পরম ভালোবাসা


পরম ভালোবাসা Absolute love

পরম ভালোবাসা

 মনিমালা এখন পঞ্চাশ বছরের মধ্য বয়স্ক মহিলা । জীবনের প্রায় পঁচিশ টা বছর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে  এসেছে সে।এখন সে একটি হাই স্কুলের শিক্ষিকা। 

মনি মালার মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে বিয়ে হলেও স্বামীর ঘর বেশি দিন করতে পারেনি সে।  বিয়ের পরপরই নেশাখোর মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শ্বশুর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল একসময়ে। আর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ডিভোর্স ও হয়ে যায় । তাতে অবশ্য মনিমালার শ্বশুর শাশুড়ির কোন আপত্তি ছিল না । কৌশিক মানে মনিমালার স্বামী অল্প বয়স থেকেই বেপরোয়া আর মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। পরিবারের সদস্যদের অনুমান ছিল বিয়ের পর হয়তো এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে,  কিন্তু যখন তারা দেখল এতে হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটতে চলেছে , একটা নিরাপরাধ মেয়েকে মদ্যপ অবস্থায় এসে কৌশিক প্রতিরাতে গালাগাল , নির্যাতন করছে তারাও তখন মনিমালা কে আর সংসারের বাঁধনে বেঁধে রাখতে সাহস পায়নি। 

 অতঃপর মনিমালা কে ফিরে আসতে হয়েছিল আবার বাপের বাড়িতে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় এ বাড়িতে তাকে কোনো কটু কথা অবশ্য শুনতে হয়নি।  কিন্তু এই ঘটনার পর মনি মালার বাবার শরীরের অবস্থা  ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে । একমাত্র মেয়ের জীবনের এই রকম অবস্থা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, উপরন্তু যেহেতু তিনি এই দেখাশোনা টা করে ছিলেন তাই নিজেই নিজেকে অপরাধী মনে করতেন। কিন্তু মনিমালা কখনোই নরম প্রকৃতির মেয়ে ছিল না । তার সাথে যা ঘটেছে সে সব অতীত দিনের কষ্টের স্মৃতিগুলো নিয়ে সে কখনো মাথা ঘামাইনি। উল্টে বাবাকে শক্ত হতে বলতেন,  মন থেকে সব বাজে দিনগুলো  ঝেড়ে ফেলে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতেন । কিন্তু কিছুদিন পরই তার বাবা ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে ।এইসময়  পিতৃহারা মনিমালা তখন মাকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের পথ আরো কঠিন হয়ে পড়ল। সংসারের সমস্ত হাল এসে পরল মনিমালার ওপর। 


ইতিমধ্যে মনিমালা কপাল জোরে হাইস্কুলে শিক্ষকতা চাকরিটা পেয়ে গেল ।ফলে মা, মেয়ের দিব্বি ভালোভাবে কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সকাল হতেই রান্নাবান্না ঘরের কিছু কাজ সেরে মনিমালা স্কুলে চলে যেত।  বাড়ি ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে যেত। এই এতটা সময় মনিমালার মা অর্থাৎ মামনি দেবীকে একা একাই কাটাতে হতো। সুতরাং মায়ের  একাকিত্বের অভাব মেটাতে এবং নিজের মাতৃত্বের স্বাদ পেতে মনিমালা ঠিক করল একটি সন্তান দত্তক নেবে।

 এই চিন্তাকে পূর্ণতা দিতেই অনাথ আশ্রম থেকে মনিমালা সুহানাকে  দত্তক নিয়েছিলেন । তখন সবেমাত্র সুহানার বয়স তিন বছর । মামনি দেবী  ও  মনি মালার পরম লালিত্য ও মমতায় মানুষ হয়েছে সুহানা । পড়াশোনা ছাড়া সাবলীল হওয়ার জন্য ক্যারাটে ও সাংস্কৃতিক ধারার সঞ্চালন ঘটানোর জন্য নৃত্য,  অঙ্কন এই সমস্ত বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন মনিমালা সুহানা কে। তাকে নিয়ে মনিমালার যা যা স্বপ্ন বুনে ছিল তা সম্পূর্ণ সফল হয়েছে ।

বরাবরই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত সুহানা পিএইচডি সম্পন্ন করার পরেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়। সেখানেই আলাপ হয় অধ্যাপক প্রিতমের সাথে। প্রথমদিকে সম্পর্ক বন্ধুত্বের মাধ্যমে ও পেশাগত কারণে একে অপরের সাথে শিক্ষনীয় আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সুহানা  হঠাৎই অন্য কলেজে ট্রান্সফার হয়ে যায় ঠিক এই সময় থেকেই দুজন দুজনের অনুপস্থিতিটা গভীরভাবে অনুভব করে।  শুরু হয় সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে ফোন ম্যাসেজ। ধীরে ধীরে তাদের এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রণয়ে রূপান্তরিত হয় ।

সুহানা  তার মা অর্থাৎ মনিমালাকে তাদের প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের কথা জানালেও ভয়ে বলতে পারেনি প্রীতম কে তার জীবনের অতীতের ঘটনা গুলো। সম্পর্কের কথা জানতে পারার পর মনিমালা দেবী প্রীতম কে ফোন করে তাকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ করে। প্রথম দেখাতেই মনিমালা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে , ছেলে সত্যিই খাঁটি ।শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষাই যে তারমধ্যে বর্তমান ।শুধু তাই নয় ভদ্র সমাজের সৎ শিক্ষিত মানুষ বলতে যা বোঝায় তার সকল গুণই প্রিতমের মার্জিত ব্যবহারে  প্রস্ফুটিত।


 যাইহোক দুপুরের  আহারের পরেই মনিমালা দেবী প্রীতম কে সুহানার
অতীত সম্পর্কে কথা গুলো সেরে ফেলতে চায়। সুহানা বারবার তাকে অনুরোধ করে তা না বলার জন্য। আসলে এটা সে লুকাতে  চেয়েছিল তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। কিন্তু মনিমালা দেবী তাকে আশ্বস্ত করে বলে ভয় পাস না আমি তো আছি। আমি যে মা আমি তোকে গর্ভে ধরিনি ঠিকই কিন্তু আমি যেমন তোর মনের ভিতরটা পড়তে পারি তেমনি প্রীতমও তো আমার পুত্র সম সে  কতটা মনুষ্যত্ববোধের পূর্ণ তা বুঝতে পেরেছি।

চার হাত এক হওয়ার আগেই শুধু অতীতের কথা গুলো বুঝিয়ে বলে দিতে দে।  শেষ পর্যন্ত মনিমালার কথায় সুহানা  রাজি হয়ে যায় । অতঃপর মনিমালা দেবী প্রীতম কে সুহানার অতীত কাহিনী সম্পর্কে বললে প্রীতম প্রথমটা চুপ হয়ে যায়। তারপর মনিমালা দেবী কে অনুরোধ করে একান্ত সুহানার  সাথে কিছু কথা বলতে চায়। সুতরাং মনিমালা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই সুহানা ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে আস্তে আস্তে প্রবেশ করে করে। প্রীতম বলতে শুরু করে তোমার অতীত জীবনের কথা আমায় আগে জানানো উচিত ছিল সুহানা। প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা এসবের ঊর্ধ্বে একটা শব্দ আছে তাহলো প্রাণ। আর আমরা প্রাণে মানুষ ।আর ভালোবাসা মায়া মমতা এইগুলো সমন্বয়ে সেই শব্দটা পরিপূর্ণতা পায় যা হলো মানুষ। তুমি কি করে ভাবলে আমি একটা মানুষ হয়ে তোমার পরিচয় জেনে তোমায় ছেড়ে চলে যাব? অতীত কাহিনীটা তুমি আগেই আমায় বলতে পারতে তাতে আমার কিংবা আমার পরিবারের দিক থেকে কোন অসুবিধা হতো না। প্রীতমের কথায় সুহানার চোখে জল ভরে আসে। প্রীতম চোখের জল মুছে দিয়ে পরম যত্নে তাকে বুকে টেনে নেয়। দরজার বাইরে থেকে মনিমালা চশমাটা খুলে চোখের জল আঁচলে মুছে নিয়ে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ