নীরবে ভালোবাসি পর্ব-৫

 

love silently part 5


আগের পর্ব পড়ুন


নীরবে ভালোবাসি - পর্ব-৫


কিছুক্ষন পর আস্তে আস্তে মায়ের বক্ষ থেকে   মাথা তুলে শান্ত, মৃদু কণ্ঠে সে বললো, মা একটা খুব ভালো খবর আছে।

আশা দেবী চোখ থেকে ধেয়ে আসা নোনা জলের ধারা যুগল দু-গাল থেকে তরি ঘরি মুছে, নাক টেনে, কান্না ধরা গলাতেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি খবর? 

-শ্রী এর বাবা মানে দীপক কাকু শ্রী আর আমার জন্য আর্টস এর সাবজেক্ট গুলো পড়ানোর জন্য একজন ভালো প্রাইভেট টিচারের খোঁজ নিয়েছেন।

-টিচার মাত্রই ভালো হয় শ্রেয়া। সে আমি বিলক্ষণ জানি। আর যারা বলে এই টিচার ভালো নয়, ওই টিচার কম পড়া বোঝান, তাই নম্বর কম আসে তাদের এই গুলো নিজেদেরই গলদ বুঝলি? নিজেরা ঠিক মতো পড়াশোনা করবে না, আর বছর শেষে কম নম্বর পেলে অমনি টিচারের নামে দোষ । যতসব আজব ছেলে-মেয়ের দল সব।

-মা, এই তোমার দোষ জানো তো? পুরোটা না শুনেই অহেতুক অনর্গল কথার বৃষ্টিতে বন্যা বইয়ে দাও।

শ্রেয়ার মৃদু ধমকে আশা দেবী এবার উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে শ্রেয়ার দিয়ে তাকায়।

- মা, আমি ওনাকে ভালো টিচার বললাম এই অর্থে উনি দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেন।

মুহূর্তের মধ্যে আশাদেবীর চোখে-মুখে একরাশ আলোর রোশনাই উপছে পড়লো।দু হাতে শ্রেয়ার কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে, চরম উৎফুল্ল তার সহিত বললেন, সত্যি বলছিস শ্রেয়া!  আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না। তাহলে আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। আর আমি এও নিশ্চিত তোর রেজাল্ট ভালোই হবে। 

মায়ের মনে আনন্দের উচ্ছলতা দেখে শ্রেয়ার মনটাও প্রসন্ন হলো।খুশি খুশি মনের আমেজ নিয়ে আশা দেবী রান্নাঘরে গেলেন বাকি কাজটুকু সারতে। আর শ্রেয়াও স্নানের জন্য আনলা থেকে নাইটি নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো।

বিকেলের দিকে আর শ্রী তাদের বাড়ি এলো না। শ্রেয়াকে মেসেজে বললো অনেকদিন পর মা রাজি হয়েছে একটু স্টেশন রোডের দিকে হাঁটতে যেতে। তাই আজ আর তোদের বাড়ি গেলাম না। তুই ও চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারিস ভালোই লাগবে।

প্রত্যুত্তরে শ্রেয়া রিপ্লাই দিলো, না রে, তুই কাকিমা কে নিয়ে ঘুরে আয়। আজ মায়ের ছুটি। তাই মায়ের সাথেই সময় কাটাবো। প্লিজ কিছু মনে করিস না।

শ্রেয়ার মেসেজের রিপ্লাই আসা মাত্রই শ্রী জবাব দিলো, না রে কিছু মনে করি নি। এটাই তো উচিত। সপ্তাহের একদিনই কাকিমা বাড়িতে থাকেন। অবশ্যই তাঁকে সময় দিতে হবে। ওকে বাই।

স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম বরাবর হাটতে হাটতে মা- মেয়ে অল্পবিস্তর গল্প করলো  স্টেশন সংলগ্ন বাজার থেকে  টুকিটাকি কেনাকাটা ও সেরে নিলো। কাঁচা অনাজ থেকে শুরু করে চা-বিস্কুট এর স্টল, লটারীর দোকান,  পুজোর ফুল, সিজনের ফল হেন জিনিস নেই যা বিক্রি হচ্ছে না। 

-মা একটু বেশি করে ঠাকুরের ফুল কিনে নাও।

চোরা সন্দেহের চোখে শ্রী এর দিকে ঘুরে চৈতি বলেন, কেন কি কোনো স্পেশাল পুজো? 

শ্রী ঢোক গিলে নরম কণ্ঠে বললো কাল তো বৃহস্পতিবার, কাল তো ঠাকুর পুজোয় বিস্তর ফুল লাগে। আর তাছাড়া পরশু পরীক্ষার রেজাল্ট। তাই একটু বেশিই ফুল দিয়ে ঠাকুরকে তুষ্ট করতে হবে কিনা...

-ওহ! এই ব্যাপার! মারবো টেনে এক থাপ্পড় ফিসফিসিয়ে চৈতি বললো শ্রেয়াকে। 

মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে চোখ পড়ার মুহূর্তেই শ্রী তার চোখ দুটো অবনত করে নিল।

ফুল কেনা হয়ে যাওয়ার পর মা-মেয়ে হাঁটা দিলো বাড়ির উদ্যেশে। ততক্ষনে সূর্যদেব তার শেষ টুকু আলো ছড়িয়ে পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে। স্টেশন চত্বরের চারদিকে কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠেছে। একটা থ্রু মেল গাড়ি ঝড়ের গতিতে তর্জন গর্জন করে, বিস্তর ধুলো উড়িয়ে, প্লাটফরম কাঁপিয়ে চোখের নিমিষেই বেরিয়ে গেল। পরবর্তী ট্রেনের ঘোষণাও তাদের কানে আসছে।

ফেরার পথেও অল্প বিস্তর কথার অবসরে ট্রেনের ঘোষণা টা শোনার পর শ্রী তার মাকে জিগ্গেস করে, আচ্ছা মা, শ্রেয়ার মা প্রতিদিন এই ট্রেনে বাড়ি ফেরে। সত্যিই ওদের কত কষ্ট তাই না? ওর বাবার কি হয়েছিল মা? তুমি কি কিছু জানো? আমার খুব জানার কৌতূহল হয়। কিন্তু ভরসা করে শ্রেয়াকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারি না। পাছে ও যদি কষ্ট পায়।

-কৌতূহল টা পড়াশোনায় বেশি থাকলেই বোধ হয় ভালো শ্রী। আর ওতোই যদি বুঝিস জিজ্ঞাসা করলে শ্রেয়া কষ্ট পেতে পারে, তাহলে ও বিষয়ে জানার জন্য এত উৎসাহ কেন শুনি?

-মা তুমি বরাবরই খুবই অবুঝ বুঝলে তো? ও কষ্ট পাবে বলেই তো তোমায় জিজ্ঞাসা করলাম।

শ্রী এর কথায় বিশেষ আমল না দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তিনি বললেন, বাড়ির সামনে এসে গেছি। আমার দু হাত ই জোড়া। অনাজ এর ব্যাগ টা পাশে দাঁড় করিয়ে তালা টা খোল।

ঘরে ঢুকতেই বদ্ধ ঘরের একটা ভ্যাপসা গন্ধ তাদের নাসারন্ধে প্রবেশ করলো। 

উফফ! ভিতরটা কি গুমোট গন্ধ রে বাবা! নাক সিটকে কপালের চামড়া কুচকিয়ে বিরক্তির স্বরে বললেন চৈতি। তারাতারি জানালা গুলো খোল শ্রী। নাহলে আমার এখুনি দমবন্ধ হয়ে আসবে। শ্রীর এর মেজাজ ও  অসম্ভব গরমে তিক্ত হয়েছিল। সেও তার মায়েরও অধিক বিরক্তি উগরে বলল, আচ্ছা মা তুমি এইখান থেকে এইটুকু স্টেশন চত্বরে হাটতে বেরোবে, তার জন্য কি কেউ বাড়ির সর্বস্ব জানালা এই ভাবে সপাটে বন্ধ করে যায়? কি এমন মণি-মুক্ত সঞ্চয় করা আছে তোমার বাড়িতে শুনি? 

-এই , তোর খুব পাকা পাকা কথা হয়েছে তাই না? আসলে সব দোষ তোর বাবার। সেই তো  তোকে আশকারা দিয়ে এইরকম মাথায় তুলে ছে। না, বুঝে শুনে বড়ো দের সাথে এইভাবে বড় দের মুখের ওপর কথা বলা কিংবা তর্ক করা বন্ধ কর। এইরকম অভদ্রের মতো আচরণ করলে লোকে তো বলবে বাবা মা ই হয়তো ভালো শিক্ষা দিতে পারে নি। আমি জানালা গুলো বন্ধ করে রেখেছিলাম, এই কারণে যাতে মশা না ঢুকতে পারে। বিকেলের দিকটা অজস্র মশা পিলপিল করে ঢুকে পড়ে। 

নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে শ্রী আর কথা না বাড়িয়ে জানালা গুলো  খুলে আলো জ্বালালো। চৈতি কেনা কাটার ব্যাগ গুলো ডাইনিং রুমের পাশে রেখে ফ্রেশ হতে গেল। 

------------------------------------------------------

-মা, আমরা এইভাবে ভাড়া বাড়িতে আর কতদিন থাকবো? চলো না আমরা মামার বাড়ি চলে যাই। দিদুন তো প্রায়ই আমাদের চলে আসতে বলে। ছোট মামাও তো তোমায় কত বার বলেছে। এই ভাবে মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়ার টাকা গুনতে গুনতেই তো তুমি চোখে অন্ধকার দেখছো। মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করছো। তবু মাসের শেষে এই দুটো পেট চালাতেই তোমায় হিমশিম খেতে হয়। আর আমিও নিরুপায়...

শ্রেয়া, ওই একই ব্যাপার নিয়ে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করিস না। রাতের খাবার তৈরি করতে করতে একরাশ বিরক্তির সাথে উদ্বিগ্ন কন্ঠে আশা দেবী বললেন। 

যতবারই এই আবদার নিয়ে শ্রেয়া তার এই মন্তব্য আশাদেবীর কাছে পেশ করেছে ততবারই সে হতাশ হয়েছে। আশাদেবীর কর্তৃক তিরস্কার ও পেয়েছে বিস্তর। মনের কষ্ট চাপা না রাখতে পেরে পাল্টা ফোন করে দিদুনের কাছে নালিশ ও করেছে মায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু আশা দেবীর অনড় সিদ্ধান্তের কথা শুনে দিদুনের ও যে বুকের ভিতর এ কষ্টের সঞ্চার ঘটছে, কান্নায় বাকশক্তি হ্রাস পাচ্ছে সে টুকু ও বেশ উপলব্ধি করতে তার অসুবিধা হয় নি। সেখানে বরাবরের জন্য না থাকার হেতুটা শ্রেয়া শত চেষ্টা করেও জানতে পারে নি। আর সেটা জানার জন্যই দিন যতই এগিয়ে চলেছে তার মনের  আগ্রহ প্রবল থেকে আরো প্রবলতর হচ্ছে। 

আচ্ছা এইবারে যখন মামার বাড়ি যাবো, ছোট মামাকে একান্তে জিজ্ঞাসা করবো মায়ের ওখানে না থাকতে চাওয়ার কারণটা কি.. তাছাড়া এই ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে দিদুন ই বা কেন ইতস্তত করে।

-কিরে খেয়ে নে। কাল তো চিড়ের পোলাও খেয়ে এসে দুপুরের ভাত কম খেলি, সেই বাড়তি ভাত টুকু রাতে খেতে এত ভালো লাগলো, তাই আজ ও রাতে একটু ভাত ই করে ফেললাম। গরম গরম ভাত ঘি, আলু সিদ্ধ দিয়ে খেতে খারাপ লাগবে না, চটপট হাত ধুয়ে চলে আয়, গরম আলুসিদ্ধয় ফু দিতে দিতে মাখতে মাখতে রান্নাঘর থেকে হেকে বললেন আশা দেবী। 

শ্রেয়ার মন  তখন ও ভাবনার অতল সাগরে মগ্ন ছিল। মায়ের চিৎকারে খানিকটা হতভম্ব হয়ে সে ক্ষনিকের জন্য তার দৃষ্টি আপন ভোলা হয়েই রান্নাঘরের পথ অনুসরণ করল। তারপর ধীরে পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 

-ভাতের থালার সামনে বসেও শ্রেয়ার মন এখন অন্যদিকে প্রসার করছে। 

কিরে, কাল রেজাল্ট আউট হবে বলে আজ কে এত টেনশন করছিস নাকি? তোকে তো কোনো দিন রেজাল্ট নিয়ে এত চিন্তিত হতে দেখি নি কৌতূহলী হয়ে ভাত খেতে খেতে আশা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন।

মায়ের কথার পাহাড়ে ইচ্ছে না থাকলেও শ্রেয়াকে ভাবনার অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো। তার ভাবনার কারণটা শুনলেই যে মায়ের মেজাজ টা আবার বিগড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। তাই খেতে বসার সময় মাকে আর উত্তেজিত না করে, বরঞ্চ নিজেই তার এলোমেলো চিন্তার পাথর গুলো মন থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে খাওয়ায় মন দিলো।

আরে, বেশি চিন্তা না করে খেয়ে নে, ও আমি জানি তোর রেজাল্ট ভালোই হবে। বেশ প্রফুল্লতার সাথে আশ্বাস দিয়ে আশা দেবী বললেন। 

জবাবে শ্রেয়ার গলা দিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে একটু হ্যাঁ বাচক সম্মতিসূচক শব্দ বেরোলো।

...................................................

ফোনটা তার অস্তিত্ব জানান দিতেই ঘুম ঘুম চোখে শ্রী রিসিভ করে ঘুমে আড়ষ্ট গলাতে বললো -হ্যা বল শ্রেয়া। সকাল সকাল ফোন করলি যে? কিছু বলবি?

-বলবো আর কি! আজ তো রেজাল্ট , কটার সময় বেরোবি তাই জিজ্ঞাসা করতে ফোন করলাম। তুই তো মনে হয় এখনো বিছানা ছেড়েই উঠিস নি। 

রেজাল্টের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে শ্রী অন্যান্য ছুটির দিন গুলোর মতোই আত্মসুখে ঘুম দিছিলো।ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শ্রেয়ার কথা গুলো শুনেই তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে সে। চোখ কচলিয়ে আমতা আমতা করে বললো, দশটা নাগাদ চলে আসবি, একসঙ্গে স্কুল যাবো।

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

(ধারাবাহিক টি ভালো লাগলে, লাইক, কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ রইলো। )

ছবি : সংগৃহিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ