রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) চতুর্থ পর্ব
সই , এতক্ষণ কি করছিস দোর দিয়ে? এমন দিনে ওতো মন খারাপ যে করতে নেই।
বাইরে থেকে কাননের কণ্ঠস্বর শুনে রীতিমতো চমকে ওঠে সে। সেই যে বিয়ে হলো কাননের তারপর কেবলমাত্র মাঝে একবারই তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। চোখের জল মুছে সে প্রায় এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে ছিটকিনি টা খুলল।
-- এতদিনে বুঝি আমার কথা মনে পরল কানন?
-- সেসব কথা পরে হবেক্ষণ। আগে বল পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন হল?
--ওই ছাই পাসের এর কথা আর জেনে কি করবি বল? পাস করেছি এইটুকু জেনে রাখ। আমি তোর দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না রে কানন। এইদিকে অসুস্থ বাবাটা কেও রেখে আমায় চলে যেতে হবে। আমি আর পড়াশোনার কথা চিন্তা করি না রে। আমি শুধু চাই আমার বাবাটা সুস্থ হয়ে উঠুক। ভালো হয়ে যাক।
তবুও সই আমার মন অন্য কথা বলছে। দেখবি তুই কলকাতাতে গিয়েও হয়তো পড়াশোনাটা আবার শুরু করতে পারবি। মালতি পিসির কাছ থেকে তো শুনলাম তোর শ্বশুরবাড়ির গল্প। শুনলাম তোর বর খুব ভালো মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন পড়াশোনার মর্ম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে কারণ বলল আমার আর এগিয়ে যাওয়া হলো না রে । সব আশার আলো নিভে গেছে। আমার শ্বশুরবাড়ি বনেদি পরিবার। জ্যাঠ তুতো, খুড়তুতো শশুর দের ও সব আমার বয়সী বৌমা রা আছে। আমি একা পড়াশোনার জন্য দাবী করলে, তাদের মধ্যেও বিদ্রোহ জাগতে পারে। তাই আমার স্বামীর ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের কথা চিন্তা করে তিনিও আমার এই ইচ্ছার পাশে থাকতে পারেননি। কথাগুলো বলতে বলতে অজান্তেই জলের ধারায় কাননের গাল দুটো ভিজে গেল। দুই হাত দিয়ে চোখের জল তাড়াতাড়ি মুছতে মুছতে মলিন মুখে একটু চওড়া হাসি নিয়ে সে বললো তবে আমার জন্য আমার উনি অনেক গল্পের বই নিয়ে আসেন। সন্ধ্যেবেলা, কাজের অবসরে সেগুলো পড়ি। আবার কখনো কখনো শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী পড়তে পড়তে এতটাই বিভোর হয়ে পড়ি যে সারা রাত কেটে যায়। এই সবের মধ্যেই আমি বাঁচার রসদ খুঁজে নিয়েছি। তবে এখানে আসার অনুমতি খুব একটা মেলে না। তাই তোর সাথে দেখাও হয় কম। আমার মেজ জা পোয়াতি। দীর্ঘদিন যাবৎ বাপের বাড়ি আছে। খুড়তুতো একটা জা এর তো সদ্য বাচ্চা হয়েছে। তাই সেও আছে পিতৃগৃহে। তাই বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা থাকায় সংসারে মন ও ঠিক বসছিল না। তার উপর হঠাৎ করেই তোর বিয়ের সংবাদ পেলাম। তাই আমার উনি শশুর মশাইকে রাজী করিয়ে আমায় এখানে আনলেন।
-- তা , তোর বর মশাই টা কই? তার তো কোনো পাত্তাই নেই।
--- আর বলিস না! উনি ভীষণই লাজুকে। আমাদের বাড়িতেই আছেন। সন্ধের আগেএ বাড়িতে আসছে না।
তবে তুই আমার একটা কথা শুনিস ।শেষ চেষ্টা করে দেখিস -- কলকাতায় বিয়ে হচ্ছে তোর । সেখানে পড়াশোনার সুযোগ আরো বেশি।
--কানন , কিরে! রঞ্জার মন খারাপ একটু কমাতে পারলি? নাকি তোকে এখানে পাঠানোই আমার সার হলো। আসলে মা মরা মেয়ে তো । তাই আজকের দিনে মায়ের কথা মনে পরে বেচারি খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুই এসে গেছিস। আর কোন চিন্তা নেই । রঞ্জাকে গায়ে হলুদের জন্য তৈরি করে দে। ও বাড়ি থেকে তত্ত্বে পাঠানো গায়ে হলুদের বস্ত্র গামছা সব দালানে রাখা আছে। তোর মনের মত করে সাজিয়ে দে।
রঞ্জা কে মনের মতো করে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো কানন। রাজনারায়ন দেরাজ থেকে তার স্ত্রীর গয়না গুলো বার করে দিলেন। নতুন করে তিনি আর গয়না কেনেন নি। বাবা কে দেখে রঞ্জা বললো
সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরছ বলো তো বাবা? তোমায় বলেছি না তুমি বেশি চাপ নেবে না। ওষুধ গুলো খেয়েছো? নাকি ভুলে গেছো? তোমার শরীর ভালো নয় বাবা। আহামরি কিছু ব্যবস্থা করতে হবে না। যত টুকু আয়োজন তা লক্ষণ কাকা, আরো সবাই আছে তারা সকলে মিলে সামলে নেবে। তুমি অনিয়ম করলে শরীর আরো খারাপ হলে আমি ও বাড়ি গিয়ে কি শান্তি পাবো ? তুমি ই বলো?
-- না রে মা। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি নি। ওষুধ ও ঠিক মতো খেয়েছি। আজ আমার রঞ্জা মায়ের বিয়ে আমায় তো সুস্থ থাকতে ই হবে। নে কানন, গয়না গুলো রঞ্জা কে পরিয়ে দে। নিজের মায়ের গয়নায় রঞ্জার অঙ্গ ভরে গেল। সীতাহার , বিছে হার কানের ঝুমকো, হাত ভর্তি কঙ্কন, বালা মানতাসায় হাত ভরে উঠলো।
বাইরে কোলাহলের শব্দ টা আরো গাঢ় হয়ে এলো । শঙ্খ ধ্বনি, উলুধ্বনিতে তখন কান পাতাই দায়। সঙ্গে হৈ, চৈ এর মাত্রাটা আরো অধিক। রঞ্জা আর কানন দুজন এই ছুটে জানলা দিয়ে ব্যাপারটা দেখার জন্য চোখ রাখল বাইরে । ঘোষ গিন্নি ও রায় গিন্নিকে বলতে শোনা গেল তিন তিনটে ট্যাক্সি এসেছে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে। প্রথম গাড়ি টা তেই তো কত কিছু এলো। আবার আসছে। কি বুঝলি বড়ো লোকের সব ব্যাপার। এত ঘটা বাপের জন্মে আগে দেখি নি বাপু। রঞ্জা খুব সৌভাগ্যবতী। না হলে আর ওতো বড় বাড়িতে বিয়ে হয়। চ লো তাড়াতাড়ি পা বাড়িয়ে চল। দেখি গিয়ে বরের বাড়ি থেকে কারা তত্ত্ব নিয়ে এলো। আবার কি কি এলো দেখি।
---কি বুঝলি? গায়ে হলুদ এর তত্ত্ব দিতে আরেক দফা গাড়ি আসছে। এবার তেনার গায়ের হলুদের ছোঁয়া তোর গায়ে লাগবে । কিরে এবার তো বোধহয় একটু একটু প্রেম ট্রেম লাগছে প্রাণে তাইতো? ---ধুর কি বলিস না? তাকে তো আমি দেখিই নি ।
ওহঃ সখী এত উতলা হয়ে পরলে চলবে? আর তো কিছুক্ষণের অপেক্ষা মাত্র। তার পরই শুভদৃষ্টির সময়। তখন না হয় দুচোখ ভরে দেখে নিস।
কাননের কথায় রঞ্জার
মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
--- ইইস ! , আমার সই কে লজ্জা পেলে এত সুন্দর লাগে আগে কখনো দেখিনি তো।
--- কই রে কানন , তোর সই কে প্রাণ ভরে সাজানো হলো?
-- হ্যা হয়ে গেছে মালতি পিসি। তুমি ঘরে এসো।
--- জানিস ও বাড়ি থেকে কত কত তত্ত্ব পাঠিয়েছে। আগের গাড়ি টায় শুধু গায়ে হলুদের শাড়ি, সাজগোজ এর জিনিসপত্র আরো কিছু শাড়ি এই সব জিনিসপত্র এসেছেছিল। আমরা ভাবলাম এই গুলোই হয়তো পাঠিয়েছে। গায়ে হলুদের শাড়ি টা তাই ওখান থেকে নিয়ে পরিয়ে দিতে বললাম। কিন্তু ও বাড়ি থেকে প্রথম গাড়িতে করে ভদ্রলোকটি তত্ত্ব নিয়ে এলেন তিনি বলেন তেল হলুদ এর বাটিটা এই গাড়িতে নেই। পরের গাড়িতে আসবে ।পরের গাড়ি আস্তে একটু বিলম্ব হবে। ততক্ষণে কনেকে সাজিয়ে দিন। ওই গাড়িতেই ইরাবতী আসছে। সেই তার বউমণির জন্য গায়ে হলুদের বাটি আনছে। কত ধরনের মিষ্টি, সন্দেশ, রাবরি দামী দামী শাড়ি, ফল ,দাদার জামা এমন কি আমার জন্য লক্ষণ এর জন্যও তারা নতুন জামা-কাপড় পাঠিয়েছেন।
কানন হা করে সেই সব কথা শুনছে মালতি পিসির থেকে। ও দিকে ইরাবতীর নামটা শোনামাত্র রঞ্জার বুক টা কেমন একটা অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকলো। সে শুনেছে সংসারে ননদ থাকা মানেই ঝগড়া,অশান্তির সৃষ্টি।
চলবে...
ছবি : নিজস্ব
0 মন্তব্যসমূহ