নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১৯
মায়ের দিকে একটা বিরোক্তিসূচক চাওনি দিয়ে শ্রেয়া, তার মাকে অগ্রাহ্য করেই সযত্নে তার মায়ের কথা গুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের লাগোয়া এক ফালি ব্যালকনি টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আশা দেবী তৎক্ষণাৎ শ্রেয়ার হাত টা ধরে সজোরে টান দিলেন। আজ আশা দেবী রাগে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আর এটা হওয়া টাই স্বাভাবিক। নিজের জীবনের এক মাত্র অবলম্বন যখন এইভাবে ধীরে ধীরে উচ্ছন্নের দিকে এগিয়ে যায় , তখন কারোরই মাথার ঠিক থাকে না।
আশা দেবী উত্তেজিত হওয়ার সাথে সাথে শ্রেয়ার ব্যবহার দেখে অসহায় ও হয়ে পড়েন। যে মেয়ে কোনোদিন মায়ের মুখের ওপর কোনো তর্ক করা তো দূরে থাক, মায়ের একবিন্দু পরিশ্রম সহ্য করতে পারতো না, সেই মেয়ে আজ তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে এইসব দেখে তার মাথার ভিতর টা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে শুরু করে দিলো। যে মেয়ে তার মায়ের সাধারণ থেকে অতি সাধারণ শারীরিক কষ্টের সময় সারাদিন , রাত তার মাকে আগলে রেখে কচি কচি হাত দিয়ে জল পটটি দিয়েছে কপালে, নরম আঙ্গুল গুলো দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, সেই মেয়ের কাছে এই মুহূর্তে তার কোনো মূল্যই নেই? শ্রেয়ার এইরূপ আচরণ দেখে তার বুকের ভিতর টা হু হু করে জ্বলতে থাকে। শ্রেয়া কে আর মিথ্যে বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে আশা দেবী বিছানার পায়া ধরে মেঝেতে বসে পরে।
শ্রেয়া ভিতর থেকে ভয় পেলেও ওপর ওপর তার রাগ টা পূর্বের মতোই প্রকাশ করতে থাকে।
- মা, তুমি আজকাল বড্ড বেশি আমার পড়াশোনা নিয়ে উতলা হয়ে পড়ছো। আমার মোটেও ভালো লাগছে না।
- কি বললি তুই? আমি উতলা হয়ে পড়ছি? আশা দেবী ধড়মড় করে মেঝে থেকে উঠে শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে বললো, আমি তোকে ছোট থেকে যা কষ্ট করে , অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষ করছি তা তো কোনো কিছুই তোর অজানা নয়। বিনিময়ে তোর থেকে কিছু চাই নি। পড়াশোনায় যাতে তোর বিন্দু মাত্র ক্ষতি না হোক আমি তাই জন্য তোকে কোনো সংসারের কাজ করতে দিই না । আমি কাজে বেরোনোর আগে যতটা পারি করে রেখে যাই। আবার এসে করি। আমার স্বপ্ন আমি তোকে অনেক লেখাপড়া শেখাব, ভালো চাকরি করবি তুই। ব্যাস এইটুকুই । আর তুই আমার প্রতিটা আশা এইভাবে শেষ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস? বল তুই । উত্তর দে।
আশা দেবীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বিছানায় রাখা মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট টা তখনও পাখার হওয়ায় পত পত করে উড়ছে। শ্রেয়া মায়ের মুখের দিকে তাকাতে সাহস পেল না। মা কে দেখে তার ভিতর টা মোচড় দিয়ে উঠলেও মুখে সেই বেপরোয়া কথার বন্যা বয়ে চলল সমানে। শ্রেয়া মায়ের দিকে না তাকিয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমায় সবসময় আমার পড়াশোনা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। তুমি না আগের থেকে বেশি খিটখিটে হয়ে গেছ। দেখ আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমার ভালো মন্দ এখন আমি নিজেই বুঝে নিতে পারবো। হ্যা, এবারে একটু নম্বর গুলো কম এসেছে পরের বারে ঠিক হয়ে যাবে। ওসব নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না।
- এই সবে ক্লাস টেন এ পরিস তুই শ্রেয়া। এখনই নিজের ভালো মন্দ বোঝার তোর বয়স হয় নি। আর তুই যা আমার মুখের ওপর কথা বলছিস আজ কাল, তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে তুই কতটা বেয়াদপ হয়ে গেছিস। আমার কোনো কথাই তোর এখন ভালো লাগবে না। বিষের মতো কানে গিয়ে বিধবে। এই বয়েস্ টাই খুব মারাত্মক। যারা নিজেকে সংবরণ করে ভালো ভাবে চলতে পারে তারাই উন্নতি করে, আর যারা বেপথেই এগিয়ে চলে তাদের ভবিষ্যৎ টাই তলানিতে চলে যায়। আমি কিসের ইঙ্গিত করছি আশা করি তুই বুঝতে পারছিস। খোলসা করে বলার নিশ্চই দরকার নেই।
মায়ের কথার প্রতিটা অর্থ শ্রেয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। নিজেকে কোন মতে সামলে সে প্রত্যুত্তরে বললো, তুমি যা ভাবছো মোটেও ওসব কিছু না। এইরকমই সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে শ্রেয়া দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাথরুমে ঢুকেই কলটা জোরে চালিয়ে দিলো সে। চোখে - মুখে ভালোভাবে জল দিলো। এতক্ষন ধরে যে কান্নাটা তার মায়ের সামনে নিজের বুকের মধ্যে অতিকষ্টে চেপে রেখেছিল সে। তা এখন ঝরে পড়তে থাকলো অঝোর ধারায়। আয়নার সামনে নিজের মুখ টা দেখা মাত্রই সেই কান্নার বেগ বেড়ে ফোঁপানিতে পরিণত হলো। এই প্রথম সে মায়ের সাথে এইরকম রুরর ব্যবহার করল।
- মা , আমি কিন্তু আদেও তোমায় কষ্ট দিতে, কাঁদাতে চাইনি মা। আমি কেন যে তোমার সাথে ওইরকম ব্যবহার করছিলাম আমি নিজেই জানিনা মা। ইদানীং আমার কি যে হয় আমি নিজেই বুঝতে পারি না। পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না। আয়নার দিকে এক মনে তাকিয়েই শ্রেয়া আনমনে নিজের সাথে এইসব কথা বার্তা বলতে থাকল।
মা আমি তোমায় যতই কষ্ট দিয়ে থাকি, তুমি বিশ্বাস করো আজ ও আমি তোমায় আগের মতোই ভালোবাসি। আমি ছাড়া যেমন তোমার জীবনে আর কিছু নেই। তেমনই তোমায় ছাড়াও যে আমার কোন অস্তিত্ব নেই।
আসলে বয়সন্ধিকালে র এই সময়টাই এইরকমই বেপরোয়া। যার ছায়া পড়েছে শ্রেয়ার জীবনেও। মুখে যা খুশি বললেও নীরবে সে মা কে খুবই ভালোবাসে।
কি রে, শ্রেয়া তোর ও এই বারে অংকে এত কম নম্বর এলো আমি তো ভাবতেই পারছি না।
- সব সময়ই যে ভালো নম্বর পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি শ্রী?
- আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ছোট থেকেই তো দেখে আসছি তোকে। হটাৎ এই পরিবর্তন যেন মেনে নিতে পারছি না।
শ্রেয়া আর কোনো জবাব না দিয়ে টিফিন বক্স খুলে খাওয়ায় মন দিলো।
- কি হলো একাই খেতে আরম্ভ করে দিলি যে?
- তোকে কি নিমন্ত্রণ করে খেতে বলতে হবে নাকি? খাবি তো চলে আয়।
-তোকে আজ একটা কথা বলব বলে ভালো সময়ের সুযোগ খুজিলাম। ভাবলাম স্কুল আসার পথেই বলবো । কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো টিফিন টাইমে বলা টাই যুক্তিসঙ্গত হবে।
-আর ভনিতা না করে বল। কি এমন কথা যে দিন খন স্হান বিচার করে বলতে হবে।
মুখে এক টুকরো লুচি আর কুমড়োর তরকারি শ্রেয়ার টিফিন বক্স থেকে তুলে মুখে চালান করে দিয়ে চিবতে চিবতে শ্রী বললো, এই খানে বললে অসুবিধা হবে আগের বেঞ্চে অনিন্দিতা, কেয়া আছে । শুনতে পেয়ে যাবে। ওই কোনের দিক টা য় চল। মুখে রাখা লুচির টুকরোটা না চিবিয়েই কৌতূহল এর সঙ্গে শ্রেয়া জিজ্ঞাসা করলো কি এমন কথা রে ?
- আরে, সেটাই তো বলতে চাইছি তখন থেকে। ঐদিক টায় চল না।
- কেন এখানে বললে কি হবে? ওরা তো আগের বেঞ্চে আছে। নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। ওরা কিছু শুনতে পাবে না। এখানেই বল।
- যা! আমি বলবো না। তোকে শুনতে হবে না। একবার ঐদিকটায় যেতে বলছি তা আর তুই গতর নিয়ে নড়তে পারছিস না বল। ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানিসুরে বলে শ্রী মুখ ফিরিয়ে শ্রেয়ার উল্টো দিকে গিয়ে বসল।
- শ্রেয়া খানিকটা মুচকি হেসে বললো, ওরে কি বলবি তাড়াতাড়ি বল। এখুনি টিফিন শেষ হয়ে যাবে। আর দশ মিনিট বাদেই ঘন্টা পরে যাবে। তোর গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময় পেরিয়ে যাবে।
শ্রী আচমকাই ঘুরে এসে শ্রেয়ার হাতে থাকা টিফিন বক্স টা সজোরে বন্ধ করে বেঞ্চের উপর রাখলো। শ্রেয়া অবাক হয়ে শ্রী এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
শ্রী এর অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে- সেই থেকে বলছি ইম্পরট্যান্ট কথা আছে। গিলে যাচ্ছে তো গিলেই যাচ্ছে। রাখ তো তোর টিফিন। চল আমার সাথে। বলে শ্রী টানতে টানতে শ্রেয়াকে কোনের দিকে নিয়ে গেল। সজোরে টিফিন বক্স রাখার আওয়াজে আগের বেঞ্চিতে আড্ডা দেওয়া অনিন্দিতা, কেয়া রা পিছন ফিরে তাকালো। তাদের দেখে শ্রেয়াই বললো, কোন টায় নয়। চল বাইরে টায় গিয়ে বলবি ।
- স্কুলের মাঠে বসে?
- হ্যা
- একদম নয়।
- কেন
- ওখানে এখন শুভ্র রা ক্রিকেট খেলছে। তুই ওর দিকেই সব ধ্যান, মন দিয়ে বসে থাকবি। আমার কথা গুলোয় মন দিতে পারবি না।
- অনেক হয়েছে। যা বলার আছে বলে তো। আমি আর জাস্ট তোর অত্যাচার নিতে পারছি না।
চলবে..
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ