রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) তৃতীয় পর্ব

 

ranjabati part three


রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) তৃতীয় পর্ব

মালতির কথায় আবার সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বিয়ে বাড়ি কোলাহলে মেতে উঠল। সকলে দধিমঙ্গল এর আয়োজনে ব্যস্ত ।ওদিকে একমাত্র কন্যার আজ বিয়ে। তাই রাজ নারায়ণের মনটা আজ বিষন্নতায় ভরা । রঞ্জাবতী দধিমঙ্গল এর নিয়ম পালন করার পর বাবার ঘরে ঢুকতেই দুজন দুজনকে দেখামাত্র জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে  রঞ্জাবতী বলে -- তুমি দেখে নিও বাবা আমি ঠিক এসে তোমাকে কলকাতায় নিয়ে যাব ।
-- দূর পাগলি! ওটা তোর শ্বশুর বাড়ি। ওখানে কি আমার সবসময় থাকা চলে। এখানে মালতি আছে,  লক্ষণ আছে পাড়াপ্রতিবেশী সকলে আছে। সকলে আমায় কত ভালোবাসে বলতো ? আমি ভালোই থাকব। তুই একদম চিন্তা করবি না কেমন ! কিশোরীলাল বড় ভালো ছেলে। তুই দেখিস তুই ওখানে ভালোই থাকবি ।তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুব ভালো, বিনয়ী, অমায়িক। দেখিস ওখানে গিয়ে ওনাদের ভালোবাসা পেয়ে  আমাদের হয়তো ভুলেই গেছিস। 

-- তুমি এত বড় কথা বলতে পারলে বাবা?
 সেই কোন ছোটবেলা  থেকে আমি তোমার,  আর তুমি আমার সঙ্গী। এ  সম্পর্ক কি কখনো ভোলার ?
--আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক আছে। এমন কথা আর কক্ষনো বলব না। এবার চোখের জল মুছে নে। এমন দিনে কেউ এভাবে কাঁদে রে  মা।
--তবে তুমি কেন কাঁদছো?  ঠিক আছে। এই আমি চোখের জল মুছলাম।

 তাদের এই কথোপকথনের সময় মালতি পিসি দরজায় টোকা দিল। দরজা খোলাই ছিল। রাজনারায়ন বললেন--  দেখ না মালতি,  পাগলী  মেয়ে আমার রঞ্জা। বলি আজ ওর বিয়ে। আর কেমন কাঁদছে দেখ বাচ্চা দের মতো।
-- ওর আর  কি দোষ বলো দাদা? ওর যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। জন্মের সময়ই মাকে হারিয়েছে। এমন দিনে সব মেয়েরাই একটু মায়ের সোহাগ পেতে চায়। ওর বাবাই বলো আর মা ই বলো  সবই যে তুমি। তোমার যদি ওই অলুক্ষণে  রোগ টা না হতো তাহলে  কি তুমি এত তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে রঞ্জা কে?  কেউ না জানুক । আমিতো জানি। এ বাড়িতে বহু বছর কাজ করছি। রঞ্জা কে ঘিরে  তোমার কত স্বপ্ন , রঞ্জা  অনেক পড়াশুনা করবে,  কলকাতায় যাবে,  কলেজে ভর্তি হবে।  কত পরিকল্পনা তুমি রঞ্জা কে নিয়ে করতে। সবই ভাগ্যের পরিহাস গো দাদা। তবে দেখে নিও দাদা এই আমি কোয়ে দিচ্ছি। এই  মালতির কথা মিলিয়ে নিও। রঞ্জা শ্বশুরবাড়িতে বেশ সুখেই থাকবে। আমি তো সব গিয়ে দেখে এলুম। কি সুন্দর তাদের ব্যবহার। আমরা গ্রাম থেকে এসেছি তবু আমাদের সাথে কি সুন্দর  সাধারণ ভাবে মেলামেশা করলেন তারা। কত বড় কারখানা ওদের, কলকাতার বুকে ওতো বড়ো বাড়ি , সম্পত্তি তবু তাদের মধ্যে কোন অহংকার এর লেশমাত্র নেই।  তোর কথাই যেন সত্য হয় মালতি। মা মারা মেয়েটা যেন ওখানে গিয়ে একটু মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পায়। আর দেখাশোনায় তো একজন মহিলা যাওয়া খুব দরকার ।সেই জন্যই তো তোকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। এক্ষেত্রে মেয়ে মানুষের চোখ একেবারে জহুরীর চোখ যাকে বলে। তুই যা বলছিস তা  যেন সত্যিই হয় রে। তোর মুখে ফুল চন্দন পরুক।
 রঞ্জা এতক্ষন মাথা নিচু করে মালতি ও তার বাবার কথা গুলো শুনছিলো। শশুর বাড়ীর সম্পর্কে এইসকল কথা গুলো ওর শুনতে বেশ লাগে। রাজনারায়ন এবার রঞ্জা কে বলল--, মা  আমার ,  এবার তোমার মায়ের ছবিটায় একটা ফুলের মালা পরিয়ে মাকে প্রণাম করো। রঞ্জা টেবিলে রাখা তার মায়ের ছবিটার কাছে এগিয়ে গেল।  মায়ের ছবিটায় চন্দন দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। তার চোখে তখন জল টলমল করছে। টেবিলের উপর ছবির পাশে থাকা রজনীগন্ধার মালাটা মাকে পরিয়ে দিতে দিতে কাঁপা কাঁপা গলায় সে  বলল 
বাবা,  মালতি পিসি তোমরা একটু বাইরে যাবে?  আমি একটু মায়ের ছবিটার কাছে বসতে চাই।
-- আচ্ছা, ঠিক আছে।  বেশি দেরি করিস না মা।
 --ঠিক আছে গো। 
রাজনারায়ণ, ও  মালতির  প্রস্থানের পর টেবিলের সামনে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে এসে ছবির সামনে এসে বসলো রঞ্জা।  বাইরে তখন পাড়া-প্রতিবেশীদের কোলাহল অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে । এই ঘরটা রঞ্জা দের উঠন  থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে। দক্ষিণ দিকের একেবারে শেষমাথায়। আর বিয়ের প্যান্ডেলটা যেহেতু বিরাট উঠোন জুড়ে হয়েছিল তাই  সেখানেই ছিল  আমন্ত্রিতদের ভীড়।তারা নিজেদের মধ্যে আনন্দ করতেই ব্যস্ত। কেউ কেউ তো সকালের জল খাবার খেতেও শুরু করে দিয়েছে। কেউই তখন রঞ্জা কে নিয়ে মাথা ঘামায় নি।  কারণ কলকাতা থেকে ছেলের বাড়ির গায়ে হলুদ আসতে দেরি হবে। তাই এখন রঞ্জাকে তেমন প্রয়োজন নেই। রাজনারায়ন বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্যান্ডেলওয়ালা ও ডেকোরেটর দের  সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। লক্ষণ কাকা হালিকরদের   দুপুরের রান্নার সবজি, মুদিখানা  বোঝাতে ব্যস্ত।

 রঞ্জা মায়ের ছবির সামনে বসে প্রথমে কিছুক্ষণ তার মাকে দেখতে থাকলো। আজ সে তার মা কে যেন আরো নতুন করে আবিষ্কার করলো। তার মাকে যেন তার মনে হলো অপরূপ সুন্দরী এক অল্পবয়সী কন্যা। তারপর মায়ের সাথে কথা বলতে শুরু করল-- মাগো এই পৃথিবীতে তোমার আয়ু এত কম ছিল কেন?  আমি তো তোমার স্নেহ কি জিনিস না হয় বাদই দিলাম তোমার ছোঁয়াটুকু থেকেও বঞ্চিত।  আমি তোমার স্তন্যপান পর্যন্ত ও করতে পারি নি।  শুনেছি আমায় জন্ম দিতে গিয়ে তোমার মৃত্যু হয়েছিল। তবে কি আমি অপয়া?  যদিও আমায় এ কথা কেউ কোনোদিন ও বলেনি। আজ নিজে কেই যেন খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। জান মা,  আজ যদি তুমি বেঁচে থাকতে বাবা অনেকটা ভরসা পেত। কিন্তু আমি  এমনই হতভাগ্য দেখো বাবা অসুস্থ তবু তাকে রেখে আমায় চলে যেতে হবে শ্বশুরবাড়িতে। এইসব সমাজের কি রকম নিয়ম। আমি কি পারি না বাবাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে ? বল না ? মা চুপ করে থেকো না। তুমি তো জানো মা আমাকে নিয়ে বাবার কত স্বপ্ন দেখতো। অনেক লেখাপড়া করাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। কেন মা?  কেন বারবার আমি আর বাবা জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি? কেন? কেন আমাদের কোন আশাই পূর্ণ হচ্ছে না? বাবা চাইলেই অন্য একটা বিয়ে করে নতুন বউ বাড়িতে আনতে পারত । শুধুমাত্র আমার কথা ভেবে আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিয়ে করেনি। মানুষ টা শুধু সারাজীবন আমার কথাই ভেবে গেল আর আজ আমার ভালোর জন্যই আমার বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিচ্ছে। কারণ বাবার ধারণা বাবার রোগটা হয়তো আর সারবে না। তাই আমার জীবনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কিন্তু মা , তুমি দেখো একটু বাবাকে । বাবা যেন সুস্থ হয়ে যায়। আমি ও বাড়িতে গিয়ে তেনাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাবাকে নিয়ে যাব কলকাতায়। বড় ডাক্তার দেখাবো। বাবাকে সুস্থ করে তুলবো। বাবাকে যে ভালো হতেই হবে। বাবা ছাড়া যে আমার আপন কেউ নেই। আশীর্বাদ করো মা আমার নতুন জীবন যেন সুখের হয় । ও বাড়ির  সকলের মনের মত যেন হতে পারি। সকলের ভালোবাসা যেন অর্জন করতে পারি।

চলবে....


ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ