নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১৬

love silently part 16


আগের পর্ব পড়ুন 

নীরবে ভালোবাসি পর্ব ১৬


- মধুপুরের কথা আবার মনে থাকবে না ? ওখানেই তো আমার জন্ম। সেখানেই যে আমার ছোটবেলাটা গাছে চড়ে, মাঠ-ঘাটে ঘুরে, নদী- পুকুরের জল ঘেঁটে কাদা মাটিতে বড় হয়েছি। ওখানেই তো প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। 

- সত্যি খুব ভালো ছিলো গো গ্রাম টা। শ্বশুর মশাই এর ভিটে বলে কথা। কত স্মৃতি, কত আবেগ জড়িয়ে আছে । তখন কত আর বয়স আঠারো কি উনিশ বিয়ে হয়ে সেই প্রথম মধুপুরে আসা। -- খাবার দিতে দিতে শুভ্র র মা রেণুকা দেবীর মনটা উদাস হয়ে যায়। তখন শ্বশুর, শাশুড়ি মা কে নিয়ে ছিল আমার ভরা সংসার। ওখানে আমাদের চাষের জমি ছিল। ধান, আলু, তিল , টুকটাক সারা বছরই সবজি র চাষ হত। কোনো কিছুই কিনে খেতে হত না। বাড়ির লাগোয়া উঠোন জুড়ে থাকতো লঙ্কা গাছ, বেগুন গাছ। উঠোনের এক পাশে মাচা তৈরি করে শীত কালে হতো শিম গাছ। কার্তিক মাসে সিম গাছে যখন বেগুনি রং এর সিম ফুলে মাচা ভোরে যেত কি অপূর্ব লাগতো দেখতে। মায়ের অবশ্য খুব ফুল গাছের শখ ছিল। বাহারি ফুল না পাওয়া গেলেও প্রতি বছর মা নিয়ম করে গাঁদা ফুলের গাছ, দপটি ফুলের গাছ বসাতেন। নানা রঙের দপটি ফুলের মেলায় মনে হত উঠোন টা জুড়ে হয়তো লাল, গোলাপি, সাদা আবির ঢেলে দেওয়া আছে। এখানে তো আর সেইরকম জায়গাও নেই যে মনের মতো দুটো ফুল গাছ বসাবো। 

- কেন? ব্যালকনি তে ওতো ঝুলবুলি লতানো গাছ, বাহারি ফুল গাছ, এলোভেরা গাছ এমনকি টবে ধনেপাতা, টমেটো, লঙ্কা চাষ করেছ তাতেও বুঝি তোমার শখ মিটছে না রেণুকা?

- তুমি থামতো। আমি হলাম গ্রামের মেয়ে। গ্রামের বউ। কাদা মাটি মেখে মাঠ ময় করে ঘুরে বেড়াতাম। আমার এই ছোট্ট ব্যালকনিতে দু - মুঠো মাটিতে গাছ বসিয়ে পোষায় বুঝি। তোমার না চিরকাল এই সব গাছ- পালা তোমার শত্রু। তখন ও দেখেছি মা কোনো গাছকে যত্ন করে বসালে তুমি বলতে এত গাছ পালা বাড়িতে বসানোর কি দরকার। তোমার কাছে গাছ পালা বসানো মানে বাড়িটাকে জঙ্গল করে রাখা। তুমি ওইসব বুঝবে না। 

- দেখছিস তো শুভ্র তোর মা কেমন আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। আমি খারাপ টা কি বললাম শুনি। তুই একবার ব্যালকনি টা দেখে আয় শুভ্র। ওখানে পা রাখার জায়গা নেই। মানুষ ব্যালকনিতে বসে একটু পেপার পরে কিংবা চা খায়। ওখানে সেসবের কোনো অবশিষ্ট জায়গা আছে? চারিদিকে শুধু লতাপাতা ঝুলছে। 

- তোমার আজীবন গাছ পালা, গরু বাছুর এই সব এ তেই এলার্জি।

- এরমধ্যে আবার গরু কথা থেকে উধাও হলো মা? মুচকি হেসে বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে শুভ্র জিজ্ঞাসা করলো। 

- দেখ না, একবার যখন মধুপুরের প্রসঙ্গ এসেছে এবার গরু ছাগল সব কিছু ওর গল্পে উঠে আসবে। 

- মনে আছে আমাদের তখন বাড়িতে তিনটে গরু ছিল। বাবার খুব গরুর শখ ছিল। কিন্তু তুমি একদম গরু-  বাছুর পছন্দ করতে না। আমি বাছুড়কে আদর করলে তুমি রেগে যেতে। বলতে লোম চারদিকময় উড়বে।তোমায় আরো বেশি করে রাগাবার জন্য বেশি বেশি করে গরু - বাছুরের গায়ে হাত দিতাম। ঘরের গরুর খাঁটি দুধের স্বাদ টাই আলাদা। আর এখনে যে গোয়লা দুধ দিয়ে যায় পুরো জলের মতো। সে দুধ অনেক্ষন ধরে  জ্বাল দিলেও তাতে স্বর পরে না। 

- এখনে গরুকে খোল, ভুষি, খর কিনে গরুকে খাইয়ে তবে গরুর দুধ বেচতে পারে গোয়লা। গ্রামের মত বিনা পয়সায় খর, মাঠের কচি কচি ঘাস পাতা পায় না। সবাইকেই এই ভাবেই চলতে হয় শহরে বুঝলে? 

রেণুকা তার প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বললেন না। গ্রামের কথাতেই বিভোর হয়ে রইলেন। 

-  সত্যি ই গ্রামের জীবন ধারাটাই ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।  এখন শহরে এসে  রান্না -বান্না কয়েকটা বাসন ধোয়া ঘর মুছতে ই হাঁপিয়ে যাই। আর গ্রামে থাকাকালীন ভোর বেলায় উঠে ধান সেদ্ধ করতে হত,  সেই ধান আবার উঠোনে কড়া রোদে  নেড়ে চেড়ে শুকেকিয়েছি। তখন তো কতক্ষন রোদে রোদে থাকতে হতো সানস্ক্রিন এর ব্যবহার তখন জানতাম না।আর এখন ২মিনিট ও রোদ সহ্য করতে পারি না।  এখানে তো মুড়ি কিনে খেতে হয়। ওখানে চাল ভেজে বালিতে নেড়ে মুড়ি ভাজতে হতো। তারপর সেই মুড়ি চালনায় চালতে হতো। তারপর খাওয়া হতো। বেশ ভালো ছিলো সেইসব দিন গুলো বলো। কোনো ভেজাল জিনিস পেটে পড়তো না। শাক - সবজির তো কোনো অভাবই ছিল না।।গ্রামের সব বউ- ঝিরা মিলে ছোট নদী পার হয়ে যেতাম শাক তুলতে। নদীতে গরম কালে বেশি জল থাকতো না। ওই হাটু অবধি।ধান চাষ হতো, ধান উঠলেই আলু চাষ হত, তারপর তিল মাঠ ময় তখন  সবসময় সোনার ফসল ফলত। আর এখন তো রেডিমেড চাল বাজার থেকে কিনে আনা হয় আর রান্না করতে হয়। কিন্তু তখন তো আমরা চাষের ধানের চাল খেতাম। ধান ভাপিয়ে সিদ্ধ করে শুকিয়ে সেই ধান ভাঙিয়ে চাল হত। সেই চালে কুড়ো মেশানো থাকতো। কুলোয় করে পাঁচড়ে তবে সেই চাল রান্নার উপযোগী হত। এখন কার মানুষ রা ওতো খাটবে কি? এতেই কথা থেকে কোথায় সময় চলে যায় বুঝতে পারি না। কিন্তু তখন এত কিছু করতে হত। এখন তো বেশির ভাগ মানুষ রাই পিঠে পছন্দ করে না। অত্যাধুনিক বার্গার, প্যাটিস, পাস্তা, নুডুলস, মোমো র যুগ এটা। তখন বাড়িতে লোক জন আসলে পিঠে করা হত। পৌষ মাস জুড়ে চলতো পিঠে উৎসব। তোর দাদু খুব পিঠে খেতে ভালোবাসতেন। এখন তো সব মেশিনেই চাল গুঁড়িয়ে নিয়ে চলে আসে। তখন পিঠে হবে বলে ধান ভাঙিয়ে ঢেঁকিতে চাল কোটা হত। সেই গুড়ি দিয়ে পিঠে করলে তার স্বাদ ই আলাদা। পিঠে খুব নরম হত। সরু চাকালী, রস বরা, গোকুল পিঠে, পুলি পিঠে, দুধ পুলি, পাটি সাপটা নানা ধরণের রান্না করা হত। তখন বাড়িতে অন্য রকম এক আমেজ। সারা গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে তখন পিঠে উৎসব হত। নলেন গুড় তৈরি করা  হত খেজুর গাছের রস থেকে। বাবা প্রতি বছর ধান চাষ করতেন। তোর বাবা কলকাতায় চাকরি করত তাই সপ্তাহে ছুটির দিন আসত।  তাই মাঠের কাজ কারবার কিছুই দেখার সময় পেতনা। তোর বাবা তোর দাদুকে বারবার বারণ করতএই বয়সে ওতো খাটতে হবে না। শরীর সাঁত দেবে না  । তিনি শুনতেন না। তারপর কি যে হলো । সংসারে কিসের যে দৃষ্টি পড়লো একই বছরে তিন মাস ব্যবধানেই বাবা- মা মারা গেলেন। 

- ঠিকই বলেছ রেণুকা। ভাবছি একবার মধুপুর এ যাবো। অনেকদিন নিজের গ্রাম কে দেখি নি। 

- যাবে তো ভালো কথা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কি কোনো পথ তুমি খুলে রেখেছো? বাবা- মা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরেই সমস্ত জমি- জায়গা বিক্রি করে এখানে চলে এলে। গেলে কোথায় গিয়ে উঠবে শুনি। 

- তাও তো বটে ...

- বাবা, প্লিজ...যা হওয়ার নয় সেইসব নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ নেই। তুমি খেয়ে নাও। রুটি ঠান্ডা হয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে গেল। 

- রেণুকা তোমার দুর্গা কাকিমা কে মনে আছে? আমাদের গ্রামে থাকতেন। আমরা ওদের বাড়ি প্রায়ই যেতাম প্রতিটা পালা পার্বণে, অনুষ্ঠানে। 

- বেশ মনে আছে। খুব মনে আছে। ওনাকে আবার মনে থাকবে না। খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন উনি। শুধু কি পালা-পার্বণে যেতে? তুমি তো প্রতিটা সন্ধেয়েই ওদের বাড়ি আড্ডা দিতে যেতে। তখন অবশ্য তাসের আড্ডা টা বসত না। ভয়ংকর বই এর আড্ডা বসত। যা শেষ হতেই চাইতো না। তুমি আর জ্যোতির্ময় দা দুটিতে যা বই পাগল ছিলে তা আর বলার নয়। 

- সত্যি দুর্গা কাকিমার জীবনটা কেমন যেন সদা দুখেই ভরা ছিল বলো? কিভাবে যে উনি মারা গেলেন শেষ পর্যন্ত তা জানাই গেল না। তবে আমার কি মনে হয় বলতো রেণুকা... আমার মনে হয় জ্যোতির্ময় হয়তো সব টা জানত। গ্রামের লোক যতই ওকে পাগলের বিলাপ বলে চুপ করয়ে রাখুক না কেন আমি তো জানি ও প্রকৃত অর্থে ঠিক পাগল ছিল না। ওকালতি তে ওর ছিল বিশাল পান্ডিত্য। 

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ