রঞ্জাবতী (পারিবারিক গল্প) দ্বিতীয় পর্ব

 

ronjaboti paribarik golpo part two

আগের পর্ব পড়ুন

রঞ্জাবতী (পারিবারিক গল্প) দ্বিতীয় পর্ব


বাভাবিকভাবেই এই বিয়েতে রঞ্জাবতীর প্রথম থেকেই কোনো উৎসাহ ছিল না। প্রথমত তার পিতার শারীরিক অসুস্থতা,  অন্যদিকে তার উচ্চশিক্ষায় বাধা। কিন্তু মানুষের মন  যা চায় সেই সব ইচ্ছে অনেক সময় সম্পূর্ণ সফল হয়না। রঞ্জাবতীর  তখন তাই মনে হচ্ছিলো।

 অসুস্থ রাজনারায়ণ তার কিশোরী মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এই  বিয়েতে রাজি করিয়েছিলেন। 


রঞ্জাবতী কে বিয়ের আগে দেখাশোনয় দেখতে এসেছিলেন তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দুই নন্দাই, তিন ননদ,  অলক কাকা , আর আশা কাকি । প্রথম দেখাতেই রঞ্জাবতী র  শাশুড়ি মায়ের খুব পছন্দ হয় সুলক্ষণা,  উজ্জ্বল , গৌরবর্ণা রঞ্জাবতী কে।  শাশুড়ি রাধারানী দেবী কে রঞ্জাবতীর শশুর তখনই বলেন-- "রঞ্জাবতী নামটা আমার বেশ পছন্দের। রানীকে দেখেই মনে হচ্ছে খুব শান্ত সরল তাইনা গিন্নি? " "ওমা নাম যে রঞ্জাবতী, তা তুমি রানী কোথা থেকে পেলে? ওই হল গিন্নি।  বাড়ির বউমা কে আদর করে স্নেহের খাতিরে রানী বলা যায় না বুঝি?" রঞ্জাবতীর  শশুর তারক বাবু এ হেন কথায় রাজনারায়ণ মনে শান্তি পেলেন। তার এই রূপ কথার অর্থ  যে রঞ্জাবতী কে   তারা তাদের গৃহের পুত্রবধূ রূপে গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাই উভয়পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সেদিনই বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। বৈশাখ মাসের পনেরো তারিখ বিবাহ দিন স্থির করা হয়। কিন্তু রঞ্জাবতীর সাথে কিশোরী লালের বিবাহের আগে কোন সাক্ষাৎ হয়নি।


 দেখাশোনা মিটে যাওয়ার পর রাজনারায়ন ও মালতী পিসি  কলকাতায় গিয়ে কিশোরীলাল কে দেখে আসেন। তাদের কলকাতায় আসার ব্যবস্থা তারক বাবুই করেন । সেই মতো তাদের কলকাতায় আসার জন্য তিনি গাড়ি পাঠান সরিষা পুরে। রাজনারায়ন ও মালতি কলকাতায় পৌঁছে  গাড়ি থেকে নেমে তারক বাবু বিশাল বাড়িখানা বাইরে থেকে দেখে অবাক হয়ে যান। রাজনারায়ণ মনে মনে ভাবেন আমার রঞ্জাবতী মা নিশ্চয়ই ঠাকুরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত। তাই এত বড় বাড়ি এমন সজ্জন পরিবারে তার বিবাহ ঠিক হয়েছে।


 বাড়িতে প্রবেশ মাত্রই অন্দরমহল এ হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল । অলক কাকা ও আশা কাকী তাদের   বিশাল ড্রইংরুমে তাদের বসতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তারক বাবু ও কিশোরী লালের মা ও হাজির হলেন।  তারক বাবু এখন মহাখুশি রাজনারায়ণ কে আঁকড়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। শহরের উচ্চবিত্ত মানুষের যে এত বিনয়ী ব্যবহার  তা রাজনারায়ন কে মন থেকে আপ্লুত করলো।  মালতি পিসিও সুযোগ বুঝে রাজনারায়ন এর কানের কাছে আস্তে করে বললো এ-যে সোনার সংসার দেখছি দাদাবাবু।


 কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের পরই আশা কাকী সু অঙ্কিত কাচের প্লেট এর উপর দুটি বিশাল আকার কাঁচের গ্লাসে জল আনিলেন।  এই ধরনের কাচের প্লেট গ্লাস সচারাচর গ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় না। তাই রাজনারায়ন ভাবলেন তারক বাবুরা  নিশ্চয়ই গ্রামের ওই কাসারের গ্লাসে সেদিন জল খেতে  সংকোচ বোধ করছিলেন বোধ হয়। রাজনারায়ণ এর এই সমস্ত ভাবনায় জল ঢেলে তারকনাথ বললেন -- "বুঝলেন দাদা আজকাল এই হয়েছে শৌখিনতার যুগ,  কাসারের গ্লাসের বদলে এসেছে কাচের গ্লাস।  তা আপনার বাড়িতে কাসারের গ্লাসে জল পান করে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি মাইরি বলছি। তাছাড়া কাসারের গ্লাসে জল পান করা তো স্বাস্থ্যে র পক্ষেও উপকারী।  তারকনাথের কথায় রাজনারায়ণ এবার নিজেকে একটু হালকা বোধ করলেন। জল পান করার পরেই এল রকমারি মিষ্টির সম্ভার।  এই সকল নতুন ছাঁচের সন্দেশ , মিষ্টি রাজনারায়ন আগে দেখেননি । তারকনাথ বাবু বললেন--" দাদা আপনি শুরু করুন। আমি না হলে শুরু করতে পারছিনা । আমি কিন্তু আপনার বাড়ি গিয়ে সব মিষ্টি, নাড়ু মুড়ির মোয়া খেয়ে এসেছি। কোনোটাই বাদ  দেই নি। আহা !  ঘরের তৈরি নাড়ু, মোয়ার স্বাদ টাই অতুলনীয় ...কি বলেন মাস্টার মহাশয়?" বলেই তারক বাবু মিষ্টি খেতে শুরু করে দিলেন । আসলে তারক বাবু মানুষটি যেমন বাক্য রসিক,  তেমনি খাদ্য রসিক। তাই বাড়িতে অতিথি আগমন ঘটলে  তিনিও তাদের সামনে এক প্লেট মিষ্টি খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেন। রাজনারায়ণ যতই দেখেন তারক বাবুকে ততই অবাক হয়ে যান। এমন অমায়িক সাদাসিধে মানুষ টি রঞ্জাবতীর শ্বশুরমশাই হতে চলেছেন  দেখে আনন্দে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না তিনি। মিষ্টি খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ইরাবতীর উপর দায়িত্ব পড়ল গোটা বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজনারায়ন দের দেখানোর। ইরাবতীর হলো রঞ্জাবতী র ছোট ননদ। তার তখন বিবাহ হয় নি। সে রাজনারায়ন ও মালতি পিসি কে প্রণাম করে তাদের প্রথমে নিয়ে গেলেন বাড়ির  মন্দির দর্শন করাতে। মন্দির দর্শন এর পর শয়ন কক্ষ, রন্ধনশালা, বৈঠকখানা, কিশোরী লালের ঘর ,বাড়ির লাগোয়া বাগান সমস্ত কিছু দেখিয়ে মালতির চোখ ধাঁধিয়ে তারা যখন আবার ড্রইং রুমে ফিরে এলো তখন প্রায় বেলা এগারোটা টা হবে। 


ড্রইং রুমে ফিরে এসেই গাওয়া ঘি এ ভাজা লুচি  ও কচি পাঁঠার মাংস সহযোগে রাজনারায়ণ বাবুদের সাথে একসাথে খেতে বসলেন তারক বাবু। তিনি  মুখে এক খান লুচির টুকরো  চালান করে দিয়ে বললেন--" তা যাই বলেন দাদা , ওই মুখেই বলি  গাঁওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি। ঘিয়েতে নির্ঘাত ভেজাল তো আছেই। ঘি হলো গায়ের গরুর দুধের সর তুলে যে  মাঠা পরে তাকে জাল দিয়ে তৈরি হয় ঘি। ওহঃ তার স্বাদই আলাদা। এবার আমাদের  বের হতে হবে চটপট খেয়ে নিন রাজনারায়ন বাবু। আর মালতি দি আপনি বরং আমার স্ত্রীয়ের সাথে এই ফাঁকে একটু গল্পগুজব করে নিন।

-- কিন্তু কোথায় যাব এখন দাদা? যদি একটু বলতেন?

---সেকি মেয়ের বাড়ি দেখতে এসেছেন , তা পাত্র না দেখেই চলে যাবেন নাকি? --কিশোরীলাল কে দেখবেন না? আপনার একমাত্র কন্যার হবু স্বামীকে? চলুন দেখবেন চলুন কিশোরী আমার কত দক্ষতার সহিত কারখানার কাজ একাই দেখাশোনা করছে।


 কিছুক্ষণ পর রাজনারায়ন কে সঙ্গে নিয়ে  তারকনাথ বাবু গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লেন কারখানা উদ্দেশ্যে।  বাড়ি থেকে অবশ্য বেশি দূরে নয়। কারখানার সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই রাজনারায়ন অবাক হয়ে দেখলো এ তো যেমন তেমন কারখানা নয়। কারখানার সামনে  বিশাল বড় গেট। অনেক  কর্মচারী এখানে কাজ করছে। তারকনাথ বাবু ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে রাজনারায়ন  কে কারখানা দেখানোর পর সাক্ষাৎ করালেন কিশোরী লালের সাথে। তার সাথে পরিচয় হওয়া মাত্রই রাজনারায়ন কে দেখেই সে প্রণাম করল। রাজনারায়ণ বাড়ি থেকে যে রঞ্জাবতীর ছবিটা বুক পকেটে এনেছিল তা দেখাবার জন্য কিশোরীলাল  দিলেন। এবং বললেন-- "দেখো বাবা, এই  আমার মা মরা এক রত্তি মেয়ে রঞ্জাবতী। খুবই লক্ষ্মীমন্ত,  লেখাপড়ায় মেধাবী। ওর ইচ্ছা ছিলো আরো পড়াশোনা করার।  কিন্তু আমার শরীরের অবস্থার  কথা চিন্তা করেই  ওর বিবাহ স্থির করেছি। আমার শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। নেহাতই তোমার বাবা এখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি পাঠিয়ে ছিলেন তাই আসতে পেরেছি এতদূর। না হলে বাস পরিবর্ত   করে ট্রেনে করে আমার পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হতো না। আর এখানে যেহেতু আসলাম তাই রঞ্জাবতীর একটা ছবি সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।


-- আরে পাগল ছেলে,  হা করে আমার দিকে কি তাকিয়ে দেখছিস? নিজের হবু বউকে একবার দেখ।  তার জন্য আবার অনুমতির অপেক্ষা করছিস ।দেখ দেখ ভালো করে দেখ। তোর বাবা মা তোর জন্য খারাপ পাত্রী পছন্দ করে নি রে। ছবির দিকে তাকিয়ে কিশোরীলাল মুহূর্তের মধ্যে কিছুক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে ছিলেন । রঞ্জার মায়া মাখা মুখখানা, ডাগর দুটো চোখগুলো দেখে কিশোরীলাল নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি। ক্ষনিকের  এর জন্য হলেও তার মনে হচ্ছিল কোন সুন্দরী মেয়ে তার সামনে বসে আছে। কিশোরী লালের এহেন মনের অবস্থা দেখে তারকনাথ বাবু রাজনারায়ন কে বলেন -- "দাদা এই ছবি মনে হয় আর আপনি বাড়ি ফেরত নিয়ে যেতে পারবেন না । " বাবার এই রূপকথায় কিশোরী লালের ঘোর কাটে। লজ্জায় টেবিলের উপর ছবি খান রেখে অফিস  ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে ।


 তারপর সেদিন বাড়ী ফিরতে তাদের বেশ রাত হয়ে যায় ।মালতি  সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন রঞ্জাবতী কে শোনাতে থাকে তার শ্বশুরবাড়ির প্রাচুর্য,  সম্পত্তি ভদ্র ,নম্র মানুষগুলোর কথা। সেই সব কথা শুনতে শুনতে রঞ্জাবতী এক সুখের সংসার রচনা করে। মনে মনে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু মালতি পিসি একটাই আক্ষেপ থেকে যায় অতদূর গেলেও তার সাথে কিশোরী লালের সাক্ষাৎ না হওয়ার বেদনা। তাইতো রঞ্জাবতী কে  সে বলতে পারেনা কিশোরীলাল কে দেখতে কেমন ।


 এদিকে দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে । আগের দিন রাতে এপাশ-ওপাশ করে সারাটা রাত কাটিয়েছে রঞ্জাবতী। তাই ভোরের দিকে একটু গাঢ় ঘুম এসেছিল। ঘুম ভাঙলো আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী দের আওয়াজে। মালতির ডাকে রঞ্জাবতী দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই মালতি বলল-- বাবা!  রঞ্জা তুই কি ঘুম ঘুমোচ্ছিস রে? একেই বলে" যার বিয়ে তার হুশ নেই আর পাড়াপড়শির ঘুম নেই।"

চলবে....

পরের পর্ব পড়ুন

 ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ