণ রিক তখন ও পড়াশোনা করছে। ওর কোনো কেরিয়ার তৈরি হয় নি। এই রকম কোনো ছেলের সাথে রিলেশন এ আছে শুনলে অনেক মা, বাবাই তা মেনে নিতে চায় না। এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে দু পক্ষের মনে আরো জেদ ধরে বসে। ফলে তাদেরও মানসিক উদ্বেগ এর সৃষ্টি হয়। আর অভিভাবক দেরও। এই সব মন কষাকষির জেরে শেষ পর্যন্ত জীবনের চূড়ান্ত সময়ের কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই রিক এর মা প্রিয়া বুঝিয়েছেন, আমি তো আছি। আমি তো সব টা জানি। তোরা মন দিয়ে কেরিয়ার এ ফোকাস দে। নিজের পায়ে দুজনে ভালো ভাবে দাঁড়া। দেখবি সবাই সবটা মেনে নেবে। কেউ বাধা দেবে না। আর এখন থেকে যদি শ্রেয়া বাড়িতে এই সম্পর্ক টা নিয়ে বাড়িতে জানাতে চাস তাহলে তো ওনারা জিজ্ঞাসা করবেই ছেলে কী করে, তখন তুই কি উত্তর দিবি? ভেবে দেখেছিস? আর যে ছেলে প্রতিষ্ঠিত নয় তার সাথে নিজের মেয়ের কোনো সম্পর্ক থাক এ কি কোনো মা, বাবা চাইবে ? কখনো নয়। আমার মেয়ে থাকলে সেও যদি এইরকম বলতো আমিও রাজি হতাম না। তাই বলছি ক্যারিয়ারে মন দে। তারপর আমি সব টা দেখে নেব। 


রিক আর শ্রেয়া কথা রেখেছিল প্রিয়ার। তারা অনেক কষ্ট অনেক পরিশ্রম করে নিজেদের কেরিয়ার তৈরি করেছে। নিজেদের ভালোবাসা যাতে খুব শীঘ্রই পূরণ তা পায় তাই জন্য দিন রাত এক করে পড়াশোনা করেছে। সস্তার পার্কে গিয়ে সন্ধের পর সন্ধেয়, দিনের পর দিন ঘুরে তুড়ে সময় নষ্ট করে নি। একে অপরকে যতটা সম্ভব পড়াশোনার ব্যাপারে হেল্প করেছে। রিক কলেজ কমপ্লিট করেই চাকরি জয়েন করেছে। রিক যেদিন চাকরি পেল সেদিন রিক শ্রেয়াকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। শ্রেয়া জানতো না রিক এর জব টা কনফার্ম হয়ে গেছে। রিক শুধু শ্রেয়া কে ফোন করে বলেছিল আজকে তোকে একটা ট্রিট দেব। সন্ধ্যে সাত টার সময় স্টার রেস্তোরাঁ য় চলে আসবি। শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো কিসের ট্রিট? রিক শুধু ফোনে বলল আসলেই জানতে পারবি। এই বলে ফোন কেটে দিল। শ্রেয়া যথারীতি সাত টার সময় রেস্তোরাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো। আগে থেকেই ফোনে বলা ছিল রিক   শ্রেয়াকে দেখা মাত্রই নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলো।

--- আরে, কেসটা কি বলতো? হটাৎ করে ট্রিট? ( শ্রেয়া)

--- বলছি ম্যাডাম । ( চেয়ারটা সামনে এগিয়ে দিয়ে ) আগে তো বসুন । ( রিক)

রিক কে আজকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছিল।

--- কিসের ট্রিট বলবি তো ?

--- বলবো না, তুই গেস কর।

---আচ্ছা বলছি। উইল ইউ ম্যারি মি? ( হাতটা শ্রেয়ার দিকে বাড়িয়ে রিক বললো)

শ্রেয়া লজ্জা পেয়ে বললো কি হচ্ছে কি রিক এত লোকের মাঝে। 

--- আমি সিরিয়াসলি বলছি শ্রেয়া। উইল ইউ ম্যারি মি? 

--- আমি তো তোকেই ভালোবাসি। আজীবন ভালোবাসবো। আর তোকেই বিয়ে করব। তার জন্য এখানে আমায় ডেকে এই কথা গুলো তোকে বলতে হলো?

--- না, ম্যাডাম। কারণ আছে।

--- কারণ টাই তো আমি জানতে চাইছি।

--- কারণ আজ আমি জব টা পেয়ে গেছি। আগামী মাসেই জয়েনিং।

শ্রেয়ার চোখে আনন্দের জল। ও আবেগে রিক কে জড়িয়ে ধরলো। এত দিনের ওদের আশা, ইচ্ছা, স্বপ্ন পূরণ হলো।

শ্রেয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো, এবার আমি বাড়িতে তোর আর আমার কথা বলবো। 

--  চোখের জল মুছিয়ে রিক বললো একদম নয়।

--- শ্রেয়া অবাক হয়ে জানতে চাইলো কেন? 

---- মা বলেছে সময় এখনো আসে নি রে শ্রেয়া। তুই এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াস নি। আর একটু ধৈয্য আমাদের সইতে হবে। এখনকার দিনে মেয়ে দের স্বাবলম্বী হওয়া টা খুব জরুরি রে। আমি তোর জন্য , তোকে পাওয়ার জন্য আরো আরো অপেক্ষা করতে রাজি। আমি তো আছি সারাজীবন। তুই তোর কেরিয়ার এ মন দে।

এরপর কেটে গেছে প্রায় অনেক গুলো দিন। রিক ওর জব নিয়ে ব্যস্ত। এক বছর পর শ্রেয়াও একটা সরকারি স্কুলে চান্স পেয়ে যায়। এর পর দুজনের বাড়ির মতামত নেওয়া হয়। দুজনের বাড়ি থেকেই রাজি। কোনো আপত্তি নেই। রিক এর মা শ্রেয়া কে বলে দেখলি তো আমি বলেছিলাম না দুজনে কেরিয়ার এ ফোকাস কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।শ্রেয়া আনন্দে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে।

আর প্রায় কিছুদিন পরেই রিক ও শ্রেয়ার বিয়ে। সেই জন্য বিয়ের কার্ড ছাপানো, কেনাকাটা , ডেকোরেশন এইসব নিয়ে ব্যস্ত। এরই মাঝে রিক অফিস থেকে ফিরে ওর মা, বাবা কে বলে তোমাদের সাথে একটা ডিসকাশন করতে চাই। 

--- হ্যা কি বলবি বল ( প্রিয়া)

--- বলছি মা, বিয়ের আগে বাড়িটা আগে রং করলে  কেমন হয়?-( রিক)

--- তা ভালো, কিন্তু তোর ও তো এখন খরচ আছে বিয়ের পর নতুন ফ্লাট কিনতে হবে। কিংবা এখন যদি না পারিস ভাড়া তো অন্তত নিতে হবে তোকে? ( প্রিয়া)

--- ফ্লাট কেন নেব মা?

--- তোকে তো আমি এই বাড়িতে বিয়ের পর রাখতে পারবো না।

--- কেন?

--- দেখ, শ্রেয়া বিয়ের পর ওর মা, বাবাকে ছেড়ে নতুন সংসার করবে, তোকেও তোর মা, বাবাকে ছেড়ে একটা নতুন সংসার করা উচিত। তবেই তো ওর কষ্টটা তুই বুঝতে পারবি। একটা মেয়ের কষ্ট কতটা হয়।

,--- কিন্তু মা , বাবা তোমাদেরও তো বয়স হচ্ছে? তাছাড়া বিয়ে করেই অন্য ফ্ল্যাটে থাকলে লোক কি বলবে?

--- সে তো শ্রেয়াও ওর মা বাবার এক মাত্র মেয়ে। তাদের কিছু হলে তাদের কে দেখবে শুনি? তোদের কেই তো দেখতে হবে। তেমনি আমাদের ও কিছু হলে তরা দেখবি। এখন কার জেনারেশন এ একটা ফোন কল করলেই তো চলে আসতে পারবি। অসুখ বিসুখ হলে। আর রইলো বাকি লোকের কথা সে সব আমি সামলে নেব।

মায়ের কথায় রিক খুব অবাক হয়ে গেল। এভাবেও ভাবা যায়। সত্যি আমার মা, বাবার মতো অভিভাবক যদি সব পরিবারে থাকতো তাহলে শশুর বাড়ী র সাথে বৌমা দের মানিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা হতো না।

--কি রে কি ওতো ভাবছিস ( প্রিয়া)

- কিছু না। মা তুমি আমায় পর করে দিচ্ছ না তো ?

- না রে। শ্রেয়ার মা ও তো ওকে বিয়ে দিচ্ছে। তাবলে ও পর হয়ে গেল। যে বাড়ি আসবি । ছুটি কাটাবি। মজা করবি। আমাদের অসুখ বিসুখ এ আসবি। আমরাও যাবো।

- সত্যি মা। তুমি অন্য রকম। একদম অন্য রকম। তোমার মতো করে কজনে ভাবে। আমি এতদিন বিয়ে নিয়ে একটু খুশি ছিলাম। এবার থেকে মা বাবা কে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে একটু কষ্ট ও হচ্ছে। যেমন কষ্ট শ্রেয়ার হচ্ছে।

সমাপ্ত




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ