ঐতিহ্য আর নদী ছোট থেকেই খুব ভালো বন্ধু। ছোট থেকেই ওরা একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে, এমনকি একই জায়গায় টিউশন ও পড়তো। ঐতিহ্য র বাবা ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। সুতোরং আর্থিক দিক থেকে ওরা ছিল প্রভাবশালী। এইদিকে নদী দের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। নদীর যখন বয়স মাত্র দুই বছর , তখনই ওর বাবা ওর মা কে আর ওকে রেখে নিরুদেশ হয়ে যায়। নিরুদেশ ও ঠিক বলা যায় না। এটা নদীকে বোঝানো হয়েছিল।
নদী যে বছর স্কুলে ভর্তি হয় সেই বছর স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে দেখেছিল ওইদিন সবাই মা, বাবা কে নিয়ে প্রোগ্রাম দেখতে এসেছে। কিন্তু নদী শুধু ওর মা কে নিয়ে এসেছে। প্রোগ্রামের পরের দিন স্কুল থেকে প্রতিদিনের মতোই ঐতিহ্য আর নদী একসাথেই স্কুল গাড়ি করে ফিরছিল। হঠাৎই ছোট্ট ঐতিহ্য কৌতূহল বশত নদীকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা নদী তোর বাবা নেই? মানে কাল প্রোগ্রামে সবাই এর বাবা, মা এসেছিল শুধু তোর বাবা কে দেখতে পেলাম না। তাই আর কি...
প্রত্যুত্তরে নদী কেবলমাত্র মাথা নিচু করে দুদিকে ঘাড় নাড়াল।
- ধুস! তুই মিথ্যে বলছিস নদী। হয়তো উনি বাইরে থাকেন তাই আসতে পারেন নি তাই তো?
জলে পরিপূর্ণ দু চোখ ঐতিহ্য এর দিকে মেলে নদী বলেছিল না উনি বাইরে কাজ করেন না। আমি আমার বাবা কে কখনোই দেখি নি। এই বলে নদী চুপ হয়ে গেল।
ঐতিহ্য খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললো, তবে যে আমি আন্টি কে দেখলাম উনি সিঁদুর পড়েছেন?
মা তো রোজই সিঁদুর পরে, তাতে কি হয়েছে ছোট্ট নদী বিরুক্তির সুরে ঐতিহ্য কে বলল।
আরে পাগলী তোর বাবা আছেন বলেই তো তোর মা সিঁদুর পড়েন। নিশ্চই উনি আছেন।
সেদিন ছোট্ট নদী স্কুল থেকে ফিরে ছুট্টে এসে মায়ের কোলে বসে একরাশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে মা, আমার বাবা কোথায়? তাকে আমি দেখি না কেন?
মেয়ের আকস্মিক প্রশ্নে ত্রয়ী দেবী খানিক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যান। কি বলবে ভেবে পান না। অবশেষে তিনি নদী কে বলেন উনি নিরুদেশ। এই বলে আঁচলে চোখের জল মোছে।
তাই তুমি মা, এখনো সিঁদুর পড়ো?
আমায়ঐতিহ্য বলেছে যে আমার বাবা আছেন। নিশ্চই আছেন। ঠিক বলেছে না ও?
ত্রয়ী দেবী মেয়েকে নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। মুখে কিছু বলার সাহস এ কুলোয় না। আসলে ত্রয়ী দেবীর স্বামী তারই অফিসের একজন মহিলা কে বিয়ে করে তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ত্রয়ী দেবী তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেন নি। তিনি মনে করতেন যে চলে গেছে তাকে আইনি নিয়মে বেঁধে রেখে কি লাভ? তাতে করে করে তো তার মন টা তিনি পাবেন না। তাই স্বেচ্ছায় তার স্বামীর পাঠানো ডিভোর্স পেপারে অবলীলায় সই ও করে দেন। আর খোরপোষ দাবিও তিনি করেন নি। তিনি কিছুতেই তার আত্মসম্মান নোয়াতে রাজি নন। তাই নার্সারি স্কুলে পড়িয়ে, টিউশন পড়িয়ে তিনি একাই মেয়েকে বড় করতে চান। কিন্তু আজ ও মনে মনে তার সন্তানের জন্মদাতা কে হয়তো এখনো ভালোবাসেন। তাই জন্যই তিনি সিঁথিতে সিঁদুর দেন। কিন্তু ছোট্ট নদীকে তার বাবার এই রূপ তিনি বলতে চান নি। তাই তাকে বুঝিয়েছিলেন তার বাবা নিরুদ্দেশ। ছোট্ট নদী এইভাবেই বড় হতে থাকল মায়ের অপত্য স্নেহে। ঐতিহ্য আর ও এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব আগের থেকে আরো নিবিড় হয়েছে। দিনে দিনে তারা এখন একে অপরের প্রতি দুর্বলতাটা অনুভব করতে পারছে।
- ঐতিহ্য , আমি বাবা হয়ে তোমায় নিষেধ করছি ওই নদী নামের মেয়েটার সাথে তুমি আর মিশবে না ।
- কিন্তু কেন বাবা? ও আমার খুব ভালো বন্ধু।
- না, ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তুমি জান?
ঐতিহ্য রাগ করে বলে , আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু জানি ও খুব ভালো মেয়ে।
- ওর বাবা একটা চরিত্রহীন। বিয়ের পর অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে। আমি চাই না তার সাথে তুমি কোনো সম্পর্ক রাখ।
- ওর বাবা কি , কেমন তা দিয়ে ওর বিচার কেন করবে বাবা?
- তুমি চুপ করো। আগামী মাসেই তোমায় দার্জিলিং রেখে আসবো। তুমি ওখানে থেকেই পড়াশোনা করবে।
এরপর ঐতিহ্য র সাথে নদীর একবারই মাত্র দেখা হয়েছিল স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা শিমুল গাছের নিচে। বিদায় বেলায় নদী র চোখের জল মানা শোনে নি। অবলীলায় গাল বেয়ে পড়ছিল।ঐতিহ্য প্রানপনে চোখের জল দমিয়ে বলেছিল আবার আমাদের দেখা হবে মিলিয়ে নিস নদী। তুই কিন্তু অপেক্ষা করিস। আমি ঠিক ফিরবই।এরপর কেটে গেছে দশ টা বছর। নদী এবছর ডাক্তারী পাস করেছে। সদ্য একটি সরকারি হসপিটালে প্র্যাকটিস করছে। একদিন হসপিটাল থেকে ফেরার পথে দেখেন রাস্তায় খুব ভীড়। লোকজন দাঁড়িয়ে নানা কথা বলছে। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখেন একটি গাড়ি একসিডেন্ট করেছে। যিনি চালাচ্ছিলেন উনিই গাড়ির মালিক। চারদিকে রক্তয় ভেসে যাচ্ছে। পাশে একজন ভদ্রমহিলা কোলের উপর পুরুষটির মাথা তুলে সকলকে অনুরোধ করছে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মহিলাটির দিকে চোখ যেতেই নদী চমকে উঠলো। ইনই ঐতিহ্য র মা। তড়িঘড়ি নদী এম্বুলেন্স কে ফোন করে হসপিটালে নিয়ে গেল। এমনকি সেই মুহূর্তে রক্তের ও প্রয়োজন ছিল। ঐতিহ্য র মায়ের ও পজেটিভ ব্লাড গ্রূপ নয়। নদীর সাথে ঐতিহ্য র বাবার ব্লাড গ্রূপ মিল দেখে নদী সেদিন ব্লাডও দিলো।
- তোমায় অশেষ ধন্যবাদ মা। তুমি আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা করলে।
- প্লিজ আন্টি এইরকম বলবেন না, আমি একজন ডাক্তার। এটা আমার দায়িত্ব।
- কিন্তু তোমায় যেন কোথায় দেখেছি মা, খুব চেনা চেনা লাগছে তোমার মুখ খানা।
নদী মিষ্টি হেসে বলে আমি ঐতিহ্য র ছোট বেলার বন্ধু।এই বলে একটা প্রনাম করেন। পরের দিন জ্ঞান ফিরলে ঐতিহ্য র বাবা সব শোনেন। এবং নদীর কাছে স্বীকার করেন, একদিন মিথ্যে অহংকার করে ঐতিহ্য কে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম মা। আজ ঐতিহ্য কে আমি নিজেই দেখা করতে বলেছি তোমার সাথে।
- ও এসেছে?
- হ্যা, মা গত কালই দার্জিলিং থেকে ফিরেছে আমার একসিডেন্ট হয়েছে শুনে।
- তোর জন্য ও অপেক্ষা করে আছে। যাবি মা, সেখানে?
- সেই তোদের স্কুলের কাছে শিমুল গাছের তলায় ও দাঁড়িয়ে। আমি কিছুক্ষন পর দুজনকে একসাথে দেখতে চাই আমার কেবিনে।
- বলেছিলাম না নদী , দেখা হবেই। আমি তোর ছিলাম। আজও তোরই আছি নদী। আর দেখ, শিমূল গাছ টাও ঠিক একই আছে। ওই আমাদের প্রেমের সাক্ষহী। আর হ্যা, আমার বাবার জন্য তুই যা করেছিস তার জন্য তোকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। শুধু সারাজীবন এমনটাই থাকিস এইটুকুই চাই।
- আমার প্রতিটা পদক্ষেপ ই আমার এই গবেষক বর টিকে পাশে চাই। থাকবি তো ঐতিহ্য।
- একদম।
দুজনে হাটা দিলো হাত ধরে হাসপাতালের উদ্যেশে।
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ