অকৃতজ্ঞ পর্ব ২
নীল আর নিশাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে রিতা দেবী বলেন, বৌমা, অনেক হয়েছে, সেই ভোর থেকে উঠে চরকির মতো সারা বাড়ি ঘুরছো, এখনো পর্যন্ত দানা- পানি পড়ে নি পেটে। চলো ডাইনিং এ গিয়ে বসো, আমি তোমার জন্য দুধ গরম করে নিয়ে আসছি। নিশার ওপর অভিমান করে নীল বললো, সেই কোন ভোর বেলায় উঠেছ এখনো কিছু খাও নি? এইরকম অনিয়ম করলে তো অসুবিধা। ডাক্তার বাবু বারবার বলেছেন, এই সময়টায় ভালো ভালো খেতে হবে। আর তুমি নিজেই নিজেকে অবহেলা করছো?
নিশা ঠোঁট দুটো চেপে মুচকি হেসে নীলের গাল দুটো টিপে বললো, অনিয়ম কি আর রোজ রোজ করি মশাই, তুমি তো প্রতিদিন আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই হেলথ ড্রিংক নিয়ে এসে আমায় ঘুম থেকে তোলো।
- কিন্তু আজ কি বিশেষ দিন সেটা তো বলবে নিশা। কখন থেকে জানতে চাইছি তোমার থেকে। আর সাসপেন্স ধরে রাখতে পারছি না। প্লিজ এবার বলো।
কিচেন থেকে নিশার জন্য দুধের গ্লাস, আর নীল এর জন্য এক কাপ কফি নিয়ে এসে রিতা দেবী বললেন, আজ নিশার বোন উষা আসছে । ওর আজ জন্মদিন। অনেক দিন পর আসছে, তার ওপর ওর আজ জন্মদিন তাই এইসব আয়োজন। আসলে মা মরা মেয়ে তো, কোনোদিন সেইভাবে জন্মদিন পালন করতে পারে নি তাই নিশা আমার থেকে পারমিশন নিয়েই এইসব করেছে। তবে আমি কিন্তু জানতাম না এত টা বাড়াবাড়ি করবে। তাহলে তোকে অবশ্যই জানতাম। নিশাই আমায় বলেছিল তোকে যেন আগে থেকে কিছু না বলি।
- ওও... এই ব্যাপার... তাহলে তো দারুন হবে। আজ তাহলে অফিস আর যাচ্ছি না। তাহলে আজ স্পেশাল কি মেনু আছে?
- পেটুক কোথা কার একটা...দুধে চুমুক দিয়ে নিশা বললো নীল কে। আসলে তেমন কাউকেই তো বলি নি। উষা ছোট থেকেই ফুল খুব ভালোবাসে আমারই মতো। তাই একটু বাড়ি টাকে সুন্দর করে সাজালাম। অনেক দিন পর ও আসছে, বলতে গেলে এই প্রথম বার ও আমাদের বাড়ি আসছে। তাই ধরে নিতে পারো ওকে ওয়েল কাম করার জন্য এই ব্যবস্থা।
আসলে নিশার থেকে উষা প্রায় দশ বছরের ছোট। ঊষার যখন বয়স মাত্র তিন বছর তখনই ওর মা মারা যায় একটা দুর্ঘটনায়। তখন থেকেই ওর দেখাশোনা নিশাই করতো। কিন্তু নিশার বয়স ও ছিল তখন মাত্র তের বছর। ওইটুকু মেয়েই বা একটা বাছার কত আর খেয়াল রাখতে পারবে। তাছাড়া নিশার বাবাও একজন বিজনেস ম্যান। তাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে ওনার একটি বড় রেস্টুরেন্ট ছিল। তাই ওনার পক্ষেও দু মেয়ের সম্পূর্ণ খেয়াল রাখা সম্ভব ছিল না।
তাই নিশার বাবা প্রিয়জিত বাবু ঠিক করলেন ঊষাকে বোর্ডিং এ রেখে পড়াশোনা করাবেন। সেই মতো মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ই ঊষাকে ওর বাবা মুম্বাই এ ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেন। এবং সেখানেই থেকে ও পড়াশোনা করে। তাই দিদির বিয়ের সময় এর পর উষা পড়াশোনার চাপের জন্য আর দিদির বাড়ি আস্তে পারে নি। গত কাল হটাৎ ই উষা ফোন করে জানায় যে কলেজের ফাইনাল এক্সাম শেষ। কালই সে নিশার বাড়ি আসবে।
নিশা মনে মনে ভাবল ভালোই হলো। কোনোদিন ই সেইভাবে সে ঊষার জন্মদিন সেলিব্রেট করতে পারে নি। কারণ কোনো বছরই উষা জন্মদিন এর দিন ছুটি নিয়ে আসে নি। তাই কাল যখন ওর জন্মদিনের দিন এই বাড়ি তে আসছে তখন একটু ঘরোয়া ভাবেই ভালো ভালো রান্না করা হবে, ঘরোয়া আনন্দ করা হবে।
সব শুনে রিতা দেবী কোনো আপত্তি করেন নি। বরঞ্চ বলেছেন, ভালোই তো মা মরা বোন তোমার। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বরাবরই বঞ্চিত মেয়েটা। জন্মদিন এ একটু ভালো মন্দ রান্না হলে ওর ও ভালো লাগবে। তাছাড়া মায়ের অনুপস্থিতিতে বড় দিদি ৰাই তো মা হয়ে ওঠে।
সকাল থেকে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। নিশা ঘন ঘন মিনু পিসি কে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। যাতে নিশা হাতের কাছে সমস্ত যোগান খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যায় ও উষা আসার আগেই চটপট রান্নাবান্না শেষ করে ফেলতে পারে। রিতা দেবীর বারংবার বারণ করা সত্ত্বেও নিশা আজ নিজেই সব রান্না করছে। নিশার এই রকম জেদের কাছে জেরবার রিতা দেবী। বাধ্য হয়েই নীল ও যথাসাধ্য নিশা কে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে।
- নিশা, তোমার কিন্তু ওষুধ খাওয়ার টাইম হয়ে গেছে। রান্না এখন বন্ধ রাখো। আগে কিছু খেয়ে ওষুধ টা খাবে চলো।
করাই এ মটন টা কষতে কষতে ব্যস্ত গলাতে নিশা বললো, একটা দিন একটু আগে- পিছু ওষুধ খেলে কিছু হবে না নীল।
নিশার অবহেলা গোছের কথা গুলো শুনে হন্তদন্ত হয়ে নীল রান্না ঘরে গিয়ে দিলো ওভেন টা অফ করে।
- এ বাবা! এ কি করছো নীল? ওভেন টা অফ করে দিলে কেন? উষা এখুনি চলে আসবে । এখনো সব কমপ্লিট ই করতে পারলাম না। তুমি সরো এখন এখান থেকে নীল।
নিশার হাত টা ধরে, নীল বলল না আমি যাবো না। আগে তুমি কিছু খাবে চলো। এখনো প্লেন ল্যান্ড করার সময়ই হয় নি। আর তুমি এখন থেকেই হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছো। শান্ত হয়ে আগে কিছু খেয়ে নাও। তারপর ধীরে সুস্থে রান্না করবে। এখনও অনেক টাইম আছে।
নীল , নিশার হাত টা টানতে টানতে রান্নাঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসতে উদ্ধত হলো।
- আরে, কি করছো কি নীল, ছাড়ো।
- তোমার আর কোনো কথা শুনতে চাই না নিশা। চুপচাপ চলো।
নিশা সহাস্যে বললো, আরে, হাত টা তো কম সে কম ধুতে দাও।
এবার দুজন ই দুজন এর দিকে চেয়ে স্নিগ্ধ ভাবে হাসলো।
বেসিনে হাত ধুয়ে নিশা বাধ্য মেয়ের মতোই ডাইনিং এ এসে বসলো। এতক্ষন রান্নাঘরে থেকে ওর সারা শরীর পুরো ঘেমে গিয়েছিল। কপালে, নাকের ডগায়, ঠোঁটের উপরিভাগে এখনো বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট জানান দিচ্ছে নিশা এখন সত্যিই বেশ ক্লান্ত।
চলবে....
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ