রঞ্জাবতী (পারিবারিক গল্প) পঞ্চম পর্ব
যথারীতি গায়ে হলুদের পরবর্তী গাড়িটি রঞ্জা দের বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হল। রঞ্জার ননদ ইরাবতী সেই গাড়িতেই এসেছে। বিত্তশালী পরিবার এ জন্ম হওয়ায় ইরাবতীর শরীরে চাকচিক্য , পরনে সালোয়ার-কামিজ টির আভিজাত্য বেশ দেখার মত। ইরাবতী যেমন ফর্সা তেমনি তার টানা টানা মায়াবী চোখ, বাঁশির মতো সরু নাক, আর পানপাড়া মুখে সদা হাসি বিদ্যমান। কনের বাড়ি উপস্থিত সকল আমন্ত্রিত মহিলারা একে অপরের কাছে বলাকওয়া করছে -- রঞ্জার ননদটিকে ভারী সুন্দর দেখতে। সে দিক থেকে আমাদের রঞ্জার মুখশ্রী ভাল হলেও গায়ের রং টা বড্ড বেশি চাপা। যাদের বাড়িতে ওমন রূপবতী কন্যা আছে, তারা এই অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েকে কিভাবে পছন্দ করলো তা যথেষ্ট ভাববার বিষয়। আবার অনেকে বলতে থাকলো ঐ যে কথায় আছে কিনা --"জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে" সেই রকমই ব্যাপার। আমাদের রঞ্জার কপালে ছিল তাই হচ্ছে।
ইরাবতী সাথে অলক কাকাও এসেছে। অলক কাকা ইরাবতীর নিজের কাকা নয়। অলক কাকা কিশোরীলাল দের বাড়ির দীর্ঘ দিনের কাজের লোক। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেও বাড়িতে কাজ করে। কিশোরীলাল দের পরিবারের সকল সমস্ত শুভ অনুষ্ঠানে অলক কাকা যান। ওনাকে আর বাড়ির অন্যান্য সদস্য দের মতোই গুরুত্ব দেওয়া হয়। উনি এখন ওই পরিবারেরই সদস্য।
ইরাবতী গাড়ি থেকে নেমেই রঞ্জার খোঁজ করতে থাকলো আমন্ত্রিত দের কাছে। রাজনারায়ণ বাবু নিজে এসে ইরাবতীকে রঞ্জার ঘরে নিয়ে এলেন। রঞ্জাকে দেখামাত্রই ইরাবতী তাকে জড়িয়ে ধরে বলল ---আমার বউ_মণিকে কি মিষ্টি দেখতে লাগছে! খুব সুন্দর লাগছে তোমায় বউ মনি।
ততক্ষণে রঞ্জার ঘরের দরজার সামনে, খোলা জানলায় উপছে পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়। তাদের মনের কৌতহল রঞ্জা কে ইরাবতী কি বলছে তা শোনার। সর্বদা প্রাণচঞ্চল হাসিখুশি ইরাবতীএক নিঃশ্বাসে যেন কত কথা বলে দিল। বলল--- জানো বউ মনি, আমি নিজে কেন তোমার গায়ে হলুদের বাটি নিয়ে এসেছি বলতো? আমি আগে থেকে তোমার সাথে আলাপটা সেরে নিতে চাই তাই জন্য।
বলেই সে মুচকি হাসলো।
-- যদিও দেখাশোনা দিন তোমায় দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তুমি আমার বউ মনি হয়ে গেছ।
রঞ্জার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো--- জানো বউমণি , বাবা বলেছেন বউমণির কাছেই এবার আমায় লেখাপড়া করতে হবে। তাইতো ভয়ে ভয়ে তোমার সাথে আগে বন্ধুত্ব টা করে নিতে এলাম।
--- কিন্তু আমিতো সবে এবছর মাধ্যমিক পাস করলাম। আমি কি করে তোমায় পরাবো?
--- আর আমি তো এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে দেব। বাবা-মা দুজনেই বলেছেন বউমণি বাড়ি আসলেই সারাদিন শুধু আড্ডা , গল্প করেইসময় কাটালে চলবে না। বউ মনির কাছে পড়তে বসতে হবে । বউমণির মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে। ওর কাছেই তুমি পড়বে। তাই তো বলছি বউমনি তুমি যেন আমায় বকাঝকা বেশি করোনা। আমি কিন্তু পড়াশোনায় বেশ কাঁচা। আগে থেকেই বলে রাখলাম।
থাক সে সব কথা। তোমার সাথে আরো অনেক অনেক কথা আছে। এখন বলতে গেলে তোমার গায়ে হলুদের সময় বয়ে যাবে হয়তো। চলো বাইরে সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ইরাবতীর এত সুন্দর, মিষ্টি ব্যবহার দেখে রাজনারায়ণ মনে মনে শান্তি পেলেন। এই কয়দিনে তার শরীরের অবস্থা স্থিতিশীল হয়েছে। রাজনারায়ন নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন--- আমার রঞ্জা মা ওখানে একটা মনে র মতো বন্ধু পাবে। রঞ্জা ভালো থাক , আমি এতেই খুশি।
দেখতে দেখতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। বরের বাড়ি থেকে যারা এসেছিলেন তত্ত্ব দিতে তারা দুপুরের আহার সেরে রওনা দিলেন কলকাতার দিকে। কিন্তু ইরাবতী গেল না। সে থেকে গেল গ্রামের বাড়িতেই। সে পরেরদিন বৌমনিকে সঙ্গে নিয়ে তবেই ফিরবে । নান্দি মুখের আচার-অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পর রঞ্জা কে বিয়ের সাজে সাজানোর জন্য ইরাবতী ও কানন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কানন ও রঞ্জাবতী দুজনে মিলে রঞ্জাকে কনের সাজে সাজিয়ে দিল। মাথায় ওড়না খানি রঞ্জার মাথায় দিতে দিতে ইরাবতী বললো --- দেখো কানন দি, দাদা নির্ঘাত আজ শুভদৃষ্টির সময় বৌমনি কে দেখে মূর্ছা যাবে । বলেই দুজনে হো হো করে হাসতে থাকলো।
ইরাবতীর কথা শুনে রঞ্জাবতী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। যথাসময়ে গোধূলিলগ্নে বরের বেশে কিশোরিলাল উপস্থিত হলেন । সঙ্গে বরযাত্রী র দল ও।রঞ্জার আরো তিন ননদ, নন্দাই ও তখন চলে এসেছে। ইরাবতী তার দিদি জামাইবাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল রঞ্জা কে। দেখতে দেখতে চলে এলো সেই আকাঙ্খিত সময়। শুভদৃষ্টিতে ই দুজন দুজনকে চাক্ষুষ এই প্রথম দেখলো। যদিও কিশোরীলাল ছবিতে রঞ্জাবতী কে আগেও দেখেছে। কিন্ত আজ যেন তাকে আরো সুন্দরী লাগছে তার চোখে।কিশোরী লালের মনে হলো রঞ্জার কাজলকালো চোখে একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। রঞ্জাবতী ও কিশোরী লালের চোখে যেন একটা সুন্দর নিরাপত্তা ও ভরসার আশ্রয় খুঁজে পেল। প্রথম দেখাতেই তার খুব মনে ধরে গেল কিশোরীলাল কে। শুভদৃষ্টি চলাকালীন ইরার হালকা ঠেলা খেয়ে ঘোর ভাঙল কিশোরী লালের। সে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হলো তার এইরূপ ব্যবহারের জন্য । তত খনে বরপক্ষ কোনে পক্ষ উভয় পক্ষই আনন্দে ব্যস্ত। চারিদিক থেকে উলুর আওয়াজে বিয়ের মন্ডপ বেশ মেতে উঠেছে। রাজনারায়ন কন্যা দান করলেন। যথাসময়ে সিঁদুর দানও হয়ে গেল। সারা রাত ধরে বাসর ঘরে গান বাজনার আসর চলল। ইরাবতীর অনুরোধে কিশোরীলাল একটি গান করলো। ওই গানের মধ্য দিয়ে রঞ্জাবতী র প্রতি তার প্রেম ভালবাসা প্রকাশ পেলো। পরের দিন হল কন্যা বিদায়। ভোরের আলো ফোটার মাত্রই রঞ্জা বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার বাবার ঘরে টোকা দিল। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে খোলা ছিল। তাই একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।
---বাবা, তুমি বুঝি সারারাত ঘুমাওনি? ---হা রে মা , ঘুমিয়ে ছিলাম তো ।এই একটু আগে উঠলাম । তুই আজ শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তোর মা আজ বেঁচে থাকলে তোকে অনেক কিছু শিখয়ে পড়িয়ে পাঠাতেন। কিন্তু আমি যে এক হতভাগ্য বাবা। রঞ্জা-মা আমার, ওখানে গিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে চলিস। সকলকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখিস। কখনো তিরস্কার পেলে আশীর্বাদ স্বরূপ তা গ্রহণ করিস। আমার কথা ওতো ভাবতে হবে না । আমি মাঝে মাঝে গিয়ে তোকে তো দেখে আসব।
---বাবা !
আর কিছু না বলেই রঞ্জাবতী বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো ।
ওদিকে ইরাবতীর ঘুম ভেঙে দেখলো তার বৌ মনি নেই । তাই সে রঞ্জাবতী কে খুঁজতে খুঁজতে এই ঘরে চলে আসে। বাবা মেয়ের এই কান্নার মুহূর্ত দেখে সেও চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেও নীরবে চোখের জল ফেলতে থাকে।
হঠাৎই দরজার দিকে চোখ চলে যাওয়ায় রাজনারায়ন টের পায় ইরাবতীর উপস্থিতি।চোখের জল মুছে তিনি তাকে ঘরে আসতে বললেন। ইরাবতী রাজনারায়ণ কে প্রণাম করে বলল-- মেসোমশাই আমি আপনাকে কথা দিলাম বউমণিকে আমার বন্ধুর মতো আগলে রাখব। তাকে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে দেবোনা। আজ থেকে আমি হবো বৌমনির সুখ-দুঃখের দোসর। আপনি শুধু নিজের যত্ন নিবেন ।সময় মতো ওষুধ খাবেন। অনিয়ম করবেন না। আর হ্যাঁ অবশ্যই মাসে অন্তত দুই বার হলেও কলকাতায় মেয়ের বাড়ি আসবেন।আমার বউমণিকে দেখার জন্য। বাবা নিজেই গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন ।বৌমনিও মন করলেই এখানে আসতে পারবে । কেউই তাকে বাধা দেবে না। সেই প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারি । ইরাবতীর কথায় রাজনারায়ন ও রঞ্জাবতী উভয় পক্ষরই যেন বুক টা অনেকটা হালকা হলো। রাজনারায়ণ প্রাণ ভরে ইরাবতীকে আশীর্বাদ করলেন ।
---তোমার মত লক্ষহী মা যেন প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়। আমার আর কোন চিন্তা নেই। আমি আর কাঁদবো না।তুই ও আর কাঁদিস না রে রঞ্জা। তুই তো তোর আপন ঘরে যাবি। চোখের জল মোছ এবার। রঞ্জা এবার তার বাবাকে প্রনাম করে ইরাবতীর হাত ধরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
ইতিমধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে পরেছে সকলে । বিদায় বেলায় আশীর্বাদ এর সমস্ত জোগাড় করে ফেলেছে মালতি ।একে একে বয়োজ্যেষ্ঠ রা কিশোরিলাল ও রঞ্জাবতী কে ধান দূর্বা দিয়ে সন্দেশ জল খাইয়ে আশীর্বাদী সারলেন। কানন জড়িয়ে ধরে রঞ্জা কে বলল ভালো থাকিস সই, সুখে থাকিস।
রাজনারায়ণ বহুকষ্টে কাঁপা কাঁপা গলায় রঞ্জাবতীর হাত টা আর কিশোরীলালের হাতে দিয়ে বলেলেন আজ থেকে আমার রঞ্জা মায়ের সমস্ত দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি ওকে সমস্ত ঝড়-ঝাপটা থেকে আগলে রেখো ।সুখে দুঃখে পাশে থেকো।
মালতি পিসি চোখের জল মুছতে মুছতে বলল--- এবার আমার আঁচলে চাল গুলো পিছন ফিরে ছুড়ে দিয়ে বল বাপের বাড়ির ঋণ মিটিয়ে দিলাম।
রঞ্জা কাঁদতে কাঁদতে বলল আমায় ক্ষমা কোরো পিসি।ও কথা আমি বলতে পারবোনা। বাবার কি কখনো ঋণ শোধ করা যায়। আমি এগোলাম বাবা। তুমি ভালো থেকো । এই বলে রঞ্জা গাড়িতে উঠলো।
চলবে....
ছবি : সংগৃহীত
2 মন্তব্যসমূহ
D1355C4BB0
উত্তরমুছুনkiralık hacker
hacker arıyorum
kiralık hacker
hacker arıyorum
belek
A91A93B589
উত্তরমুছুনinstagram bot takipçi
Whiteout Survival Hediye Kodu
Erasmus
Türkiye Posta Kodu
swivel rocker accent chair