নীরবে ভালোবাসি ১৮
পরের দিন প্রবাল স্যার এর কাছে পড়তে গিয়ে শুভ্র কে দেখা মাত্রই শ্রেয়ার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল।না শ্রেয়ার চোখ মুখের আমূল পরিবর্তন শ্রী এর চোখ এড়ালো না। সকালের মিঠে সূর্যের আলোয় শুভ্রর মুখটা আরো বেশি হলুদে ফর্সা লাগছে। যদিও এখন সকাল আট টার বেশি বাজে নি। কিন্তু গ্রীষ্মের এই সকাল বেলাতেও সাইকেল চালিয়ে এসে শুভ্র কপাল বেয়ে ঘামের একটা রেখা সোজা গাল বেয়ে নেমে গেছে। শুভ্র কোনো ক্রমে সাইকেলটা সাইডে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছলো। শ্রেয়া তখন ও প্রবাল স্যারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রী ছাড়াও আরো কয়েকজন এর সাথে আড্ডা দিছিলো। যদিও এই আড্ডায় এখন শ্রেয়ার মন নেই। শ্রেয়াকে ইতস্তত করতে দেখে একবার ঘাড় এলিয়ে শ্রী দেখে নিলো খানিকটা দূরত্বে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে ওর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছে। এরপর শ্রী একটু মুচকি হেসে শ্রেয়ার দিকে তাকালো। শ্রেয়া নিজেকে ধরা না দেওয়ার জন্য পুনরায় তাদের আড্ডায় মনোনিবেশ করলো। কিন্তু মন কে বারবার জোর করলেও সে পারলো না আড্ডায় মনোযোগ দিতে। এইদিকে শ্রেয়া আবার আড় চোখে লক্ষ্য করলো শুভ্র তার দিকেই এগিয়ে আসছে। উত্তেজনায়, ভয়ে শ্রেয়ার হার্টবিট তখন দ্রুত গতিতে চলছে। শুভ্র একেবারে শ্রেয়ার মুখোমুখি আসতে ই শ্রেয়া চোখ বুঝে ফেললো। কিন্তু ব্যাগের চেন খোলার শব্দে শ্রেয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলল। ততক্ষনে তার সব বান্ধবীরা উৎসুক হয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।
- এই নে শ্রেয়া, তোর অংকের খাতা টা। - এই বলে শুভ্র , শ্রেয়ার খাতা টা হাত বাড়িয়ে দিল।
অন্য দিন শ্রেয়া ক্যাজুয়াল ই খাতা নিত। কখনো দু- চারটে কথাও বলতো। কিন্তু আজ হাত টা আগিয়ে খাতা টা নিতেও ওর হাত কাঁপছিল। শুভ্রর দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগছিলো। কোনোরকমে খাতাটা নিয়ে সে ব্যাগে ভোরে নিলো। তৎক্ষণাৎ তার শ্রী এর বলা কথা গুলো মনে পড়লো। অন্যসময় এ যে কথা গুলো শ্রী এর মুখ থেকে শুনে শ্রেয়ার ভারী রাগ হতো আজ সেই কথা গুলোকেই তার মনকে বড় বেশি উতলা করে তুলল। প্রবাল স্যারের পড়ানো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেয়া বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। কিন্তু ব্যাচ শেষ হওয়ার পর অনন্য দিনের মতো শ্রী আরো বান্ধবী দের সাথে আড্ডা দিতে দিতে ধীরে ধীরে আসছিল। শ্রী এর হাঁটার গতিবেগ দেখে শ্রেয়া ধৈর্য হারা হয়ে বলল,
- কিরে, পড়তে আসার আগে তো ওতো গল্প করলি এখনো কি তোর গল্প শেষ হলো না?
শ্রেয়ার এই অস্হির মনোভাব আজ শ্রী কে বেশ অবাক করে দিলো।
অন্যান্য বান্ধবীদের আড্ডা থেকে পিছিয়ে এসে শ্রী ভ্রু কুচকিয়ে চোখ সরু করলে বললো তোর কি ব্যাপার বলতো শ্রেয়া? আজ - কাল তোকে বড্ড বেশি অদ্ভুত মনে হচ্ছে। কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
- কি সব যা- তা বলছিস । আজ থেকে তো স্কুল স্টার্ট । তাই বলছি তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে আবার রেডি হয়ে বেরোতে হবে তো।
- সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আজ তো দেখলাম সর্বক্ষণ চোখ দুটো তোর সবসময় শুভ্র র দিকে ...
- এমন দেব না। চুপ কর। ওরা শুনতে পেলে একটা কান্ড হয়ে যাবে।
এর মধ্যেই শুভ্র দের দলটা শ্রেয়া দের পাশ দিয়ে হুল্লোড় করতে করতে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
শ্রী আবার একবার মুখ চেপে হাসলো।
- আবার হাসছিস তো?
- হাসব না? হাসার মতো ব্যাপার ঘটলে হাসি যে পাবেই।
- কি হাসার মতো ব্যাপার ঘটলো শুনি। বিরক্তির ভঙ্গিতে শ্রেয়া বললো।
- দেখলি না , শুভ্র কেমন আমার দিকে কেবলার মতো তাকিয়ে গেল। বেচারা আমার থেকে হেল্প চায়। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে না
- তোর থেকে আবার কি হেল্প নেবে শুনি?
- হেল্প কি শুধু তোর মত ব্রিলিয়ান্ট মেয়েদের থেকেই নেওয়ার আছে। আমি অংকে জিরো বলে কি আমি হিরোগিরি তেও জিরো নাকি। আরে, শুভ্র আমার থেকে হেল্প চায় যাতে তোর সাথে ওর ইয়ে টা করে দিতে পারি। কিন্তু আমি বাবা কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। তোমাদের নিজেদের ব্যাপার তোমরা মিটিয়ে নাও।
- ধুর বাজে বকছিস অনেক্ষন ধরে। বাড়ি চলে এসেছি। যা তাড়াতাড়ি স্কুলের জন্য রেডি হয়ে নে। আমায় যেন আবার তোর জন্য ওয়েট করে না থাকতে হয়।
- হম্ম। এখন তো স্কুল যাওয়ারও খুব তারা দেখছি। গিয়েই আবার চোখে চোখে প্রেম করা শুরু করে দেবে।
শ্রেয়া চোটে গিয়ে শ্রী কে একটা চাটি দিতে যাচ্ছিল কিন্তু শ্রী সেইসময় টুকু না দিয়েই কথাটা বলেই বাড়ির দিকে দৌড় দিলো।
ঘরে এসে শ্রেয়া খাতার পাতা উল্টে তন্নতন্ন করে প্রেম পত্র খুজল কিন্তু কিছুই লেখা পেল না। শ্রী একবার বলেছিল শুভ্র প্রেম পত্র লিখে দেওয়ার জন্য শ্রেয়ার কাছ থেকে খাতা নেয়। রাগে- অভিমানে শ্রেয়ার চোখে জল এসে গেল। মনে হচ্ছিল খাতা পত্র ছিড়ে কুটিকুটি করে দিতে। যে আয়নার সামনে গত কাল দাঁড়িয়ে নিজের চোখের মধ্যে স্পষ্ট প্রেমের প্রলেপ দেখেছিল। আজ সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই সেই চোখেই অরুধারার স্রোত দেখলো।
সেইদিন আর স্কুল গেল না শ্রেয়া। ফোন করে শ্রী কে বলে দিল।
আস্তে আস্তে দিন যত এগোতে থাকলো শ্রেয়া আরো বেশি শুভ্রর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। এখন সে নিজেই অপেক্ষা করে থাকে শুভ্র কবে আবার তার কাছ থেকে খাতা চাইবে। শ্রী এতদিনে জেনে গেছে শ্রেয়ার মনের কথা। ও অনেকবার শ্রেয়াকে বলেছে শুভ্রকে এই ব্যাপারে কিছু জানাবে কি না। কিন্তু শ্রেয়া বারণ করে দিয়েছে। এখন বান্ধবীরা শ্রেয়া কে শুভ্র র নামে রাগা লে সে আর আগের মত চোটে যায় না। মনে মনে ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করে। এইদিকে ইদানিং মেয়ের সাজের বহর বেড়েছে দেখে আশা দেবীর মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটে।
- ব্যাপার কি শ্রেয়া? এই বারে ও এত কম নম্বর কি করে হলো?
ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকেই লক্ষ্য করছি তুই অন্য রকম হয়ে গেছিস। আমি এত পরিশ্রম করছি, প্রাইভেট টিউটর রা বিনা পয়সায় পড়াচ্ছেন। আর তুই এই তার মূল্য দিছিস?
নাইন থেকে টেনে উঠলি অংকে তোর ওতো গুলো নম্বর কমে গেল। তুই আগে তো এমন পড়াশোনায় অমনোযোগী চিলিস না। তবে এখন কেন তীরে এসে এইরকম করছিস?
আর আজ তোর মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে আমার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। সব বিষয়েই এত এত নম্বর কম। তুই তো আগে এমন নম্বর পেতিস না। পড়াশোনায় এত অমনোযোগী ও হতিস না। তোর প্রবলেম টা কি হচ্ছে বলতো?
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ