নীরবে ভালোবাসি - পর্ব-৪
সদর দরজা পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখা মাত্রই তারা দুজনে দেখতে পেলো প্রবাল স্যার বাইক নিয়ে তাদের দিকে আসছে। প্রবাল স্যার তাদের স্কুলের অংকের টিচার। এমনকি এনার কোচিং সেন্টারেই তারা দুজন পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রবাল স্যারের অকস্মাৎ উপস্থিতি তে শ্রেয়ার মনে আনন্দের বন্যা আছড়ে পড়লেও, শ্রী এর ভিতরটা কেমন যেন শুকনো খরায় পরিণত হলো তৎক্ষণাৎ। কারণ প্রবাল স্যার ই আবার এই বৎসর তাদের বার্ষিক পরীক্ষার অংকের খাতা দেখবে। মুহূর্তের মধ্যেই শ্রী ভাবতে থাকলো আর কয়েক সেকেন্ড যদি পর শ্রেয়া দের বাড়ি থেকে বেরোতাম তাহলে আর এনার মুখোমুখি হতে হতো না। যে মানুষটার কাছে অঙ্ক বিষয়টি নিতান্তই ভয়ের একটি বিষয়, সেই মানুষটির কাছে অঙ্ক সম্পর্কিত যাবতীয় কসর্যকালাপই যে মূর্ছা যাওয়ার একটি বিষয়বস্তু তা বলাই বাহুল্য।
-কিরে, মানিক-জোরে সকাল সকাল কোথায় বেড়িয়েছিস?
প্রবাল স্যারের গম্ভীর গলার স্বরে শ্রী এর সম্বিৎ ফেরে। শ্রী কিছু বলার আগেই শ্রেয়া একগাল হেসে বললো, এইতো স্যার, একটু শ্রী দের বাড়ি যাচ্ছি। শ্রী ও শ্রেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু ঘাড় নাড়ালো মুখে এক চিলতে কৃত্রিম হাসির রেশ টেনে।
-তোকে বলছি শ্রী, এইবারে কপাল জোড়ে অংকে পাশ করবি হয়তো, এবার থেকে একটু মনোযোগ দে পড়াশোনায়। এই বছর নাইনে উঠবি। মানে তার পরের বৎসর ই মাধ্যমিক। সে কথাটা মাথায় থাকে যেন।
প্রবাল স্যারের সব গুলো কথাই শ্রী মাথা নিচু করে শুনলো কিন্তু তাঁর বলা প্রথম কথাখানাই তার মনে গেঁথে গেল। সে তখন প্রানপনে চাইছিল প্রবাল স্যার কখন যাবে। কারণ শ্রেয়ার সাথে যে তার আর্জেন্ট ব্যাপারে পরামর্শ করার মতো বিষয় তার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু প্রবাল স্যার তখনও বলে চলেছেন,
-শ্রেয়া , এই বছর আরো ভালো রেজাল্ট করতে হবে। এই দুটো বছরেই তোর ভবিষৎ নির্ধারিত হবে তুই কি নিয়ে পড়াশোনা করবি। আজ বাদে কাল রেজাল্ট আউট হবে।মাঝে এই কয়েকদিন নিশ্চই বিস্তর আড্ডা দিয়েছিস দুটিতে। যাক, সেইসব নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নে ই। কিন্তু এবার থেকে বি কেয়ারফুল তোদের দুজনকেই বলছি। ভালো করে, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
প্রবাল স্যারের কথা গুলো শুনলে একটা পজিটিভ এনার্জি আসে শরীরে। তার গলার কণ্ঠস্বরের সাথে তার পেশা খানা একদম পারফেক্ট। তিনি যখন ক্লাস চলাকালীন মোটিভিষণাল স্পিচ গুলো দেন, সব স্টুডেন্ট রাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে শোনে। শ্রী এরও তখন শুনতে খুব ভালো লাগে। প্রতিবার উত্তেজক মূলক ইতিবাচক কথাগুলো শুনে তার মনে হয়েছিল এইবার থেকে সিরিয়াস ভাবে অঙ্ক প্রাকটিস করবে। কিন্তু একের পর এক ব্যার্থতা তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। আসলে বরাবরই শ্রী বড্ড বেশি চঞ্চল, ধৈর্য্যহীন। সুতোরাং, চেষ্টা স্বরূপ আশানুরূপ ফলাফল না পেলে সে তৎক্ষণাৎ মন থেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তার এই ভয়ংকর স্বভাব ই তার অংকের পতনের অন্যতম কারণ।
প্রবাল স্যার বাইকে স্টার্ট দেওয়া মাত্রই; শ্রী , শ্রেয়ার হাতদুটো জাপটে ধরে। শ্রেয়া রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, আরে, হাত দুটো রাস্তার মাঝে এইভাবে চেপে ধরলি কেন?
-খুব জরুরি কথা আছে।
-হ্যা, বল। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি। ও ভাবে চেপে ধরে আছিস কেন? কি বলবি বল।
-শুনলি , প্রবাল স্যার কি বলে গেল?
-শুনলাম তো।
-কি শুনলি?
-তুই যা শুনলি, আমিও তাই শুনলাম। অদ্ভুত প্রশ্ন করিস নাতো !
শ্রী এর অদ্ভুত ভঙ্গিমা, আর কথা শুনে শ্রেয়ার মুখ ও পানসে হয়ে গেছে ততক্ষনে। তাছাড়া এক পা একপা করে, তারা ততোক্ষনে শ্রী এ দের বাড়ির সামনে চলেও এসেছে।
-বলছি, প্রবাল স্যার যে আমায় বললো এই বছর হয়তো কপাল জোরে যা হোক করে অংকে পাশ করবি হয়তো। তার মানে কি আমি এইবারে অংকে উতরে গেছি তাই তো?
-হুমম।
-তাহলে স্যার' হয়তো 'কথাটা কেন যোগ করলো বলতো?
শ্রেয়া এতক্ষনে বুঝতে পারলো শ্রী এর মানসিক, শারীরিক হটাৎ অস্থিরতার কারণ। শ্রেয়া এবার শ্রী এর হাত দুটো ছুঁয়ে বললো , উনি আমাদের স্কুলের টিচার, তার ওপর আমাদের কোচিং এর স্যারও বটে। তাই কথাটা একদম স্পষ্ট না বলে ঐভাবে বলললেন। তুই চিন্তা করিস না একদম। প্রবাল বাবুর কথা অনুযায়ী তুই অংকে পাশ করেছিস একদম সেন্ট পার্সেন্ট নিশ্চিত আমি।
শ্রেয়ার অভয় বাণীতে শ্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
রাস্তা থেকেই তাদের আসতে দেখে চৈতি ওপর থেকেই হাকলো,
-তোরা আসতে দেরি করছিলিস দেখে অপেক্ষা করতে করতে আমি আবার ছাদে চলে এলাম শুকনো জামা ,কাপড় গুলো তুলতে। দাঁড়া, দরজা বন্ধ আছে। নেমে খুলছি।
-প্রবাল স্যার কি বলছিলেন রে? আমি ছাদ থেকে লক্ষ্য করছিলাম।
শ্রী আমতা আমতা করে বললো ও কিছু না মা। বলছিলেন নতুন ক্লাসে উঠে মন দিয়ে পড়তে হবে এইসব।
চৈতি আর কথা না বাড়িয়ে শ্রেয়াকে বললো ,
-শ্রেয়া যা, শ্রী এর সাথে ঘরে যা। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
ঘরে ঢুকেই শ্রী টিভি টা অন করলো। এবং নিজেরদের মধ্যে আড্ডা জুড়িয়ে দিলো।
দুই হাতে দু প্লেট ধোঁয়া ওঠা চিড়ের পোলাও নিয়ে চৈতি ঘরে প্রবেশ করলো।
-নে, তোরা খাওয়া শুরু কর। অন্যান্য দিন স্কুলে টিফিন টাইমে যখন খাস তখন তো ঠান্ডা হয়ে যায়। আজ গরম গরম খেয়ে বলবি কেমন লাগলো।
-কাকিমা, তোমার প্লেট টাও এখানে নিয়ে চলে এসো, এক সঙ্গে তিন জনে খাবো।
হাসি মুখে চৈতি বললো, হ্যা খাচ্ছি , আমি একটু পড়ে। তোরা শুরু কর। কিন্তু শ্রেয়া ও শ্রী দুজনেই নাছোড়বান্দা। তাদের সাথেই আজ চৈতি কে খেতে হবে। অগত্যা দুই কন্যার কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। তাদের সাথে তিনিও তার খাবার টা নিয়ে এসে বসলেন।
-এক চামচ চিড়ের পোলাও মুখে চালান করে দিয়েই শ্রেয়া চোখ বুজে হাতের ইশারায় চৈতিকে বললো, খুব ভালো হয়েছে কাকিমা।
চৈতির মুখে তৎক্ষণাৎ তৃপ্তির একটা প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠলো। আসলে যিনি রান্না করেন কোনো সুস্বাদু পদ, তার জন্য পরিমানে কম অবশিষ্ট থাকলেও কোনো আপত্তি নেই, যদি খাইয়ে তিনি হাজার প্রশংসা অর্জন করেন , তাহলে সেই রান্নার পিছনে সমস্ত সময়, পরিশ্রম, গ্লানি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়।
চৈতির মনের অবস্থাও ঠিক এইরকম এইমুহূর্তে।
-শ্রেয়া, তুই তো বরাবরই পড়াশোনায় খুব ভালো, মানছি শ্রী ও মোটেই খারাপ স্টুডেন্ট নয়। কিন্তু শ্রী যে বরাবরই অংকে বেশ কাঁচা। এবার তোরা নাইনে উঠবি। আমার শ্রী কে নিয়ে খুব টেনশন হয়। ওর বাবার খুব ইচ্ছা শ্রী সায়েন্স নিয়ে পড়বে মাধ্য মিকের পর। তুই একটু অবসরে শ্রী কে একটু অঙ্ক গুলো বুজিয়ে দিস।
-ওই একটা ব্যাপারেই ওর খাম খেয়ালীপনা চূড়ান্ত। কিছুতেই ও অংকের সূত্র মাথায় নিতে চায় না। আমি ওকে বোঝাতে চাইলেও ওর চোখে- মুখে তীব্র ফুটে ওঠে অংকের প্রতি ওর ঔদাসীন্য তা প্রবল।
-অঙ্ক বোঝানোর সময় যখনই দেখবি অন্য মনস্ক হয়ে আছে , আমি মা হয়ে তোকে অনুমতি দিচ্ছি শ্রেয়া, দিবি ওর চুলের মুঠি ধরে আচ্ছা করে টেনে।
চৈতির কথা শুনে শ্রী ও শ্রেয়া দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো।
-দেখেছিস শ্রেয়া, তবুও নিলজ্জ টা কেমন নির্বোধের মতো হাসছে।ওর ভালো সবাই চায়। তবু ওর সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। এখন আর কি বুঝবে! সময় পেরিয়ে গেলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে। তখন হা-হুতাশ করবে, আর ভাববে কি মূল্যবান সময়ই না ব্যয় করেছি।
গজগজ করতে করতে চৈতি খালি প্লেট তিন খানা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
-শ্রেয়া, যে কথাটা তোকে বলা হয়নি , আমার বাবা একজন প্রাইভেট টিউটরের কথা বলছিলেন, উনি আর্টস গ্রূপ টা পড়ান। ভর্তি হবি?
-এতদিন তো বাড়িতেই আর্টস এর সবজেক্ট গুলো পড়েছি। এবার তো একটা টিচারের খুবই প্রয়োজন।
-কোন স্যার কে ঠিক করলি?
-আরে, তুই যে স্যার টার নাম বলছিলিস সেই স্যারের কথাই বাবা বলেছিল।
একটু ভেবে, শ্রেয়া বললো, ওহ! মনে পড়েছে, রবিন স্যার তো? রথ তলার মোড়ে বাড়ি?
-হ্যা।
-কিন্তু দুজন প্রাইভেট টিচারের খরচ মা চালাতে পারবে কি জানি না। বোধ হয় খুব প্রেসার পড়ে যাবে মায়ের উপর। যদিও প্রবাল স্যার আমার থেকে খুব কম ই মাইনে নেয়। এমনও হয়েছে কোনো বার পর পর দু-তিন মাস মাইনে দিতে পারিনি। কিন্তু প্রবাল স্যার কোনদিন ও আড়ালেই হোক আর প্রকাশ্যেই হোক আমায় অপদস্ত করেন নি। বরঞ্চ পড়ার শেষে যখন সব ছাত্র-ছাত্রী রা চলে গেছে, মাথা নিচু করে বসে থাকতাম মাইনে টা দিতে একটু দেরি হবে এটা বলার জন্য, ভয়ে লজ্জায় আমার মুখ দিয়ে কথা সরতো না। কিন্তু প্রবাল স্যার আমায় আস্বস্ত করে বলেছেন, শ্রেয়া এখন টাকা পয়সা নিয়ে ভাবার সময় নয়। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ভালো রেজাল্ট কর তাতেই আমি খুশি। যা! বাড়ি যা।
-ওই অতটুকু কথা তেই আমি যে কি তৃপ্তি পেতাম, তা আমি ই শুধু জানি।
শ্রেয়ার ছল ছল চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসায় পরিপূর্ণ তার হাত দু খানি শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে শ্রী বললো
-রবিন স্যার ও তোকে আর আমায় ফ্রী তে পড়াবে বলেছে। বাবা কথা বলে নেবে। তুই চিন্তা করিস না।
শ্রী এর মুখের দিকে শ্রেয়া আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখে মুখে এক রাশ কৌতূহল বিদ্যমান। তার সকল ভাবনার উত্তর এবার শ্রী সবিস্তারে বর্ণনা করলো।
-রবিন স্যার দুঃস্থ অথচ মেধাবী স্টুডেন্ট দের বিনামূল্যে পরান। তোর, আমার দুজনেরই তো আর্টসে ভালোই নম্বর আসে। রেজাল্ট দেখে উনি ভর্তি করে নেবেন।
বাবা , কথা বলতে গিয়েছিলেন, তখন মাইনেটা একটু কম করার আর্জি জানায় ওনাকে। তখন উনি ই বলেছেন, মেধাবী স্টুডেন্ট দের আমি বিনামূল্যেই শিক্ষাদান করি। তাই বাবা, তোর কথাও বলে রেখেছিলেন। উনি রেজাল্ট বেরোনোর পরদিনই দেখা করতে বলেছেন।
-এমন টিচার ও এখানে আছে তাহলে বল শ্রী? আনন্দে আত্মহারা হয়ে শ্রেয়া বললো।
-হ্যা, রে সত্যিই ভাবা যায় না।
-আজ, চলি রে। অনেক গল্প, আড্ডা হলো। গিয়ে আবার জামা কাপড় কাচতে হবে। দেরি হয়ে গেলে আর শুকাবে না।
শ্রেয়ার কথাটা কানে আসা মাত্রই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে চৈতি বললো, দেখে শেখ শ্রী। তোর ই তো বয়সী। নিজের জামা কাপড় নিজেই কেচে নেয়। আর তুই এত বড় হয়ে গেলি এখনো হা-পিত্তেস করে থাকিস কখন মা কেচে দেবে সেই আশায়। নিজের কাজ টা নিজেকেই করা উচিত। শ্রেয়ার কত গুন, আর তুই! তুই এত অবুঝ কেন? কবে বড়ো হবি কি জানি! ভগবান ই জানে!
শ্রী বরাবরই দেখে এসেছে খুব ছোট থেকেই শ্রেয়া ঘরের টুকিটাকি কাজ ও নিজেই করে। আর না করেও যে উপায় নেই। শ্রী এর মা আশা দেবী একটি ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করেন। ভোর ভোর উঠে বাসী কাজকর্ম সেরে দুটো রাধতেই সকাল সাতটা বেজে যায়। তারপর যা হোক নাকে মুখে চারটি খানি গুজেই ট্রেন ধরার জন্য দৌড় দেন। মা-মেয়ের সংসারে অভাব বিস্তর থাকলেও মানসিক সুখ অবাধ।
শ্রেয়াকে এগিয়ে দিতে শ্রী বাড়ির বাইরে এসে বেরোয়।
-বাইরে এখন কি উত্তাপ রে, যখন এলাম ; তখন রোদ এর তেজ টা এতটা ছিল না। আর অসম্ভব ভ্যাপসা গরম ও।
-তুই তো মুখে এক গাদা সানস্ক্রিন ঘষেই বেড়িয়েছিস, চিন্তা কি?
-আবার ইয়ার্কি করছিস তো? তুই মাখিস না? নাহয় তোর মত ওতো ফর্সা টুকটুকে আমি নই। তা বলে কি রূপচর্চা করা যাবে না বুঝি?
শ্রী জানে, এটা শ্রেয়ার অভিমানের কথা নয়, । বরং সেও একটু শ্রী এর ইয়ার্কির সাথে তাল মেলালো। শ্রেয়ার গায়ের রং টা চাপা হলেও সুন্দর টল টলে দুটো চোখের মাঝে সরু নিখুঁত নাসিকার সাথে ওর ঠোঁট দুটোও ভীষণ নিপুন অঙ্কনে ভগবান সৃষ্টি করেছে। আর সে ঐটুকুতেই ভীষণ তৃপ্ত। ওর চাপা রং নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই।
-হ্যা, তা অবশ্য ঠিক রূপচর্চা করার স্বাধীনতা সবাইরি মজ্জাগত। যার ইচ্ছে সেই করতে পারে।
-আচ্ছা, আসলাম রে। বিকেলে পারলে আমাদের বাড়ি আসিস। একা একা বড্ড বোরিং লাগে।
-হ্যা, যাবো। আর তো মাঝে একটা দিন ফ্রী। তারপরেই রেজাল্ট আউট হয়ে গেলে পড়া, পড়া আর পড়া।
-এটা একদম বাস্তব কথা বল লি।
আসি, আসি করেও অবান্তর কথার মেলায় শ্রেয়ার পা দুটো যেন এগোতেই চাইছিল না। আসলে দুটিতে জোট বাধলে এইরকম ই অবস্থা হয়।
-একি! মা, তোমায় বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি সার্ফ এ মাখা জামা-কাপড় গুলো নিয়ে কাচতে বসে গেলে? তুমি কি কোনো কথাই শুনবে না আমার? সপ্তাহে র ছয়দিন তো ডেলি প্যাসেঞ্জারই করে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে ঘরে ফেরো। একটা দিন মাত্র ছুটি পাও সেদিনও তোমার কাজ করতে ভালো লাগে?
মেয়ের দিকে তাকিয়ে চুরিদারের ওড়নাটা পরিষ্কার জলের বালতিতে চুবিয়ে নিগড়াতে নিগড়াতে আশা দেবী বললেন, কাজ করতে আমার কোনো কষ্ট হয় না রে শ্রেয়া।
-কিন্তু তোমায় কাজ করতে দেখে যে আমার খুব কষ্ট হয়।
- জানি তো। তুই বড়ো হও। একটা ভালো চাকরি পেয়ে গেলেই আমার কাজ থেকে রেহাই। কিন্তু গিয়েছিলিস তো অনেকক্ষণ হলো। ফিরতে এত দেরি হলো কেন রে? গল্পে মেতেছিলিস তাই তো?
- বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই তো প্রবাল স্যারের সাথে দেখা হলো। একটু কথা বললাম । সেখানে একটু লেট হলো।
কাচা জামাকাপড় গুলো মিলতে মিলতে আশা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যা রে, স্যার কিছু বলছিলেন নাকি তোকে?
খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবেই মায়ের পিছন পিছন ঘুরতে ঘুরতে জবাব দিলো, স্যার তো বলছিলেন, এই বার ক্লাস নাইন । আরো বেশি করে পড়ায় মনোযোগ দিতে হবে।
-ওহ! তা তো ঠিকই বলেছেন। আর কিছু বলেন নি?
মায়ের পাল্টা প্রশ্নে ভ্রু জোড়া কুঁচকে খানিকটা বিরক্তির সুরে শ্রেয়া বললো, আবার কি বলবে?
বালতির অবশিষ্ট জলটা উঠনময় ছড়িয়ে দিয়ে আঁচলখানা কোমড় থেকে ছাড়িয়ে তাতে হাত মুছতে মুছতে আশা দেবী মলিন কণ্ঠস্বরে বললেন, আসলে শেষ তিন মাস তো ওনাকে একদমই টাকা দিতে পারি নি, তাই বলছিলাম।
মায়ের একদম সোজাসুজি দাঁড়িয়ে মায়ের চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে শ্রেয়া বললো, না মা। স্যার আমায় কিছুই বলেন নি। উপরন্তু আমায় বলেছে, শুধু তুই ভালোভাবে পড়াশোনাটা চালিয়ে যা। আমি সবসময় সহযোগিতা করবো।
আনন্দে , আবেগে আশাদেবীর গলার ভিতর থেকে একটা দলা পাকানো সুখের কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো প্রানপনে তাকে দমিয়ে সে, শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ; তৎক্ষণাৎ ধরা পড়ার ভয়ে মুখ ফিরিয়ে আঁচলে মুখ খানা চাপা দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
শ্রেয়া মুহূর্তের জন্য গুম হয়ে খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রোদে পড়ে থাকা বালতিটা নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের পথ কেই অনুসরণ করলো।
ঘরে প্রবেশ করেই সে দেখলো মা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরের উপরি অংশের অস্বাভাবিক নড়া চড়া দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে , তিনি কাঁদছেন।
মৃদু গতিতে বিছানার কাছে সে এলো, নিঃশব্দে মায়ের পিঠে হাতখানা রাখা মাত্রই তিনি চমকে উঠলেন। তৎক্ষণাৎ চোখের জল খানি মুছে তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
-মা,তুমি সবসময় এত কেঁদো না। আমার কষ্ট হয়। আমার চলার পথে কোনো কষ্ট নেই, কোনো অভাব নেই, শুধু তুমি কাঁদলেই, তোমার কষ্ট হলেই আমারও হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছে করে ভীষণ।
আশা দেবী মুখে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু শ্রেয়াকে বুকে আকড়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন।
শ্রেয়াও মায়ের বক্ষতলে কিছুক্ষন অপত্য স্নেহের অতলে নিজেকে আবদ্ধ রাখলো।
চলবে...
(উপন্যাসটি পড়তে কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না। অনেক কষ্ট করে যত্ন নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।)
ছবি : সংগৃহিত
1 মন্তব্যসমূহ
Hire Experienced Fintech App Developers from the leading FinTech App & Software Development Company in India & USA. Hire experienced financial app developers.
উত্তরমুছুনFintech Mobile App Development Services India, USA