নীরবে ভালোবাসি পর্ব-৬

 

love silently part 6

আগের পর্ব পড়ুন

নীরবে ভালোবাসি পর্ব-৬

বেশ একবুক আতঙ্ক আর চিন্তার পাহাড়ে জর্জরিত শ্রী উদাস মনে ঘুমে আচ্ছন্ন চোখে,  আন্দাজে ফোন টা বিছানা সংলগ্ন টেবিল টায় রাখলো। এলোমেলো চুলগুলো দুই হাতের সাহায্যে আলগা খোপার রূপ দিয়ে সে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা রাখলো। রুমের দরজাটা খুলে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। চৈতি তখন ডাইনিংয়ের এক কোনে থাকা বেসিনে চা এর কাপ, প্লেট ধুছিলেন। শ্রী কে একবার আড় চোখে দেখে বিদ্রুপ মিশ্রিত গলায় বললেন, কি ব্যাপার আজ এত সকাল সকাল না ডাকতেই উঠে পড়লি যে? এই জন্য, ঠিক এই জন্যই বলি সারা বছর মন দিয়ে পড়াশোনা করলে আজ কের দিনে আর এই ভাবে দুরু দুরু বুক নিয়ে মেনি বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে চলতে হতো না। চৈতির বাঁকা কথার কোনো স্পষ্ট অর্থ বুঝতে  না পেরে কৌতূহলের সাথে দীপক বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কি এমন অগ্নিপরীক্ষা আছে শুনি? যে আমার শ্রী মা কে এইভাবে হেনস্থা করছো? 

চৈতিকে কিছু বলার অপেক্ষা না রেখেই শ্রী দ্রুত দীপক বাবুর কাছে এসে পিছন থেকে তাঁর কাঁধ টা দু হাতে আঁকড়ে কাচুমাচু হয়ে বললো, বাবা আজ আমার রেজাল্ট বেরোবে। আদুরে, অভিমানী কণ্ঠে দু-পা মেঝেতে ঠুকে চোখ মুখ কুচকিয়ে শ্রী, - জানো বাবা, প্রত্যেক বারেই মা রেজাল্ট বেরোনোর দিন আমায় এই ভাবে অপদস্ত করে। তুমিই বলো একেই তো আজ খুব উদ্বেগ এর মধ্যে আমার সময় অতিবাহিত হচ্ছে তার ওপর এই রকম কথা বললে কেউ সহ্য করতে পারে কি? 

দীপক বাবু দু পক্ষ এর কথা শুনে হাতের ইশারায় শ্রী কে আশ্বস্ত করে, চৈতি কে কিছু বলার আগেই , চৈতির রণ মূর্তি দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কাপড়ের আঁচল খানা কোমরে গুঁজে তেলে বেগুনে জ্বলে চৈতির ক্ষিপ্ত গতিতে দ্রুতএগিয়ে এলো। তাকে  দেখেই, শ্রী তৎক্ষণাৎ বাবার সানিধ্য ছেড়ে স্নানঘরের দরজা টা অর্ধেকটা বন্ধ করে মুখ বার করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল । মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনার প্রবাহ বদলে অন্যদিকে মোড় নেওয়ায় দীপক বাবুও হতভম্ব হয়ে যায়। শ্রী স্নান ঘর থেকেই মুখ বাড়িয়ে শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করে, তোমার কি  হলো বলো তো মা ঐভাবে তেড়েমেরে আমার দিকে এগিয়ে এলে যে? 

-ও আবার কি আদিখ্যেতা শুনি? বাবার গলা জড়িয়ে মুখ কুচকিয়ে, মেঝেতে পা ঠুকে ঠুকে নেকিয়ে নেকিয়ে কথা বলা?

চৈতি র কথায় একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট এলিয়ে শ্রী নিজের মনে বিড় বিড় করে বললো এই ব্যাপার! আমি ভাবলাম কি  না কি অপরাধ করে ফেললাম রে বাবা! বলে সজোরে স্নান ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিলো।

শ্রী এর ভাবলেশহীন ভাব ভঙ্গি দেখে চৈতির মেজাজ আবার শতগুন তুঙ্গে উঠলো।দীপক বাবুর দিকে এগিয়ে এসে চোখ বিস্ফারিত করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, আচ্ছা, শ্রী তো এখন বড় হয়ে গেছে। সভ্যতা, ভদ্রতা, সহবত জ্ঞান এর ছিটে ফোটা অস্তিত্ব ও ওর মধ্যে লক্ষ্য করো তুমি?ও আমাদের মেয়ে। আজ বাদে কাল ওকে শশুর বাড়ী যেতে হবে। এখন থেকে ধীর, স্হির, নম্র না হলে পরে কিন্তু এই আমাদেরই পস্তাতে হবে এই তোমায় বলে রাখলাম। 

চৈতির বাক্যবানে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়েই দীপক বাবু বিরক্তির সুরে জবাব দিলেন, শ্রী সবে এই বছর নাইনে উঠবে। সামনে ওর অনেকটা শিক্ষার জগৎ পরে আছে। এখনই ওর মনে সংসারের দায়িত্ব জ্ঞান সম্পর্কে নাই বা ওয়াকিবহাল করে তুললে! আজ ওর রেজাল্ট। এই বয়সটা আমরাও পেরিয়ে এসেছি। এইসময় অল্প বিস্তর মনের কোণে ভয়ের সঞ্চার হয় বৈকি। তুমি ওকে ঐভাবে বোলো না। এতে ওর মনে খারাপ প্রভাব পড়বে। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ইতস্তত হয়ে বললেন,  -এবার আমায় খেতে দাও চৈতি। আমার বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। চৈতি ও আর কথা না বাড়িয়ে ভাত বাড়তে রান্না ঘরে ঢুকলো। স্নান ঘর থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দীপক বাবুর সাথে শ্রী এর চোখা চোখি হতেই- শ্রী এত মন খারাপ করিস না, চিন্তা একটু মনের অলিগলিতে উঁকি দেবে ঠিকই। কিন্তু সেসব কে তোয়াক্কা না করে শান্ত মনে স্কুলে যা। তুই তো বরাবর ভালোই রেজাল্ট করিস ওতো চাপ নিস না। তবে আমি কিন্তু এইবারে অংকে ভালো রেজাল্ট চাই। আগের বছরের মতো এই বছরে নম্বর কম পেলে চলবে না। সেইজন্য সারা বছর প্রাকটিস করা উচিত। অঙ্ক মানেই অনুশীলন, অংকের মধ্যে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি পাওয়া যায়, একবার বিষয় টিকে ভালোবেসে ফেল দেখবি তুইও অংকের প্রেমে পড়ে গেছিস। 

অঙ্ক সম্পর্কে নীরলস আলোচনা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা না থাকলেও বাবার মুখ থেকে প্রেম নামক শব্দটা শুনে সে মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। যা দীপক বাবুর দৃষ্টি গোচর হলো না।  প্রেম নামক শব্দটা এই বয়সী কিশোর-কিশোরী দের কাছে খুব আগ্রহের একটা বিষয়। তাদের কাছে প্রেম মানে নারী-পুরুষের রোমান্স, ভালবাসাটা ই বেশি প্রাধান্য পায়। যাই হোক বাবার উপদেশ টুকু কর্ণ গহ্বরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রহণ করে শ্রী রুমে গিয়ে ইউনিফর্ম পরে, চটপট চুল বেঁধে তৈরি হয়ে নিলো। দীপক বাবুর খাওয়া হয়ে গেলে শ্রী রুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে প্রনাম করলো, সাথে চৈতি কেও। দীপক বাবুর হাতে সময় ছিল খুব কম। তাই শ্রী এর চিবুকে আঙুল বাড়িয়ে চুমু খেয়েই লাঞ্চ বক্সের ব্যাগ খানা কাঁধে ঝুলিয়েই তিনি সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। চৈতি ও শ্রী কে পাশ কাটিয়ে দীপক বাবুকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন। 

দীপক বাবু বেরিয়ে যেতেই চৈতি দরজা বন্ধ করে পুনরায় ঘরে এলেন। ছলছল চোখে কান্না জড়িত সুরে শ্রী বললো, আচ্ছা মা বাবা সবসময় আমায় অংকে ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য এত চাপ কেন দেয় বলো তো? অঙ্ক ছাড়া কি অন্য কোনো বিষয় এর কি কোনো গুরুত্ব নেই? অসীম মমতায়  শ্রী এর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে চৈতি কোমল সুরে শ্রী কে বললেন, শুনেছি তোর বাবা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। অংক ছিল তার প্রিয় বিষয়। হঠাৎ ই আমার শশুর মশাই অর্থাৎ তোর দাদুর অকাল প্রয়াণে তোর বাবাকে পড়শোনায় ইতি টানতে হয়। সেই স্বপ্ন তো তার অসম্পূর্ণ ই থেকে গেছে। তাই তোর মধ্যে দিয়ে সেই স্বপ্নকে সে আবার নতুন করে দেখছে। সব বাবা-মা রাই চায় তাদের অধরা স্বপ্ন গুলো তাদের সন্তানদের মধ্যে দিয়ে পূরণ করতে।

চৈতির বলা কথা গুলো শ্রী মায়ের বুকে মুখ গুজে চুপ করে শুনছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারলো না। 

শ্রী কে চরম হতাশা একটু একটু করে গ্রাস করতে থাকল।  একদিকে বাবার প্রতি ওর ভালোবাসা, অন্য দিকে বাবার স্বপ্নপূরণ এই দুইয়ের অসম রেখা কে সে কিছুতেই এক সমান্তরাল এ আনতে পারে না। মনের মধ্যে দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। আর তা থেকেই উৎপন্ন হয় একটা মানসিক দূরত্বের। যে দূরত্বের মধ্যে ভালোবাসার খেদ নেই কিন্তু দু-পক্ষের মতের অমিল থেকে যায় বিস্তর। আর এই অমিলের প্রধান্য তেই ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত ঘটে। নাকে-মুখে যা হোক করে  চারটি ভাত গুঁজে শ্রী চেয়ার থেকে উঠে বেসিনের দিকে এগোয়। থালায় তখনও  তার প্রিয় কাতলা মাছের পেটিটা আস্ত ছিল। তাতে যে শ্রী এর ছিটে ফোটাও আঙুল এর স্পর্শ পরে নি , তা দূর থেকে দেখেই চৈতি বেশ বুঝতে পারে। কিন্তু আজ সে শ্রী কে জোর করে খেতে বসার কথা বললেন না। এমনকি কিছুক্ষন আগেও যে তিনি শ্রী এর কান্ড কারখানা দেখে মেজাজ হারিয়েছিলেন, সেই মেজাজে ও এখন কোমলতার প্রলেপ ঢেলে বললেন, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে শ্রী। শ্রেয়া এখুনি চলে আসবে। শ্রী মুখে কিছু না বলে মা এর পা দুটি ছুঁয়ে   মাথায় ঠেকিয়ে কাঁধে ব্যাগ খানি নিয়ে বাইরে এলো। শ্রেয়াও এইসময় আসছিল। পরস্পরের চোখাচোখি হতেই দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। 

ওদের বাড়ি থেকে স্কুল বেশি দূরে নয়। পায়ে হেটেই ওরা যাতায়াত করে। সুতরাং স্কুল অবধি হাট তে হাঁট তেই ওরা অনেক গল্প করলো। কিন্তু আজকের গল্পের বিষয় বস্তুতে কোনো ইয়ার্কি, ফাজলামি নেই। আজকে শুধুই পড়াপ্সংক্রান্ত আলোচনা। রেজাল্ট সম্পর্কিত অবান্তর কথোপকথন।

-তোর তো কোনো চিন্তাই নেই শ্রেয়া। তুই তো সব বিষয়ে ই ভালো রেজাল্ট করিস। রাঙ্ক করিস। ম্যাম রাও তোকে কত ভালোবাসে। আর আমার কপালটাই খারাপ। 

-তুই যদি নিজে থেকে তোর কপাল ঐভাবে গড়িয়ে নিস, তাতে কারো কিছু করার আছে?

-তার মানে?

-মানে টা খুবই সোজা শ্রী। তুই অঙ্ক পারিস না এটা ঠিক কথা নয়। আসলে অঙ্ক এর নাম শুনলেই তোর গায়ে জ্বর আসে এমন অবস্থা। একটুপ্রাকটিস করলেই ঠিক হবে। আসলে তোর মধ্যে অংকের জন্য কোনো চেষ্টাই নেই।

-ওহ! এবার আমি একটা কথা বলি?

-হ্যা, বল

-আসলে যারা অংকে ভালো তাদের কাছে এটা হয়তো সত্যিই খুব মজার বিষয়। কিন্তু আমার মতো অংকে যাদের এলার্জি তারা যতই প্রাকটিস করুক না কেন অঙ্ক কখনোই তাদের আপন করে নেয় না। তাই আমার মতো পাবলিকদের কাছে অঙ্ক কখনোই সেরা বিষয় হয়ে উঠতে পারে না। 

-কি যে বলিস কিছুই বুঝি না।

-ও তোর অঙ্ক ঘাটা মাথায় এই সব কিছুই ঢুকবে না বুঝলি? তবে একটা কথা কি বলতো এখনো অনেক অভিবাবক, অনেক মানুষ রাই বুঝলো না অঙ্ক ছাড়াও জীবনে এগোনোর অনেক রাস্তা খোলা আছে। শুধু শুধু তারা নিজেদের পছন্দ টা কে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।  আর অংক টাই যদি একমাত্র উত্তম বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য বিষয় গুলো শিক্ষাপাঠের অন্তর্ভুক্ত হতো না। 

-এই বিষয়ে আমি সহমত শ্রী তোর সাথে। যে কোনো বিষয় নিয়েই এগিয়ে যাওয়া যায়।

শ্রেয়ার কথায় কোনো পাল্টা কথা না বলে বিড়বিড় করে সে নিজের মনে একবার বললো, এটা যদি আমার বাবা বুঝতো, তাহলে সকল সমস্যাই মিটে যেত।

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ