হাসপাতালের সেই রাত (তৃতীয় পর্ব)

 

that night in the hospital third part

আগের পর্ব পড়ুন

হাসপাতালের সেই রাত (তৃতীয় পর্ব)



আয়া মাসির হাত ধরে যন্ত্রণার কষ্ট সহ্য করেই আমি  আস্তে আস্তে কোনমতে মেঝেতে পা ফেলার চেষ্টা করলাম। তৎক্ষণাৎ  ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম।  কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম মাসি আমি যেতে পারব না বাথরুম অবধি। মেঝেতে পা টুকু ফেলতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।  কিন্তু তিনি  আমার কথা গ্রাহ্য না করেই অবলীলায় বললেন-- তা বললে তো হবে  না... তাহলে তোমায় ক্যাথলিন লাগিয়ে দিতে হবে। আর  এখানেই সব কাজ সারতে হবে । সেটা কিন্তু তোমার শরীরের পক্ষে আরও খারাপ হবে। তা ছাড়া বেডে ই শায়িত অবস্থায়  এই সমস্ত কর্ম করতে চাইলে তোমার সেরে উঠতেও ঢের বেশি সময় লাগবে। সুতরাং ছুটি দেওয়াও তাড়াতাড়ি হবে না।  তাই বলছি মনের জোর নিয়ে আস্তে আস্তে নামার চেষ্টা করো আমার সাহায্য নিয়ে। মাসির  কথায় আমার টনক নড়লো।  সত্যিই আমার পক্ষে বেশী দিন এখানে থাকা  সম্ভব নয়। অবশ্য কেউই এখানে ইচ্ছে করে ঘুরতে আসে না। জ্বালায় পড়েই আসতে বাধ্য হয়।  কিন্তু আমার ছোট বাচ্চাটাকে বাড়ি রেখে এখানে থাকাটা যে কতটা কষ্টকর তা  একজন মা ই ভালো বুঝবে। যাইহোক আয়া মাসির কথায় মনের মধ্যে প্রবল বল সঞ্চয় করে  দাঁতে দাঁত চিপে আমি তার হাত দুটো  ধরে উঠে বসলাম। চোয়াল শক্ত করে, চোখ বুজে পা দুটো বেড থেকে মেঝেতে রাখলাম। 

--এই দেখো কি সুন্দর নীচে নেমে দাঁড়ালে। বললাম না তোমায় একটু চেষ্টা করলেই তুমি পারবে। শান্ত গলায় মাসি বলল। টলমল পায়ে মাসিকে চেপে ধরেই বাথরুমের দিকে এগোলাম।  কিন্তু আইসিইউ এর জন্য বরাদ্দ বাথরুম টা ব্যালকনির কাছে। ওয়ার্ডের দরজাটা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে দক্ষিণের শীতল হাওয়া আমাদের দুজনের শরীর কাঁপিয়ে দিল।  ভিতরটা এতটা গরম আর বাইরে এমন কনকনে ঠান্ডায় আমরা জড়সড় হয়ে গেলাম । 

--- নাও তাড়াতাড়ি সেরে  নাও।  আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।  খানিকটা  বিরক্তি মিশ্রিত গলায়  মাসি আমায় বলল।

 সত্যিই তো গরম পরিবেশ থেকে হঠাৎ ঠান্ডা জায়গায় এলে মনে একটা অশান্তির উদ্বেগ হয় বৈকি। আমিও যতটা সম্ভব স্যালাইন এর বোতল টা  একহাতে ধরে কোনক্রমে কাজ সাড়লাম। তারপর টলতে টলতে বেডে এলাম। মাসি আমায় ধরে শুইয়ে দিলো।  মাসি চলে যাচ্ছিল। আমি তার হাত টা টেনে  বললাম 

--- এইটুকু যাতায়াত করতেই  আমি হাপিয়ে যাচ্ছি। খুব কষ্ট হচ্ছে।  আমি সুস্থ হতে পারব তো?

-- কেন পারবে না!  নিশ্চয়ই পারবে।  আসলে আজ ই তো তোমার অপারেশন হলো। একটু তো  কষ্ট সহ্য  করতেই হবে বলো?  আমি  তোমায় জোর করে নিয়ে গেলাম বলে হয়তো তোমার আমার ওপর রাগ হচ্ছে...  কিন্তু পরে ভেবে দেখবে  এটা তোমার ভালোর জন্যই করেছি।  তাছাড়া মনে করে দেখো সেই গতকাল রাতে তুমি শেষ  খেয়েছ । আজ সারাদিন কিছুই খাওয়া-দাওয়া হয়নি। শুধু স্যালাইন চলেছে।  শরীরটা দুর্বল থাকবেই। এটাই তো স্বাভাবিক।  অত চিন্তা করো না , কাল থেকে দেখবে  অনেকটাই সুস্থ বোধ করছ। এখন গভীর রাত।  সবাই ঘুমাচ্ছে। তুমিও ঘুমিয়ে নাও।  সকাল বেলা আবার তোমায় ওই বেডে দিয়ে আসবো। এতক্ষণ তার কথাগুলো আমি মন দিয়ে শুনছিলাম। বেশ ভালো লাগছিল। তার বক্তব্যে  স্নেহের পরশ ছিল স্পষ্ট।  আমি কৌতুহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন বেডে দেওয়া হবে? 

--- অপারেশনের আগের দিন যে বেডে ছিলে সেখানে।  আজ তো এখানেই সারাটা দিন তোমার কেটে গেল।

 আমি কোথায় আছি , এই নিয়ে এতক্ষন আমি  ওত মাথা ঘামায়নি। তার কথায় মনে পড়লো সত্যি ই তো  আমি সেই সকাল বেলাতেই অপারেশনের জন্য চলে এসেছি অন্যত্র।  আর এখন মাঝ রাত্রি। আর মাসিকে উত্যক্ত না করে তাকে বললাম চলে যেতে।রেস্ট নিতে।  কিন্তু নাইট ডিউটিতে  থাকাকালীন কোন নার্স, ডাক্তার,  আয়াই নিশ্চিন্তে দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনা । 

পরক্ষণেই আয়ামাসীকে  পাশের বেডের এক পেশেন্ট হাতের ইশারায় ডাকলো।

শুয়ে শুয়ে মাসি কে দেখে মনে হলো  সত্যিই  এরা শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য এই কাজের সাথে যুক্ত হলেও  এদের পরিশ্রম মানবজীবনকে সেবা করার জন্যই যেন নিমজ্জিত । এরাই তো প্রকৃত মানুষ রূপী  দেবদেবী। যারা রাতবিরেতেও অবিরাম রুগীর সেবা  করে চলেছে। সব জেনেও স্বেচ্ছায় এই পেশায়   নিজেকে নিযুক্ত করেছে। 

তারপর ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে  কষ্ট পেতে পেতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা।  সকাল ছটার সময় আয়া মাসির ডাকেই আমার ঘুম ভাঙলো।

--- উঠে পড়ো।  ব্রাশ করে নাও। তোমায় এবার ওই ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে হবে। গতকাল রাতের মাসির পরামর্শগুলোর কথা মগজে আবার প্রবেশ করামাত্র আমি নিজে থেকেই উঠতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল । এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে ছিলাম তাই  কিছু বুঝতে পারিনি।   আয়া মাসি এসে আমায় আঁকার করে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে।

--- ও কি করছিলে তুমি ! একপাশে ঠেস দিয়ে ওভাবে কেউ ওঠে?  উপর ন্তু ওই হাতে স্যালাইন চলছে সেটাও খেয়াল করনি ! তুমি তো আমায় একবার ডাকবে... আমি তোমায়  ডেকে দিয়ে তোমার  ব্রাশ, জল  রেডি করতে গিয়েছিলাম।  এইটুকু সময়ের ব্যবধানেই কি কাণ্ডটাই না করে বসছিলে বলো তো? এক্ষুনি তো  কিছু অঘটন ঘটলে আমার নামে রিপোর্ট যেত। 

তার  ধমক খেয়ে  নিজের ভুল-ভ্রান্তির জন্যে চুপ করেই থাকলাম। 

তারপর তিনি একটু নরম স্বরে বললেন ---তুমি  তো দেখছি  খুবই বাধ্য মেয়ে। গতকালের পরামর্শগুলো তোমার ঠিক মনে আছে দেখছি। আমি তোমায় নিজে থেকে উঠতে বলেছিলাম ঠিকই , বেডে ক্যাথিনল  ইউজ না করে নেমে  বাথরুমে যেতে বলেছিলাম এটাও মানছি। কিন্তু তা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নয়। আমায় ডেকে নেবে তো ! তোমার যে  দেখছি সুস্থ হওয়ার খুব তাড়া। যাক!  ভালো , মনে এই রকম সাহস থাকা খুবই জরুরী।  দেখবে তুমি নিশ্চয়ই খুব  তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে । 

তার কথাগুলো শুনে নিঃশব্দে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

-- এমা তুমি কাঁদছো কেন ?

 নিজের কষ্টটা আর দমিয়ে  রাখতে পারলাম না।  মাসীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম। 

---এই মেয়ে,  কি হয়েছে ? এমন ভাবে কাঁদো কেন?

 ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম আমার ছয় মাসের একটা ছোট ছেলে আছে । সে এখনো বুকের দুধ খায়। আমার ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,  কাল সারাদিন ওর একটা খবরও আমি পাইনি। ও যে  আমায় ছাড়া একটুও থাকতে পারেনা ।না জানি কাল সারারাত কত কেঁদেছে,  এই দেখো না আমার বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।ও তোবুকের  দুধ খেত। তাই খুব টনটন করছে। 

আমার কথা শুনে মাসির ও মুখটা করুন হয়ে গেল। ততক্ষনে আমার কান্নার কারণ শুনতে আরো কয়েকজন নার্সরা ভিড় জমিয়েছে। সকলে বলাবলি করছে সত্যি এতোটুকু বাচ্চাকে রেখে এসেছে।  মায়ের মন তো!  কষ্ট তো হবেই। একজন মধ্যবয়স্কা নার্স  বললেন কি করবে বলো রোগ যখন হয়েছে  তাকে ছেড়ে দুইদিন একটু কষ্ট করো। বাচ্চাটাকে দেখাশোনার জন্য বাড়িতে কেউ নেই?

আমি হাতের তালু উল্টিয়ে চোখের জল মুছে নাক টেনে  বললাম হ্যাঁ আছে ।আমার মা আছে আমার ছেলের কাছে।  আমি বাপের বাড়িতে ছেলেকে রেখে এসেছি।  তাছাড়া রাতের দিকে অফিস থেকে এসে  আমার হাজব্যান্ড আমার ছেলেকে দেখাশোনা করছে।

 তার পর আমি ব্রাশ করে ফ্রেস হয়ে নিলাম । গতকাল পেটে কিছুই পড়েনি। তাই খিদে পেয়েছিল খুব। 

--- মাসি আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমার কথা শুনে একগাল হেসে তিনি বললেন আজকে দুপুর অবধি কিছুই খেতে দেয়া হবে না ।  হয়তো একটু লিকুইড  টাইপের কিছু দিতে পারে। মানে স্যুপ জাতীয় কিছু। সাধারণত ডাক্তারবাবুরা তাই পরামর্শ দেন।

 তার কথা শুনে আমি আবার মুষড়ে  গেলাম । পিছনে বালিশটা দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আবার শোয়ার চেষ্টা করলাম।  খানিকবাদেই আমায় পূর্বনির্ধারিত ওয়ার্ডে টান্সফার করা হল। আমার এক হাতে ছিল স্যালাইন। অন্য হাতে ড্রেইন। ( কোমরের কাছে ডান সাইডে পাইপ দিয়ে একটি বোতল সেট করা ছিল। ওখানে  তিনটে স্টিচ ছিল। সেখান দিয়েই পাইপ সেট করে বোতলে প্রবেশ করানো হয়েছিল। ওই পাইপ টার  মাধ্যমে ভিতরে রক্ত বাইরে বোতলটায় জমা হচ্ছিল।  আর ওই বদ রক্তটা  পরিমাণ এ  কতটা বের হলো সেটা তিন  ঘন্টা অন্তর অন্তর নার্সরা দেখে  লিপিবদ্ধ করছিল । তারাই  এই রক্ত জমা হওয়ার বোতলটিকে ড্রেইন  বলছিল ।তাই ওই নামটি উল্লেখ করলাম। ডাক্তারি পরিভাষায় তার অন্য কোন নাম আছে কিনা আমি জানিনা।)  এই দুটোকে   সমান ভাবে সামলেই  আমায় ওটির  ইউনিফ্রম   চেইঞ্জ করে অন্য ড্রেস পড়তে হলো।  ওয়ার্ডে পৌছেই লক্ষ্য করলাম ওয়ার্ড প্রায় খালি। ভর্তি হওয়ার দিন যে আয়া মাসি টা  রাতের  ডিউটিতে ছিলেন তিনি আবার আমায় দেখে বললেন কি বলেছিলাম মিলে গেল  তো? দেখো আজ ওয়ার্ড প্রায় পুরোপুরি  বলতে গেলে খালি। আমি ভাল করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সত্যি পুরো ফাঁকা।  এই ওয়ার্ডে মোট উনিশটি  বেড আছে।  শুধু যে ভদ্রমহিলার ইউটেরাসে টিউমার অপারেশন হয়েছিল তিনি শুধু আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার আশেপাশের কোন বেড আমার জন্য বরাদ্দ ছিল না।  তাই উনি রইলেন  ওয়ার্ডের একপাশের সারিতে । আমি থাকলাম তার বিপরীত সারিতে। কোনমতে আস্তে আস্তে  শুয়ে  আমি আয়া মাসিকে বিস্ময়ের সুরে বললাম সত্যিই তো মাসি  গতকাল যেখানে পেশেন্টে গমগম  করছিল আজ সব ফাকা। এও কি সম্ভব? উনি আমার বেডের পাশে একটা টুল টেনে এনে বললেন যে বৃদ্ধ মহিলাটির ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিল দীর্ঘ একমাস পর কাল  ছুটি হলো। আর যে বৃদ্ধা মহিলাটির পা ভেঙে গিয়েছিল , ওই যে আমরা সব আলোচনা করছিলাম মনে পড়ছে বলেছিলাম ওনার মেয়েরা ভিজিটিং আওয়ারস ও দেখতেও পর্যন্ত আসে না ওই ভদ্রমহিলা টার আজ অপারেশন। সুতরাং আজ নাইট ডিউটিতে যে সমস্ত নার্স, ও আয়ার  দায়িত্ব আছে এই ওয়ার্ডে তাদের কাজ আজ পুরো হালকা। যেমন এই দেখো আমিও যেমন ঝাড়া হাত-পা হয়ে বসে আছি,  তোমার সাথে গল্প করছি। মাসির কথায় আমি ঈষৎ হাসলাম। কিন্তু আমার হাসিটা হয়তো তার কাছে বিদ্রুপের হাসি মনে হয়েছিল। তাই তিনি আবার বললেন তা বলে ভেবোনা যে এই হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্স ও আয়া আমার মত এইরকম বসে বসে টাইম কাটায়। আবার নর ম সুরে  মেজাজ সামলে নিয়ে বললেন আসলে এই হাসপাতালটা আমাদের কাছে একটা পরিবারের মত।  আয় এর উদ্দেশ্যে এখানে আসলেও এই হাসপাতালের প্রতিটি কাজে আমরা সদা তৎপর। আমরা অনেকেই বহু বছর ধরে এই হাসপাতালের সাথে যুক্ত । নানা সুখ দুঃখের স্মৃতি বহন করে থাকি। তবে রুগীকে  হাসিমুখে চিন্তামুক্ত মনে বাড়ি ফেরাতে পারলে আমাদের মনে এক অসীম ভালোলাগার ঢেউ খেলে যায়। এই টুকুই আমাদের প্রাপ্তি।


চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ