হাসপাতালের সেই রাত ( দ্বিতীয় পর্ব)

 

that night in the hospital second part


আগের পর্ব পড়ুন

হাসপাতালের সেই রাত ( দ্বিতীয় পর্ব


প্রথমে নাকি তারা বুঝতে পারে নি। তাই অভিবাবক কে থাকতে দিয়েছিল পেশেন্টের সাথে। এই  দুঃসংবাদ টা  কানে আসা মাত্রই আকাশের মুখটা মুহূর্তের মধ্যেই থমথমে হয়ে গেল। দুচোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা গাল বেয়ে বইতে থাকলো তীব্র স্রোতের ন্যায়। তার মায়ের চোখ ও ছল ছল করছে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ এর এই গাফিলতির জন্য আমার ও খুব রাগ হলো। আকাশের মা অবশ্য তাদের শেষ অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তা বিফলে গেল। আকাশ তার মায়ের সাথে থাকার জন্য ফিমেল ওয়ার্ডে ছিল। কিন্তু এবার তাকে মেল ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করা হলো। ফলে আমার বা পাশের বেড টা খালি হয়ে গেল। আর আমার ডান পাশে কোনো বেড নেই। আমার বেডের পাশেই ওয়ার্ডে প্রবেশ করার দরজা। সুতরাং আমি একা হয়ে গেলাম। আবার একাও ঠিক না। আমার বা পাশের আকাশদের বেড টা ছাপিয়ে তার পরের বেডে একজন পঞ্চাশ বয়সী মহিলা ভর্তি ছিলেন। বললেন আগামী কালই তার ছুটি। তিনি দীর্ঘ একমাস এখানে ভর্তি আছেন। তার ব্রেস্ট ক্যানসার হয়ে ছিল। এখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কালই তার মেয়ে জামাইরা আসবে তাকে নিতে। দীর্ঘ একমাস পর বাড়ি যাওয়ার আনন্দে তার চোখে, মুখে খুশি র আবেগ স্পষ্ট।   ভাবলাম তাহলে এই বেড টাও কাল খালি হয়ে যাবে। আমার বিপরীত সারি তে একজন মধময়সী ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। আলাপ করার জন্য  তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার কি হয়েছিল? উনি নিচু স্বরে বললেন --  " ইউটেরাসে টিউমার অপারেশন হয়েছে। " এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন। তবে এখনো দিন দুয়েক এখানে থাকতে হবে। তারপাশের আরেকজন মহিলার সাথেও আলাপ হল। ওনার বয়স আমার মতই হবে। সদ্য গতকাল গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে। স্যালাইন চলছে। বুঝতেই পারছিলাম তার কথা বলতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজের বেডে ফিরে এসে শরীরটা এলিয়ে ম্যাগাজিনটা নিয়ে পড়তে থাকলাম।

এর মাঝেই  অবশ্য বিকেলের দিকে ভিজিটিং আওয়ারস এ  বাবা এসে আমার সাথে  কথা বলে গেছেন।আয়া মাসি ও  সন্ধ্যের দিকে এসে কিছু খাবার দিয়ে গিয়েছিলো। সেসব খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটে যাওয়ার পর আমি ম্যাগাজিনের পাতায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এমনই সময়"  ওরে বাবারে ! কি কষ্ট হচ্ছে! মরে গেলাম!  খুব যন্ত্রণা হচ্ছে! কে কোথায় আছো,  আমায় একটু ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিয়ে যাওনা!  বড় কষ্ট হচ্ছে!  এইরকম আর্তনাতে আমার চোখ গেল উল্টো দিকের পাঁচ নম্বর বেডের দিকে। দেখলাম একজন বৃদ্ধা মহিলা কাতর স্বরে চিৎকার করছেন। তার চিৎকারে  দুজন আয়া মাসি এসে  ধরে তাকে ঠিক করে শুইয়ে দিল।  তারপর নিজেদের মধ্যে  গজগজ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে গেল । বুঝতে পারলাম কোনো কারণে তারা ওই পেসেন্টার ওপর অসুন্তুষ্ট। হল ঘরটার আবহাওয়া আবার নিস্তব্ধ হয়ে আসায় আমি আবার কালো অক্ষরগুলোয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ মহিলাটি ঘুমিয়ে পড়লে আয়া মাসীরা জটলা বেঁধে গল্প করার সময় বলছিল  বৃদ্ধা মহিলাটি বড়লোক ঘরের বউ । ওনার  দুটি মেয়ে। বিবাহিত। দুই মেয়ে জামাই মিলে বাড়ি বিক্রি করে সমস্ত অর্থ নিজেদের মধ্যে  ভাগবাটোয়ারা করেছে । বৃদ্ধাকে তারা কানাকড়িও দেয় নি।  দুই মেয়ে এক মাস করে পালা করে নিজেদের কাছে রাখে।  আগের সপ্তাহে কলতলায় পড়ে গিয়ে ওনার পা ভেঙে যায়। মেয়েরা এখানে ভর্তি করে দিয়েই দায় সেরেছে।  ভিজিটিং আওয়ারস এ নিয়মিত দেখতেও আসে না। শুধুমাত্র বিল পেমেন্ট করে ।তাদের কথা শুনে মনে হল সত্যিই এই দুনিয়ায় কত রকম মানুষ আছে,  যাদেরকে আদর-যত্নে মানুষ করলো,  সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করে বড় করে তুলল যোগ্য ঘর দেখে বিবাহ দিলো  আর শেষ বয়সে তাদের থেকে প্রতিদান স্বরূপ এতটা অবহেলা কি শুধুমাত্র তাদের থেকে প্রাপ্য  ছিল ?হসপিটালে নিয়মমাফিক  বিল জমা করলেই সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন হয়ে যায়? মানুষটার প্রতি কোনো দয়া মায়া নেই তাদের হৃদয়এ!  এইসব এলোমেলো চিন্তা গুলো যখন আমার মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলছিল তখনই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স এলেন আমার প্রেসার চেকআপ করতে। এবং অপারেশন হওয়ার  আগে  যেসমস্ত শারীরিক পরীক্ষার ডকুমেন্টস আছে সেই কাগজপত্রগুলো লিপিবদ্ধ করতে। তিনি চারটি  ওষুধ হাতে দিয়ে বলে গেলেন রাতে খাবার পর ওষুধ গুলো খেয়ে নিতে। কাল ভোর  এ উঠে স্নান করে নিতে । সকাল আটটায় আমায়  ও.টি তে নিয়ে যাওয়া হবে।  কথাটা শোনামাত্রই আমার বুকের ভেতরটা চমকে  উঠলো। নানারকম কুচিন্তা ভাবনা মনের আনাচে কানাচে ভিড় জমাতে থাকলো।  চাইলেও সেইসব চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। এদিকে ওসব  চিন্তা বাদ দেওয়ায় ছেলেটার কথা মনে পড়ায় বুকটা হু হু করে উঠলো। চোখের জল কোন বাধাই মানলো না । ঝর ঝর করে বইয়ের উপর টপ টপ করে নোনা জল পড়তে থাকলো। কোনোক্রমে অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাতের খাবারটা খেলাম। তারপর  ওষুধ গুলো খেয়ে শুয়ে পড়লাম । শীতকালের রাত। আমার বেডেরপাশেই দরজা। প্রয়োজনের জন্য চব্বিশ ঘন্টাই দরজাটা খোলা থাকছে। স্বাভাবিকভাবেই সেই জন্যই  আমার ঠান্ডা টাও বেশি বোধ হচ্ছিল । তাই আয়ামাসীর  থেকে আরও একটা কম্বল চাইলাম। রাতের ডিউটিতে থাকা আয়ামাসি হাসিমুখে আর একটা এক্সট্রা কম্বল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল

--- এই বেডের পেশেন্টকে  বরাবরই  একটা এক্সট্রা  কম্বল দেওয়াই  হয়। যা  ঠান্ডা! হু হু করে ঠান্ডা ঢুকে কনকনিয়ে দেয়। আজকের  রুমটাতো দেখেছ পেশেন্টে ঠাসা।  কিন্তু কাল অপারেশন হয়ে পরশু এই রুমে এসে  দেখবে সব ফাঁকা হয়ে গেছে। কারণ দেখো এদের সকলেরই অপারেশন হয়ে গেছে। সব কটার কাল ছুটি । আজকের দিনটা তোমার যতটা তাড়াতাড়ি কেটে গেল, পরশু দিনটা বেশি অস্থির লাগবে। তা যাইহোক এখন শুয়ে পড়ো। কাল ভোর ভোর ডেকে দেবো। গ্রিসার  থেকে গরম জল এনে দেবো। চটপট স্নান সেরে  রেডি হয়ে নেবে। 

এই বলে আয়ামাসি  পাশের বেডে মধ্যবয়সী মাসিকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন। পরদিন অবশ্য আমায় ডাকতে হলো না। রাতের দিকে একটু ঘুমাতে পারলেও ভোররাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বারবার আমার একরত্তি দুধের বাচ্চা টার কথা মনে পড়ায় বেডে শুয়েই অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকি। কি জানি ছেলেটার ঘুমালো কিনা ! সবাই ওকে  সামলাতে পারছে কিনা!  এইসব চিন্তা করতে করতেই ভোরের আলো হাসপাতালে কাচের দেয়াল ভেদ করে হলঘরটায় আবছা আলো বয়ে নিয়ে এলো। ততক্ষণে কোন কোন পেশেন্ট উঠে পড়েছে। নাইট ডিউটিতে থাকা আয়ামাসি  গুলোও তাদের কাজে  ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

---কি গো উঠে পড়ো।  তোমার জল রেডি হয়ে গেছে। 

আকস্মিক আয়া মাসির কণ্ঠস্বরে আমি ধড়মড়  করে উঠে বসলাম বেডে। তারপর  ধীরপায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।  স্নানের জন্য বাথরুমটা ছিল হলঘরের একদম শেষমাথায়। যাইহোক বাথরুমে স্নান করার সময় আমার অন্য রকম একটা অনুভূতি হল। এতক্ষনে  সকাল হয়ে   আকাশ পুরো  পরিষ্কার হয়ে গেছে । সূর্য পূর্ব আকাশটাকে  আলোয় রাঙিয়ে দিয়েছে। বাথরুমে জানালার শার্সি দিয়ে তার অবাধ বিচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার  তীব্রতা কতটা প্রকট। কিন্তু তবুও এই দিনের বেলাতেও আমার গা টা কেমন ছম ছম করে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। 

কিন্তু গতকাল যতবারই বাথরুমে গিয়েছিলাম এই রকম কোনো অস্বাভাবিকতা আমি লক্ষ্য করিনি। হয়তো প্রচন্ড টেনশনে আমার শরীরটা খুবই দুর্বল তাই হয়তো এই রকম বোধ হচ্ছে। এইসব সাধু সাধু ইতিবাচক কথাগুলো আওড়িয়ে  নিজের অন্তর আত্মা কে সান্তনা দিলাম। স্নান সেরে বেরোতেই  ওটি ইউনিফর্ম পড়িয়ে চুল বিনিয়ে  রেডি করে দিল আমায় আয়া মাসি। এরপর আমার ডাক আসলো সার্জেন ডিপার্টমেন্ট থেকে। তখন আমার হৃৎপিণ্ডের গতি আরো  দ্রুত গতিতে চলছে। থর থর করে কাঁপছি। আবার এই শীতের  সকালে কপালে ,নাকের ডগায় বিন্দুবিন্দু ঘামও জমা হচ্ছে। একজন নার্স আমার এইরূপ অবস্থা দেখে আশস্থ করে বললেন 

--- ভয় পাবেন না মিসেস দাস। ওই দেখুন আকাশ পালের একটু আগেই অপারেশন হয়েছে । এখন ও আইসিইউতে আছে।  ওকে একবার দেখুন তো ওইটুকু ছেলের কত সাহস!  আর আপনি খামোখা টেনশন করছেন। নার্সের কথা শুনে মৃদু গতিতে দুরুদুরু বুকে  কাঁচ দিয়ে আবৃত দরজার দিকে চোখ মেলে দেখলাম একটা শান্ত বালক শুয়ে আছে। তখনও ঘুমায়নি। তার দৃষ্টি রুমের সিলিং এর  দিকে আবৃত। হয়তো তার মাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে । আমি আস্তে আস্তে মন শক্ত করার চেষ্টা করলাম। ও.টি  রুমে নিয়ে যাবার পূর্বে আমার বাবা , আর হাজব্যান্ড এর  সাথে তারা  সাক্ষাৎ করিয়ে দিলেন। ও.টি রুমে গিয়েই ডাক্তার বাবু এক  খানা ইঞ্জেকশন দিলেন।  তারপর আমার কোন জ্ঞান ছিল না। অপারেশন সফল ভাবে  মিটে যাওয়ার পর আমায় আইসিইউতে তারা শুইয়ে দিলেন । তখনই আমার ধীরে ধীরে জ্ঞান এলো। অস্পষ্ট ভাবে দেখলাম আমার হাজব্যান্ড  দূর থেকে হাত নাড়া দিচ্ছে । কর্তব্যরত নার্স আমায় হাত তুলে জানান দিতে বললেন যে আমার জ্ঞান  এসে গেছে এটা যেন পেশেন্ট পার্টি বুঝতে পারে।  কথামতো তাই করলাম। আমার অপারেশন পর্ব মিটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছিল । একটা মাইক্রোসার্জারি স্টোন অপারেশন করতে ম্যাক্সিমাম সময় লাগছিল হয়তো আধাঘন্টা। কিন্তু অনেক পেশেন্ট থাকায় আমার অপারেশন টা হতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। সেদিন আর বিকেলের দিকে গার্জেনরা দেখা করতে এলো না। ওইটুকুই যা চোখের দেখা দেখলাম ।আমার ছেলেটার কোন খবর না পাওয়ায় খুব কষ্ট হচ্ছিল ।এদিকে সদ্য অপারেশন হওয়ায় জ্ঞান ফিরতে ব্যথা-যন্ত্রণাও ঢের টের পাচ্ছিলাম। আমার পাশের বেডে থাকা একজন পেশেন্ট ক্রমাগত বমি করেই চলেছে। সেই আওয়াজে আমার শরীরের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়লো। কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করলাম। কারণ সদ্য স্টিচ  দেয়া হয়েছে। এই সময় শরীরের উপর চাপ দিয়ে বমি করতে গেলে হয়তো আরো বিপদ ঘটতে পারে। এই আশঙ্কা করে জোর করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম । ঘুম ভাঙলো তখন হয়তো মধ্যরাত।  স্যালাইন  চলতে থাকায় প্রচণ্ড চাপ ছিল। বাথরুমে যাওয়াটা আবশ্যিক মনে হলো। দুর্বল শরীরে ভগ্ন গলায় আমি আয়ামাসীকে ডাকলাম সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলেন তার সাহায্যে আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলাম।এতক্ষণ একভাবে শুয়ে ছিলাম তাই হয়ত যন্ত্রণাটা অতটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু  বেড ছেড়ে উঠতে গিয়েই শরীর টলমল করলো। পারলাম না নিজের ভরসায় উঠে বসতে। আয়া মাসির হাত ধরে আস্তে আস্তে উঠতে চেষ্টা করলাম।

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ