হাসপাতালের সেই রাত(চতুর্থ পর্ব)

 

that night in the hospital fourth part

আগের পর্ব পড়ুন

হাসপাতালের সেই রাত(চতুর্থ পর্ব)


আয়া মাসির সাথে গল্প করতে বেশ ভালই লাগছিল।  কিন্তু এদিকে খিদের চোটে মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। গল্পের মাঝেই তাকে  জিজ্ঞাসা করলাম আমায় কখন খেতে দেওয়া হবে?  তিনি আমায় বললেন আর ঘন্টা খানেক বাদেই লাঞ্চ টাইম হয়ে যাবে। তখন তোমার জন্য খাবার আসবে। খাবারের কথাটা শুনেই আমার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ভাব ফিরে এলো। যাক বাবা ! কাল থেকে পেটে কিছুই পরেনি আজ থেকে খেতে পারব। ---কিন্তু এখনই তোমায় কোন সলিড খাবার দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়নি । শুধু স্যুপ দেওয়া হবে।

  গতকালই অবশ্য এই ব্যাপারে এইরকম ই একটা আভাস পেয়েছিলাম।  আমার বিস্তারিত ঠোঁটের প্রাণ ভরা হাসিটা আবার নিমিষেই সংকুচিত হয়ে দাঁতগুলো কে পুনরায় ঠোঁটের আড়ালে লুকালো। তবুও মনকে কোনরকমে শান্ত করে বললাম "ওরে নেই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো।" তাই সামান্য  স্যুপ এর জন্যই অধীর আগ্রহে বসে থাকলাম।  ততক্ষণে আয়ামাসীও আমার সঙ্গ ত্যাগ করে  অন্য সহকর্মীদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।  ওই যে আগেই বললাম যেহেতু এই ওয়ার্ডে আমরা দুজন পেশেন্ট  ছাড়া আর কেউ নেই, তাই ওদের কাজের চাপ টাও কম। সেইজন্যই আজ তাদের আড্ডার আসর বসছে ক্ষণে ক্ষণে । না হলে সত্যিই তারা খুব কর্তব্য পরায়ন,  পরিশ্রমী।  রুগী  যখনই কোন দরকারে ডাকছে   তারা সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে বিনা বিরক্তি তে সেই কাজ করছে।  সত্যি তাদের কাজের প্রতি এই নিষ্ঠা কে কুর্নিশ  জানাই। যাইহোক ঘন্টাখানেক পরে আমার জন্য স্যুপ এলো। তার আগে স্যালাইন খুলে দিয়েছিল। হাতে চ্যানেল টা করাই ছিল।স্যুপ  টা আমি বলতে গেলে প্রায় এক নিমিষেই খেয়ে ফেলেছিলাম। শরীরটাও যেন খাওয়ার পর কিছুটা চাঙ্গা হলো। আমার স্যুপ খাওয়ার রকমসকম দেখে বিপরীত সারিতে  থাকা পেশেন্ট টির  ঠোঁটে তখন  মিচকে  হাসি। সে দিকে চোখ যেতেই খানিকটা লজ্জা নিয়েই বললাম "আসলে যা জোর খিদে পেয়ে গিয়েছিল, তাই আর কি...

 তিনি বললেন  আমারও অপারেশন এর পরের দিন এই রকমই খিদে পেয়েছিল। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটতেই ডাক্তারবাবু এসে আমায় চেকআপ করে গেলেন। কোমরে পাইপ দ্বারা যে বোতলটা আটকানো ছিল তাতে কত মিলি রক্ত এসেছে সেটা দেখলেন,  তারপর হাসিমুখে বললেন আগামীকালই আপনার ছুটি হয়ে যাবে মিসেস দাস। কথাটা শুনে আমার যে মনের ভেতর কতটা আনন্দ হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।  নার্স এসে তৎক্ষণাৎ আমার কোমরের ড্রেইন টা খুলে দিলো। ওটা খুলে দেওয়ার পর আমার শরীরের অস্বস্তি ভাবটা অনেক টা কাটলো। ওই ড্রেইন টার জন্যই বাম পাশ ঘুরে ঠিক মতো শুতে পারছিলাম না। এখন নিজে থেকেই  বেশ সুস্থ বোধ করলাম। 

হাসপাতাল থেকে রোগী সুস্থ ভাবে ছাড়া পেলে সেটা সত্যিই খুশির খবর যে কারো কাছেই।  কিন্তু আমার কাছে এটা যেন আরো উপরী খুশির পাওনা। যেন যুগ যুগ পর আমি আমার ছেলেটাকে দেখতে পাবো , ওকে একটু ছুঁতে পারবো, আদর করতে পারব,  এই ভাবনায় মন বড় উতলা হয়ে রইলো।  আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা। ডাক্তার  বাবুর কাছ থেকে ছুটি ঘোষণা হওয়া মাত্রই আমি বারবার ওয়ার্ডের দেওয়ালে টাঙানো চঞ্চল কাটা দুটোর দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম কখন সকাল হবে। এইভাবে চিন্তাশীল মনে আপন মনে বসে থাকতে থাকতে চোখটা যেন ঘুমে জড়িয়ে এল।  আস্তে আস্তে বেডের পাশে থাকা রড টাকে ধরে শুয়ে পড়লাম।  ঘুম ভাঙলো আমার হাজব্যান্ডের ডাকে। চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম আমার হাজব্যান্ড আর বাবা এসেছেন । এখন ভিজিটিং আওয়ারস। ---এখন কেমন আছো শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল  অরিন ( আমার হাজব্যান্ড)। ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে বললাম মোটামুটি ভালোই আছি। বাবা বললেন ওষুধপত্র আর কি কি নিতে হবে  আমি ওষুধের কাউন্টারে গিয়ে দেখে আসছি,  আর ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলে আসছি। তোরা ততক্ষন কথা বল ।এই বলে বাবা ও ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে। 

অরিন আমার হাতে হাত রাখা মাত্রই আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম।--- ঐরকম ভাবে কেঁদো না । এই সবে অপারেশন হয়েছে। এতে তোমার কষ্ট হবে। 

আমার কান্নার কারন টা সে স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিল। তাই আমায় শান্ত করার জন্য সে বলল বাবু ভালই আছে,  খেলছে,  মা খাইয়ে দিয়েছেন ।রাতে আমার কাছে ঘুমোচ্ছে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই  একটু কাঁদে অবশ্য,  কিন্তু কোলে নিয়ে একটু পায়চারি করলেই মিনিট পনেরোর মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।

 তার কথায় আমার মনটা সত্যিই অনেকটা শান্ত হলো বটে কিন্তু অরিনের জন্য মনটা বড় বিষন্ন হয়ে রইলো।

--- কিন্তু সারাদিন অফিস করে এসে মাঝরাতে তোমায় ছেলে সামলাতে হচ্ছে আবার সকালে উঠেই অফিস বেরোতে  হচ্ছে। তোমার তো ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। তোমার উপরও চাপ পড়ছে খুব।

--- আরে কিছু অসুবিধা হচ্ছে না আমার... তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি এসো ,এতেই আমি খুশি। 

এতক্ষণ ছুটির খবরটা ওকে দেওয়াই হয়নি মনে পড়তেই বললাম জানো তো দুপুর বেলায় যে ডাক্তার বাবু আমায় চেকআপ করতে এসেছিলেন তিনি বললেন কাল সকালেই তোমায় ছুটি দেওয়া হবে। 

আমার মুখ থেকে সুখবর টা শোনা মাত্রই তার চোখে মুখে শান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।  যদিও সে ভগবান, ভূত ,প্রেত এ খুব একটা বিশ্বাসী নয় তবুও  তার হাতটা দেখলাম অজান্তেই কপাল ছুঁল। অর্থাৎ ভগবান এর উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম করলো।  

বুঝতে পারলাম মানুষ যতই মুখে বলুক না কেন ভগবান বিশ্বাসী নয়,  কিন্তু বিপদে আপদে সে ব্যক্তি ও সকলের অজান্তে ভগবানের শরণাপন্ন হয় ।

 ততক্ষণে বাবাও ও কয়েকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ এনে নার্সদের কাছে রেখে এলেন। তারাই রাতের দিকে ওষুধটা দিয়ে যায়।  বাবা ও এসে বললেন ডাক্তারের সাথে দেখা করে এলাম কালই  তোকে ডিসচার্জ  করবে। 

---হ্যারে, শরীরে কোথাও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?  তেমন বুঝলে ডাক্তারবাবুকে বলতে দ্বিধাবোধ করবি না কিন্তু... 

 আমি বাবার হাতে হাত রেখে বললাম

--- না বাবা কোন অসুবিধা হয়নি।  তবে একটু ব্যথা যন্ত্রণা আছে,  সেটা তো দিন পনেরো কমবেশি থাকবেই। ও নিয়ে চিন্তা করো না।  ডাক্তার বাবু বলেছেন নিয়মমতো ওষুধপত্র খেলে খুব তাড়াতাড়ি ফিট হয়ে যাব। 

আসলে আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতিরও চাপা স্বভাবের। খুব বেশি কইয়ে, বইয়ে নয়। ছোট থেকেই আমার অবসরের সঙ্গী ছিল  গল্পের বই। তাই  বাবা ভাবছে আমার সমস্যার কথা ঠিকমত ডাক্তার কে বলেছি কিনা।  আমার কথা শুনে বাবা বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। 

 তারপর তারা বলে গেলে আগামীকাল সকাল দশটায় আনতে আসবে ।আমি তো বেজায় খুশি। ভিজিটিং আওয়ারস এর টাইম শেষ হতেই অরিন  আর বাবা বাড়ি ফিরে গেল।

 ওরা চলে যাওয়ার পরেই আবার ওয়ার্ড টা  নিস্তব্ধ হয়ে গেল । ততক্ষনে সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। চারিদিকে লাইট জ্বলে উঠেছে। আয়ামাসি এসে হালকা খাবারও দিয়ে গেল।  কিন্তু সারাদিন ধরে খিদের জ্বালা নিয়ে দিন কাটালেও এখন  খাবার দেখে  আর খেতে ইচ্ছা করলো না। উল্টে গা গুলিয়ে উঠলো।  কিন্তু খেতে যেহেতু অনুমতি দিয়েছে সুতরাং খালি পেটে থাকাটাও ভাল কথা নয় সেসব চিন্তাভাবনা করে আয়া মাসিকে ডাকলাম। কিন্তু আজকের নাইট ডিউটিতে থাকা দুটো আয়ামাসি ও  তখন নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে খুবই ব্যস্ত। আমার গলা শুনতে পেলো না। আসলে আমার বেড টা ওয়ার্ডের বড্ডএকপেশে। আর নার্স, আয়ামাসি দের বসার জায়গাটা একদম সামনের দিকে । আর শারীরিক দুর্বলতার কারণে আমার গলার ভয়েসটা খুব জোরালো ছিল তাও নয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার একটু জোর গলায় ডাকতেই একজন আয়া মাসিএলেন। 

---কিছু বলছো?

--- বলছি আমায় একটু শুধু মুড়ি দেওয়া যাবে?

--- এইমাত্র কেক,  বিস্কুট দিতে এসেছিল তোমায়  দেওয়া হয়নি বুঝি ?

---না না ! আমিই  নিইনি। খেতে ইচ্ছে করলোনা। গা গুলাচ্ছে ।একটু মুড়ি খেতাম। 

---আচ্ছা, ঠিক আছে... আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি ।

আয়ামাসি মুড়ি আনতে গেল। সারা সন্ধ্যা আর কি করবো ! অগত্যা ম্যাগাজিনটা  বার করে পড়তে থাকলাম।

 মুড়ি খেয়ে বেশ অনেকটা  জল খেলাম। এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। আরো একজন যে পেশেন্ট যিনি  আমার বিপরীত সারিতে  ছিল তিনি মৃদু গতিতে আমার বেডের কাছে এসে একটু গল্প করতে আসলেন। 

 তিনি বললেন

---আমায় ডাক্তারবাবু একটু একটু করে হাঁটাহাঁটি করতে বলেছেন,  একা একা বসে সময় কাটছে না তাই একটু এলাম আপনার কাছে । তবে আগামীকাল আমার ছুটি।

--- খুবই ভালো খবর... আমারও আগামীকাল ছুটি । ডাক্তারবাবু অবশ্য আমাকেও হাঁটাহাঁটি করতে বলেছেন।

---  সে কি  আপনাকে তো একবারও উঠে দাঁড়াতেও দেখলাম না। ডাক্তার বাবুদের কথা এরকম অবাধ্য হবেন না ।হাঁটাহাঁটি করতে বলেছেন যখন সেটা চেষ্টা করুন। ---আমি আসলে ভরসা করে হাঁটতে ভয় পাচ্ছি।

--- ডাক্তারবাবু যখন বলেছেন ভয়ের কিছু নেই... আপনি চেষ্টা করলে পারবেন। তাছাড়া এখানে হাঁটতে চলতে পারলেই নির্ভাবনায় বাড়ি যেতে পারবেন।

 কিন্তু কাল বাড়ি যাবেন এখনো হেঁটে চলে দেখলেন না আপনার শরীরটা জুতসই হয়েছে কিনা... আস্তে আস্তে উঠে হাটার চেষ্টা করুন।  তবেইতো বুঝতে পারবেন শরীরে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেই অনুযায়ী ডাক্তারবাবু চেকআপে আসলে তাকে বলবেন।  না হলে কাল বাড়ি চলে যাবেন তখন যদি ওখানে অসুবিধা হয় তাহলে আবার আসতে হবে এখানে।  তখন আপনার নিজেরও কষ্ট আবার বাড়ির লোকেদের ও দ্বিগুন হেনস্থা হতে হবে। 

সত্যি তার কথাগুলো সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। তাকে দেখে আমারও মনে উৎসাহ জাগলো। মনে ভরসা নিয়ে উঠে বসলাম। উনি তখনও আমার বেডের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। একটা একটা করে দুটো পা ই  নিচের মেঝেতে রাখার চেষ্টা করলাম ।তারপর মৃদু গতিতে হাটা শুরু করলাম। সত্যি এবার হাঁটাহাঁটি করতে শরীরটা অনেকটাই ঝরঝরে হয়েছে,  সুস্থ বোধ হচ্ছে,  যে জড়তা ভাবটা ছিল সেটাও কেটে গেছে।

 চলবে

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ