ওরা একসঙ্গে বসে ক্যারাম খেলছিল। অবশ্য ক্যারাম খেলার জন্য চারজন ছেলেই যথেষ্ট । কিন্তু এখানে তার প্রায় চার ডবল ছেলে উপস্থিত হয়ে ক্যারাম বোর্ড এর উপর হুমরি খেয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি ও খেলাতে মত্ত। ছেলেগুলো এতটাই নিজেদের মধ্যে ইয়ার্কি ,ঠাট্টা,একে অপরকে ঠেলাঠেলিতে ব্যস্ত ছিল যে তাদের কীর্তিকলাপ দেখে সহিনীর মনে মনে রাগ হচ্ছিল। আর কেয়াকে নিজের মনে গাল ও দিচ্ছিল। ছেলেগুলো সহিনীর থেকে অনেকটাই সিনিয়র।
কেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সোহিনী প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। একাকী প্যান্ডেলের মধ্যে থাকতে ভাল লাগছিল না । তার ওপর ও আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। তাই একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। সোহিনী চেয়ারে বসা অবস্থাতেই মুখটা নিচু করে শাড়ির কুচি ঠিক করে নিয়ে ভালোভাবে বসতেই দেখতে পেল সোমের মুখটা। সম্পূর্ণ না দেখতে পেলেও সাইড থেকে একঝলক সোমের মুখটা দেখেই সহিনীর চোখ দুটো ওখানে আটকে গেল। সহিনীর আগে কখনো কোন ছেলেকে দেখে এরকম হয় নি। কলেজে তো তার অনেক ছেলে বন্ধু আছে। কাউকে প্রথম দেখাতেই ওর মনের এই রকম অনুভূতি জাগে নি। সহিনীর হৃদয়ের দোলাচল তখন আরো বেড়ে গেল। আরেকবার ভালো করে দেখার জন্য তার মন অস্থির হয়ে পড়লো। কিন্তু ততক্ষণে সোমের মুখটা সম্পূর্ণটাই আড়াল হয়ে গেছে বন্ধুদের ভিড়ে।
ইতিমধ্যে রায় কাকিমা এসে সহিনীর পাশে চেয়ার নিয়ে বসলেন । তাই সহিনীর ইচ্ছে থাকলেও মন কে কোন প্রকার এ দমিয়ে রাখলো।
--- ও মা!! এ যে সোহিনী !! সূর্য কোনদিকে উঠেছে আজ... সহিনীকে কে তো মা, বাবা ছাড়া কখনো বের হতে আগে দেখি নি। বাহ! দারুন লাগছে তো তোকে? লাল জামদানি টা পরে। এবারে তাহলে একা একাই ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিস? তা খুব ভালো করছিস। বড় হয়েছিস। এবার তো একা একা একটু বের হতেই হবে। কি সুন্দর লাগছে তোকে। ঠিক যেন লক্ষ্মী প্রতিমা । রায় কাকীমার কথায় সোহিনী একটু লজ্জা পেয়ে বলল-- আপনি কেমন আছেন কাকিমা?
-- পূজার সময় সবাই তো ভালই থাকে। আমি একটু বেশিই ভালো আছি বুঝলি? কারণ এই ছুটিতেই তো রিতম বাড়ি আসে তাই। রিতম রায় কাকিমার একমাত্র ছেলে। বাইরে থাকে। সেখানেই চাকরি করে।
--- ওই দেখ , কেয়া এসে গেছে। রায় কাকিমার কথায় সোহিনী রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল কেয়া আসছে পিঠ অবধি লম্বা খোলা চুল উড়িয়ে। কেয়া কে দেখেও রায় কাকিমা বললো--- কেয়া খুব ভালো সেজেছিস। কেয়া একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হেসে বললো -- ভালো আছো তো কাকিমা? রায় কাকিমা কেয়ার গাল টা হালকা করে টিপে বললো হ্যাঁ ভালো তো থাকবই। পাশে চেয়ার নিয়ে বোস। তোর জন্য সোহিনী কখন ধরে ওয়েট করছে দেখ। কেয়া কে আগে কখনো কারো কথায় ওতো লজ্জা পেয়ে শান্ত হয়ে কথা বলতে দেখে নি সোহিনী। রায় কাকিমার সাথে কেয়ার কথোপকথন টা বেশ অন্য রকম লাগলো সহিনীর।
--- ওয়াও তোকে কি লাগছে রে সোহিনী, তোর মতো স্লিম ফিগার টা যদি আমার হতো খুব ভালো হতো । কিন্তু আমার ব্যাডলাক। বাইরে ফাস্টফুড, কোলড্রিংস এটা সেটা খেয়ে খেয়ে দিন দিন আরও মোটা ধামসি হয়ে যাচ্ছি দেখ না। কেয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই সোহিনী বলে উঠলো-- তোকে এই চেহারাতেই বেশ স্মার্ট লাগে। যাইহোক এত দেরি কেন করলি তুই? তোর জন্য কুড়ি মিনিট ধরে অপেক্ষা করে আছি । আর তুই দশ মিনিট বলে এখন তোর আসার সময় হলো? আর একটু পরে আসলে হয়তো অঞ্জলি দেওয়াও সবাই এর শেষ হয়ে যেত। কেয়া বললো-- বেশ তো হতো তাহলে। ঐ হ্যান্ডসাম দাদা গুলোর সাথে একসাথে বসে অঞ্জলি দিতিস। আর তোর সাদা ধবধবে ফর্সা পিঠে সবাই ছুড়ে ছুড়ে ফুল দিত।
-- যা !! তুই না! ভারী অসভ্য।
ওরা দুজনে যখন কথা বলায় মত্ত ঠিক তখনই মাইকে ঘোষণা করল ক্লাব কর্তৃপক্ষ-- " আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের অঞ্জলি শুরু হবে। যারা যারা মায়ের অঞ্জলি দিতে ইচ্ছুক, তারা শীঘ্রই পুজো মণ্ডপে এসে হাজির হন। " মাইকের এনাউন্স শোনা মাত্রই জনকয়েক ছেলে ধরাধরি করে ক্যারাম বোর্ড টা কে ক্লাব ঘরে রেখে এলো। আর কিছু ছেলে চেয়ারগুলো সরিয়ে এক সাইডে রাখতে শুরু করলো। ঠিক তখনই সোহিনী খুব ভালো করে সোম কে দেখার সুযোগ পেল । বাঙালি হলেও সোমের গায়ের রং পাঞ্জাবি দের মত দুধ সাদা। উচ্চতা ছ ফুট । মুখে হালকা দাড়ি গোঁফ সুন্দর ভাবে সেফ করা, রীতিমতো জিম করা সুদর্শন চেহারা । এই রকম ছেলে কে দেখে অষ্টাদশী যে কোনো কিশোরীরই মনে দোলা দিতে বাধ্য। সহিনীও তাই নিজেকে স্থির রাখতে পারে নি। হা করে তার দিকেই তাকিয়ে থাকল। "চোখে চোখে কথা বল" কেস টা যখন জাস্ট শুরু হয়েছে কেবল সহিনীর দিক থেকেই তখনই কেয়া কনুই দিয়ে হালকা করে ঠেলে সহিনীকে বললো--- " আরে কেস টা কি বল তো? ওই দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কি দেখছিস? পাশে রায় কাকিমা আছে সে খেয়াল আছে কি? কেয়ার কথায় সোহিনী চমকে উঠে আমতা আমতা করে বলে
-- কই আমি কিছু দেখিনি তো।
-- হ্যাঁ, আমার তো চোখে ন্যাবা হয়েছে তাই না? আমি তো অন্ধ? এটাই বলতে চাইছিস তুই । অনেক্ষন দেখেছিস। এখন চল অঞ্জলি দিয়ে নিই । তারপর ওর সাথে তোকে আলাপ করিয়ে দেবো।
--- ওর সাথে মানে? কর সাথে আলাপ করানোর কথা বলছিস তুই?
--- ওই আমি ন্যাকা নই ঠিক আছে। তুই কাকে দেখছিলিস সেটা আমি জানি। বললাম তো মন্ত্রপাঠ শেষে তোকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।
-- আমার বয়েই গেছে অচেনা কারো সাথে আলাপ করতে। চল অঞ্জলি দিতে বসি। ভিড় হয়ে যাচ্ছে।
-- হ্যাঁ চল। তবে সোহিনী তুই যাকে দেখছিস ও কিন্তু একদমই অপরিচিত নয়। ওর সাথে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে । অঞ্জলি দেওয়া হয়ে গেলে তোকে ওর কথা বলবো। এই বলে সহিনীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কেয়া ঠাকুরের ফুল নিয়ে জোড়হাত করে চোখ বুঝল।
পূজার ফুল হাতে নিয়ে ও সোহিনী কিছুতেই মন্ত্রপাঠে মনোযোগী হতে পারল না । হাত জোর করে চোখ বুজে থাকলেও সহিনীর মন পড়ে থাকলো কেয়ার ওই কথাটায়--- ছেলেটা নাকি কেয়ার পরিচিত। সোহিনী মনে মনে ভাবতে থাকল তাহলে কি কেয়া এতদিন তার জীবনের এত বড় কথাটা লুকিয়ে গেছে তার থেকে? নিজের মন কে সে আবার বোঝালো না না তা কি করে সম্ভব । কেয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার জীবনে নতুন কেউ আসলে সে নিশ্চয়ই তাকে বলতো। তাহলে ছেলেটা যে ওর পরিচিত এটা কেনো বললো কেয়া। উফ !! কেয়া টা এত সাসপেন্স এর মধ্যে রাখে আর ভালো লাগে না। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঠাকুর মশাই এর প্রথম পর্বের মন্ত্র বলা হয়ে গেল। সবাই মায়ের চরণে ফুল নিবেদনের জন্য ব্যস্ত । সহিনীও তাদের দেখাদেখি ফুল দিলো। সোহিনী যেহেতু একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল তাই ফুল দিতে ওর একটু দেরি হলো। তা দেখে কেয়া ফিক করে হেসে উঠলো। এবার আবার সবাই দ্বিতীয় দফার মন্ত্র বলার জন্য ফুল নিতে ব্যস্ত। এই ফাঁকে কেয়ার কানের কাছে সোহিনী ফিসফিস করে বললো-- " কিরে ডুবে ডুবে তাহলে এতদিন জল খাচিল্লিশ তাইতো? আমায় তো বলিস নি। " কেয়া আবার মুচকি হেসে বললো--- " কেমন হ্যান্ডসাম বলতো? যে কেউ দেখলেই পছন্দ হয়ে যাবে তাই না ? এখন মন্ত্র বল । বেশি কথা বললে আশেপাশের লোক ক্ষেপে যাবে। পরে বলছি ও আমার কে হয়?
কেয়ার কথায় সোহিনীর সদ্য রঙিন হৃদয়টা কাচের মতো ভেঙে চুরে যেতে থাকলো। ওর যেন কোনো কিছুতেই মন নেই। ছেলে টা কেয়ার কে হয় ও সেটা একটু পরেই বলবে সহিনীকে। সোহিনী যেন এইটুকু অপেক্ষা আর সহ্য করতে পারছে না।
চলবে-----( গল্পটি ভালো লাগলে বন্ধুরা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। এবং সকলের সাথে শেয়ার করবেন।)
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ