অষ্টমীর অঞ্জলি( চতুর্থ পর্ব)
আড়চোখে আর একবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে সোহিনী একটু সোমের মুখটা দেখে নিল । লালচে মেরুন রঙের পাঞ্জাবিতে সোমের গায়ের রংটা আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে। সকালের সূর্যের হলুদ আলো হালকা হালকা সোমের মুখের উপর পড়েছে। তাতে সোমকে আরো আকর্ষণীয় লাগছিলো। ওই পাগল করা রূপের ছটায় সোহিনী যেন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে ।এই প্রথমবার সোহিনী অঞ্জলি দিতে বসে কোনো মন্ত্রপাঠ না করে মুগ্ধ হয়ে সোমের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই বছর থেকেই অঞ্জলি সময় সহিনীর কিছু না কিছু বাধা পরছে।
ওইদিকে অঞ্জলি পর্ব শেষ হতেই কেয়াকে আবার চেপে ধরল সোহিনী। কিন্তু কেয়া তো এত তাড়াতাড়ি সব কথা সোহিনী কে বলতে ইচ্ছুক নয়। ও তো সহিনীর মনের অবস্থাটা আঁচ করতে পেরেছে। কেয়াও সহিনীকে আরো ধৈয্যহারা করে তুলতে নাছোড় বান্দা শুরু করেছে। এটা ওটা ভিত্তিহীন কথার প্রসঙ্গ তুলে। তাতে সহিনীর মন আরো অস্থির হয়ে পড়ছে। আর সহিনীর এই ব্যাপারটা কেয়া বেশ উপভোগ করছে।
--কি রে তুই তো দেখছি প্রথম দেখা তেই ওই ছেলে টার প্রেমে পরে গেছিস দেখছি। তোর চোখ , মুখ দেখে তোর মনের অবস্থা টা যে কেউ বুঝতে পারবে।
--আরে না না । সেই রকম কিছু ব্যাপার না। (বিরক্ত হয়ে )আমি অত কথা তোর থেকে শুনতে চাই না। তুই বললি ছেলে টা কে তুমি চিনিস। অঞ্জলি হয়ে গেলে বলবি আমায় ছেলে টা তোর কে হয়। তাই তোকে জিজ্ঞাসা করলাম।
এবার কেয়া তার প্রানের বন্ধু সহিনীর হাতটা ধরে নিয়ে সোমের দিকে এগিয়ে চললো। ততক্ষণে প্রসাদ বিতরণী পালা শুরু হয়ে গেছে ।
কেয়ার এইরকম কান্ড দেখে সোহিনী হকচকিয়ে গিয়ে বলল --আরে, হাতটা ছাড়। করছিস কি? আমায় ওর কাছে কেন নিয়ে যাচ্ছিস ?
-- কেন বললাম না তোকে পরিচয় করিয়ে দেব ওর সাথে।
--- এবার কিন্তু তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস কেয়া । কেয়াকে সাবধান করতে করতেই সোমের খুব কাছাকাছি চলে এলো ওরা।
-- কিরে কেয়া কিছু বলবি নাকি?
সোম কে কেয়া বলল-- না না তেমন কিছু না । এ আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। নাম সোহিনী। তোর সাথে একটু আলাপ করাতে নিয়ে এলাম।
---ও আচ্ছা !
--হাই !
কেমন আছো?নাইস টু মিট ইউ।
সোম কে এত কাছ থেকে দেখে সহিনীর সব কথা যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। কোনো মতে নিজেকে সামলে অসস্পস্ট ভাবে মাথা নিচু করে বললো-- হ্যা ভালো আছি।
-- বাই দ্য ওয়ে সোহিনী কোথায় থাকো তুমি?
সোহিনীর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ও তো এইসবের জন্য একদমই তৈরি ছিল না। হটাৎ করে কোনো স্বপ্নের রাজপুত্র যেন তার সামনে এসে তার সাথে কথা বলছে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সোহিনী বললো--
আমিও এই পাড়া তেই থাকি।
-- ও রিয়েলি। নাইস। আগে কখনো দেখিনি তোমায়। যাই হোক, আমি কেয়ার দাদা। মানে ওর জেঠুর ছেলে।
এই কথাটা সোমের মুখ থেকে শোনার পর সোহিনী মনটা আনন্দে ভরে গেল। আর অহেতুক এতটা সময় কেয়ার সাথে সোমের অন্য সম্পর্ক ভেবে যে অঞ্জলি টাও ঠিকঠাক দেয়া হলো না তা ভেবে আফসোস করতে থাকলো ।
--এবার বুঝলি তো, কেন বলছিলাম যে , ওর আমার সাথে পরিচয় আছে।
-- আচ্ছা, দাদা এবার আমরা চললাম । তুই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দে।
বাড়ি ফিরে সোহিনীর মন টা বারবার উদাস হয়ে যাচ্ছিল। ও বন্ধুদের কথা দিয়েছিল অঞ্জলি দেওয়া হয় গেলে বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে বন্ধুদের সাথে আবার বের হবে ঠাকুর দেখতে । কিন্তু ওর আর যেতে ইচ্ছে করছিল না।শুধু সোমের সাথে ওই ক্ষনিকের আলাপ টুকুর রেশটাকে আকড়ে নিয়ে একলা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছিল। যাকে বলে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়া। সহিনীর ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও সোহিনী ঠাকুর দেখতে বেরোল ওর বন্ধুদের সাথে। ওদিকে কেয়া রাস্তায় চলতে চলতে ফাক পেলেই কানে কানে ফিসফিস করে বলে চলেছে
-- কিরে আমার বৌদি হওয়ার প্ল্যানে আছিস নাকি? তাহলে বল? আমি কিন্তু ঘটকি হতে রাজি আছি। ছেলে কিন্তু মন্দ নয় ।ব্যাঙ্গালোরে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।
কেয়ার থেকে সোমের সম্পর্কে এসব কথাগুলো শুনতে তার বেশ ভালোই লাগছিল । কিন্তু পাছে কোন বন্ধুরা জানতে পেরে যায় ব্যাপারটা নিয়ে তাই সোহিনী চোখের ইশারায় কেয়াকে বারবার চুপ করতে বলছিল।
-- আরে এতে লজ্জার কি আছে? প্রেম কি খারাপ জিনিস নাকি? তবে বেশিদিন ঝুলিয়ে রাখিস না ব্যাপারটা। কারণ লক্ষ্মী পূজার পরে দাদা আবার চলে যাবে। তাহলে সেই আবার একটা বছরের অপেক্ষা। সোমের চলে যাওয়ার কথা শুনে সহিনীর বুকে কেমন একটা চাপা কষ্ট হল। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। হঠাৎই নবনীতা বললো-- তোরা বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে ঘুরতে এসে মাঝে মাঝেই গুজুরগুজুর করে কি বলছিস রে? কি ব্যাপার ? সঙ্গে সঙ্গে সোহিনী বললো আরে কিছু না। কেয়া কিছু বলতে চাইলে সোহিনী ওর মুখটা চেপে ধরে। তাইঅন্য কথা বলে কেয়া তাকে পাশ কাটিয়ে দেয়।
ঠাকুর দেখে বাড়ি ফিরে সোহিনী ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢোকে। সহিনীর আজ থেকে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো বলা যেতে পারে। সাওয়ার চালিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে হালকা গলায় গান করতে করতে স্নান করতে থাকল ও। আর বারবার সোমের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে আসায় ওয়াশরুমের আয়নায় ওর লজ্জা মাখা মুখ টা বারবার দেখতে থাকে। আর ভাবনায় ওর পাশে সোম কে কল্পনা করে নিজের মনেই নিজে হাসতে থাকলো। হটাৎ ই কি যেন মনে পড়তে তাড়াতাড়ি করে স্নান সেরে হাউসকোটটা কোনমতে গায়ে গলিয়ে নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক অন করে সোম চৌধুরী লিখে সার্চ করতে শুরু করল। ততক্ষনে অলরেডি সহিনীকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে সোম। তাই সার্চ করা মাত্রই সোমের প্রোফাইলটা সামনে চলে এলো। এতক্ষনে সহিনীর খেয়াল করলো প্রায় দুই ঘণ্টা আগে তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে সোম।এই আনন্দে সহিনীর চোখে জল চলে এলো। সে মনে মনে ভাবল আমি আজ খুব খুশি। আমার মত হ্যাপি এখন আর কেউ নেই। ও কিছু না ভেবেই রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিলো। আর সোমের প্রোফাইল ঘেটে ওর সব ফটো মন দিয়ে দেখতে থাকলো। এত সুন্দর, হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তার সাথে আজ কথা বলেছে, তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে সব কিছু যেন সহিনীর কাছে একটা স্বপ্নের মতো মনে হলো। হঠাৎই মেসেজ ঢুকলো হাই!
ইনবক্সটা চেক করে দেখল সোহিনী সোম ই তাকে মেসেজ টা করেছে। ও কি রিপ্ল্যাই দেবে ভেবে না পেয়ে কেয়া কে ফোন করলো।
সব শুনে কেয়া বললো --
ওহ! তলে তলে তাহলে এতদূর জল গড়িয়েছে?
-- আরে ধুর...তেমন কিছু নয়। তোর দাদা আমায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। একসেপ্ট করলাম । তাই এখন ও একটা মেসেজ করেছে। কি রিপ্ল্যাই দেব ভেবে পেলাম না। সেই জন্য তোকে ফোন করলাম।
--ও আচ্ছা! যখন রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলি তখন তো আমায় জিজ্ঞাসা করে একসেপ্ট করিস নি। এখন বলছিস কি রিপ্লাই দেবো। তোদের মধ্যে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না রে । নিজেরা কথা বল। চালিয়ে যা। আমি এখন ফোন রাখলাম । সন্ধ্যেবেলায় আটটার সময় মণ্ডপে চলে আসিস আড্ডা দেবো। এখন বাই।
ফোনটা কেটে দিলো কেয়া। সহিনীর রিপ্লাই না পেয়ে সোম আবার মেসেজ করল --" সন্ধ্যেবেলায় মণ্ডপে থাকবো। আসবে তুমি? " তারও কোন ও উত্তর দিল না সোহিনী। জাস্ট সিন করে রেখে দিল।ও কল্পনাতেও এই আশা করে নি , যে ছেলেটাকে দেখে মনে এত দোলা লেগেছিল সকাল বেলা সে মাত্র কয়েকটা ঘন্টার মধ্যেই তার জীবনে ধরা দেবে।
সোহিনী এখন খুব ব্যস্ত সাজগোজে। সন্ধ্যেবেলা একটা নীল রঙের বালুচরি শাড়ি পরে, সুন্দর করে সেজে আয়নার সামনে বারবার নিজেকে দেখেতে থাকলো। যাতে কোথাও কোন মেকাপের খুঁত না থাকে।ও এই প্রথম চোখে আইলাশেস পড়েছে। তাই চোখটা আরো বড় লাগছে। স্মোকি আই লুকও করেছে। এটা শিখেছিল ও ইউটিউব দেখে। হাইলাইটার দিয়ে গাল টাকে আরো ব্রাইট করলো। মোটের ওপর মর্ডান সাজে নিজেকে সজ্জিত করে, লম্বা ঢেউ খেলানো চুলকে স্ট্রেটনারের সাহায্যে স্টেট করে খোলা চুলে নিজের রূপ টাকে আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে নিয়েছে। এরপর কেয়ার সাথে কোনরকম কন্ট্যাক্ট না করেই সোজা পূজামণ্ডপে পৌঁছে গেল। মণ্ডপে ঢুকেই ও দেখলো কেয়া আর সোম এক সঙ্গে বসে আছে। কেয়া তাকে দেখা মাত্রই হাতে ইশারা করে ওদের কাছে ডাকল। কিন্তু পাশে সোম থাকায় সোহিনীর বেশ লজ্জা লাগছিল । তাইও যেতে ইতস্তত বোধ করছিল। কিন্তু কেয়া এতক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সহিনীকে এক প্রকার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে তাদের কাছে বসালো।
-- তোমায় ফেসবুকে মেসেজ করেছিলাম তার কোন রিপ্লাই করলে না তো সোহিনী? সোমের কথা শুনে সহিনীর হার্টবিট বাড়তে লাগলো। কিছু না বলে ও কেয়ার দিকে তাকিয়ে মুখটা নিচু করে নিল। কেয়া মুচকি হেসে বলল -- আচ্ছা তোরা কথা বল ।আমি একটু আসছি।কেয়া উঠতে গেলে সোহিনী ওকে বাঁধা দিয়ে উঠে যেতে বারণ করলো।
-- আসলে আমি তো কেয়া কে বলেছিলাম সন্ধে বেলায় আসবো। তাই তোমায় আর রিপ্লাই করি নি।
-- কিন্তু কেয়া আর আমি কি এক হলাম? ওকে বললে আমি জানবো কি করে? বাই দ্যা ওয়ে নীল শাড়িতে তোমায় কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে সোহিনী।
চলবে---
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ