আভিজাত্যের আশকারা
দেখাশোনা করে সম্ভ্রান্ত উচ্চ শিক্ষিত পরিবারেই বিয়ে হয়েছিল চন্দনার। স্বামী ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেশ আভিজাত্য সম্পন্ন বড়লোক বাড়িতেই তার বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরমশাই গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী কে সকলে এক নামে চিনতেন। পরিবারে চন্দনার শ্বশুর, শ্বাশুড়ী ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন তুতো শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ছিলেন। সব মিলিয়ে বেশ একান্নবর্তী পরিবার। মাত্র আঠার বৎসর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ই চন্দনার বিয়ে হয়ে যায় তরুনের সাথে।
শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই পরিবারের সদস্যদের হাবভাব চালচলন দেখেই সে বুঝতে পেরে যায় এনারা প্রত্যেকেই কম বেশি রাশভারী লোক। সকলেই যেন একে অপরের সাথে মেপে মেপে কথাবার্তা বলে। একান্নবর্তী পরিবারে লোকজনের অভাব না থাকলেও প্রাণখোলা হাসি খুশির শূন্যতা পুরো বাড়িটাকে প্রায় নিস্তব্ধ করে রাখে। এই বাড়িতে খাওয়া , পড়া , নিত্য নৈমিত্তিক কাজ বড্ড বেশি যেন শৃঙ্খলার দ্বারা আবদ্ধ।
প্রথম প্রথম স্বামী তরুনকেও চন্দনা বেশ ভয় পেত। একেই দেখাশোনা করে বিয়ে তার ওপর তিনি আবার চন্দনার থেকে প্রায় বছর দশেকের বড়ো। এই বাড়িতে সবাই কম কথা বললেও চন্দনা এ বাড়িতে পা রাখা মাত্রই তার মনের মতো বন্ধু অবশ্য একজনকে সে পেয়ে গিয়েছিল। তিনি হলেন চন্দনার শ্বাশুড়ি মা সীমা দেবী।
বিয়ের কিছুদিন পরেই একদিন সন্ধে বেলা চন্দনা ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়েছিল। ঘরে আলো নেভানো দেখে সীমা দেবী ভেজানো দরজা আসতে করে খুলতেই ধড়মড় করে চন্দনা উঠে বসলো। পড়ি মরি করে সীমা দেবী ছুটে এসে বলেন " ও কি বৌমা ভর সন্ধ্যে বেলা দরজা ভিজিয়ে শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ নাকি? " " না মা, আসলে এইসময় তো তেমন কিছু কাজ থাকে না তাই একটু আর কি.. " সঙ্গে সঙ্গে মুখের কথা থামিয়ে সীমা দেবী বলেন --" আর কখনো এইরকম কাজ করবে না বৌমা, তোমার শ্বশুর মশাই, জেঠু শ্বশুর রা জানতে পারলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।ভর সন্ধে বেলা কি কেউ দোর দিয়ে শুয়ে থাকে ? তুমি বরঞ্চ এক কাজ করো-- আসন বোনো, সোয়েটার বুনতে পারো। " এই বলে সীমা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছিলেন প্রায় ছুটে গিয়ে চন্দনা বললো-- " বলছি মা, একটা কথা বলবো আপনাকে? " " ও মা এতে ইতস্তত হওয়ার কি আছে , বলো?" " বলছি আমার কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছে। ভালো সন্বন্ধ আসায় বাবা আমি তড়িঘড়ি বিয়ে টা দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই আর হয়ে ওঠে নি। যদি এখন থেকে.. ..." ---" খবরদার বৌমা আমায় যা বলেছ ঠিক আছে। এসব কথা বাড়ির কাউ কে বলো না। এমনকি তরুণ কেও নয়। তুমি এখন ও এই বাড়ি সম্পর্কে কিছু জানো না। আসতে আসতে সব জানতে পারবে। এ বাড়ির নিয়ম কানুন বড়ই অদ্ভুত বৌমা। এখানে পুরুষদের কথাই শেষ কথা। বাড়ির বউ বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করবে , এটা তোমার শিক্ষিত শ্বশুর মশাই মেনে নেবে না। বড়ই অদ্ভুত যাঁতাকলে আমরা আবদ্ধ হয়ে গেছি বুঝলে? আমার যখন বিবাহ হয় তখন বিয়েতে অনেক উপহার স্বরূপ অনেক শরৎ রচনাবলী, রবীন্দ্র রচনাবলী পেয়েছিলাম। খুব ভালোবাসতাম পড়তে। তা একদিন উনুনে তরকারি বসিয়ে শ্রীকান্তের শেষ টুকু পাতা বাকি ছিল সেটাই পড়তে এতটাই বিভোর ছিলাম যে তরকারি পুড়ে গিয়েছিল। সেইদিন তোমার শ্বশুর মশাই গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে দ্বিধা বোধ করে নি। তাই বলছি বৌমা ওইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। সংসারে মনোযোগ দাও। " এইভাবেই কঠোর নিয়মাবলীর মধ্যে দিয়ে সীমার দিন অতিবাহিত হতে লাগলো। মাঝে মাঝে বাপের বাড়ির জন্য মন কেমন করলেও ইচ্ছে করলেই সে যেতে পারতো না। শ্বশুর মশাই যতদিন না অনুমতি দিচ্ছেন ততদিন অপেক্ষা করে থাকতে হতো তাকে। তবে একদম ই যে যেতে দিতেন না নয়। যাওয়ার দিনই ফিরে আসার দিনক্ষণ বলে দিতেন । এইভাবেই এগিয়ে চললো চন্দনার জীবন।
বিয়ের বছর দেড়েক পর ই কোল আলো করে জন্মালো সূর্য।চন্দনা ও তরুণের ছেলে। সূর্যের যখন বছর তিনেক বয়স বাড়ি থেকে ঠিক হলো তাকে একটি নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানো হবে। এতে আবার চন্দনার ছিল ঘর আপত্তি। সেই প্রথম সে শশুর মশাইয়ের মুখোমুখি হয়ে বলেছিল, " বাবা আমি সূর্যকে বাংলা মাধ্যম স্কুলেই ভর্তি করাতে চাই। বাংলা ভাষা কে আয়ত্ত করেও তো অনেকে বিশ্বজোড়া নাম করেছে বাবা।" -- " বৌমা সামান্য স্কুলের গন্ডি পাশ করে কি নিজেকে বিদ্বান মনে করেছ" ।--- " এ মা ছি ছি, বাবা আপনি আমায় বুঝতে ভুল করছেন।আমি আসলে আমার সূর্যকে আমার মতো করে মানুষ করতে চাই। " সেইদিন তরুণ অফিস থেকে ফিরে চন্দনাকে কি মারটাই না মেরেছিলো। শেষ পর্যন্ত সূর্যকে নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই ভর্তি করানো হয়েছিল।
দাদু, বাবা, জেঠু দাদু দের অতিরিক্ত বড়োলোক ই অস্কারাতে সূর্য ছোট থেকেই বেপরোয়া, বদমেজাজি হয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে সূর্যের এইরকম অবনতি দেখেও চন্দনাকে চুপ থাকতে হতো। চন্দনা লক্ষ করতো সূর্যের মধ্যে বড়লোক ই চাল এতটাই প্রখর যে সে গরিব দের মানুষ বলে মনে করতো না। স্কুল যাওয়া আসার পথে ভিখিরি দের সে মুখের উপর টাকা ছুড়ে দিত।তার এইরকম আচরণের জন্য করা দায়ী তা চন্দনা ভালো ভাবেই বুঝত । বাড়ি ফিরে এসে সূর্যকে শাসন করলেও উল্টে চন্দনাকে অপমান করা হতো, বলা হতো--মিডিল ক্লাস ঘরের মেয়ে আভিজাত্য সম্পর্কে তার নাকি ছিটে ফোটাও জ্ঞান নেই।
সূর্য যে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলো সে বছরই তার দাদু মারা যান। সূর্য প্রায় তখন থেকেই আরো অভদ্র ছেলেতে পরিণত হয়। লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট সবই খেতে শুরু করলো। তবে কানাঘুষায় সে কথা তরুণ বাবুর কানে আসায় তাকে শাসন করলে তেমন কোনো লাভ হতো না। যা হোক করে উচ্চ মাধ্যমিক কের গন্ডি টা পেরিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় সে। এইসময় থেকেই সে পুরোপুরি বিগড়ে যায়। বাবা ও দাদুর জমানো টাকায় মদ, বিড়ি , সিগারেট খেয়ে ও বন্ধু দের সাথে আড্ডায় মত্ত থাকে।
সূর্যকে ঘিরে চন্দনার যে সব স্বপ্ন ছিল তা তিল তিল করে শেষ হয়ে যায়। শুধু মাত্র আভিজাত্য আর বড়োলোকের দোহাই দিয়ে উচ্শৃঙ্খল জীবনধারায় অভ্যস্ত করার জন্য।চন্দনা ইচ্ছে থাকলেও যে সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে নি তার সব অসম্পূর্ণ স্বপ্ননগুলো তার ছেলের মধ্য দিয়ে সে পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
সূর্য কে আজ থানা থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে, একজন তরুণী মেয়ে কে ভালোবাসার জালে জড়িয়ে তাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কোথায় গেল আজ আভিজাত্য বাড়ির সন্মান, বড়োলোক বাড়ির মান? মাঝখান দিয়ে চন্দনার মতো সাধারণ মেয়ের জীবনের একমাত্র অবলম্বন সূর্যের জীবন এখন ঘোর অনিশ্চিয়তার মধ্যে। আর কি শুধরানোর কোনো রাস্তা আছে সূর্যের? হয়তো বা আছে তরুণী মেয়েকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে ঘরে তোলার মাধ্যমে। সেইরকমই কিছু শোনার অপেক্ষায় কোর্ট চত্বর আর চন্দনার হৃদয়।
ছবি : সংগৃহীত
1 মন্তব্যসমূহ
C25233EB7E
উত্তরমুছুনeski mmorpg oyunlar
sms onay sitesi
mobil ödeme bozdurma
güvenilir takipçi satın alma
havale ile takipçi