ভয়াবহ পরিণাম
সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে কোয়ার্টার এ ফিরতে চন্দ্রিমার প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। তালা খুলেই প্রথমেই সে , ঘরের আলোটা জ্বালে।চারদিকের দরজা, জানলা বন্ধ রেখে ডিউটিতে বেরোয় সে। তাই ঘরটা গুমোট গরম হয়েছিল এতক্ষন। সেগুলো আবার খুলে দেয়ার পরই ঘরটা আবার তার সজীবতা ফিরে পেল। ভরপুর অক্সিজেন এর সমারোহ হতে থাকলো। রুমটায় হালকা রুম ফ্রেশনার দিয়ে আরো মোহময় করে দিলো চন্দ্রিমা। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হোতে। আর একটু পরেই গীতা দি চলে আসবে। চন্দ্রিমা পুলিশের এস.আই পদে কর্মরত। বাড়ি কদমপুরে। বিকাশঘাটা থানায় পোস্টিং হওয়ায় সে এই থানার কোয়ার্টার এ থাকে। গীতা দি হলেন চন্দ্রিমার অবসরের সঙ্গী, রান্না করা, ঘর গুছানো, এবং চন্দ্রিমাকে দেখাশোনা করা তার কাজ।
ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর আগেই কলিং বেলটা ব্রজে উঠলো। যথারীতি চন্দ্রিমা তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা টা খুলে দেয়। গীতা দি ঢুকল। আজ চন্দ্রিমা বেজায় খুশি। সে প্রথমে ই গীতা দি কে বলে-' কড়া করে দু কাপ চা নিয়ে এস গীতা দি। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। চা খেতে খেতে দুজনে আড্ডা দেব।' গীতা দি ও হাসি মুখে , খানিকটা কৌতূহল নিয়েই চা করতে চলে গেল। মিনিট দশেক পর চা, মুড়ি ,পাঁপড় নিয়ে হাজির হলো গীতা দি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চন্দ্রিমা বললো-' তোমাদের পাড়ায় নবারুণ পালের বৌমা রিনা নামে ওই যে কম বয়সী বউ টা কে ওর স্বামী, ভাসুর, জা মিলে যে মারধর করতো বউটা কয়েকদিন আগে কাঁদতে কাঁদতে এসে ডায়রি করে গেল। ওর ফ্যামিলি কে উচিত শাস্তি দিয়েছি আজ। ভেবেছিল ওরা পয়সার জোরে বেঁচে যাবে। কিন্তু আমিও ওদের কেসটা কোর্টে চালান করে দিয়েছি। আর এমন ই ব্যবস্থা করে রেখেছি যে ডিভোর্স হলেও বউটা যেন তার উপযুক্ত খোরপোষ পেয়ে যায়।
থানা থেকে ডাক পরার আগেই অবশ্য নবারুণের বড়ো ছেলে, জা আর ওই রিনার স্বামী নিজেদের ভুল স্বীকার করে রিনাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসে। ওরা থানায় এসে কবুল করে ওদের অন্যায়। এবং থানায় লিখিত জানান দেয় তারা ভবিষ্যতে আর কখনো রিনার উপর মানসিক, শারীরিক অত্যাচার করবে না। গীতা দি- জানো! তবু রিনা ওদের সাথে যেতে চাইছিল না। আসলে শয়তান গুলো ওর সাথে যা ব্যবহার করেছে শরীরের লাল দগদগে ঘা গুলোই জানান দেয় তা কতটা মর্মান্তিক। তবুও বুঝিয়ে সুজিয়ে আমরা ওদের সাথে ওকে পাঠাই। শয়তান গুলো যা টাকা পিশাচ, বাড়ি ফিরে অত্যাচার করলেই তো এবার ডিভোর্স কেস ফাইল হবে, রিনাকে খোরপোষ দিতে হবে - তাই এই পথে আশা করি আর হাটবে না । ' সব শুনে গীতা দি বলে- ,' সবই তো শুনলাম গো, কিন্তু মানুষ জাত টাই তো গিরগিটির মতো। রং পাল্টায় ক্ষণে ক্ষণে। যাই হোক ভালো হলেই ভালো। বৌটাও তার সংসারের থাকতে পারবে। বাপের বাড়ি থেকে দিনের পর দিন সমাজের গঞ্জনা থেকে রেহাই পাবে। ' চন্দ্রিমা আরো বলে -" জানো, রিনা একদমই ওদের সাথে যেতে নারাজ ছিল। আসলে ঐরকম ভয়ঙ্কর পরিবেশে আবার ফিরে যেতে ভয় করাটাই স্বাভাবিক। আমরা সবাই মিলে ওকে বুঝিয়ে বললাম- এখন দোষীরা তাদের অন্যায় স্বীকার করেছে । ভবিষ্যতে আবার যদি তারা কোনো অত্যাচার করে ওদের গ্রেফতার অবশ্যই করা হবে। আর কোনো ওয়ার্নিং দেয়া হবে না। তাছাড়া ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কোর্টে তো যাচ্ছেই। তারপর কিছুটা শান্ত হয়ে ও ওদের সাথে বাড়ি চলে গেল।
এইসব গল্প করতে করতে ঘড়ির কাটা কখন ৯ টা পার হয়ে গেছে টেরই পায় নি দুজনে। গীতা দি, চটপট করে তিনটে রুটি, সবজির তরকারি করে দিয়ে বাড়ির উদ্যেশে রওনা দিলো।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা হয়ে গেছে। রাতের খাবার খেয়ে চন্দ্রিমা সবে শুয়েছে। জানলা গুলো খুলে রাখার জন্য ফুরফুরে হওয়ায় খুব সহজেই চন্দ্রিমার চোখে তন্দ্রা এসে গেল। ঘুমন্ত অবস্থায় আধো খোলা চোখে ঘরের জিরো আলোয় সে লক্ষ্য করলো একটা যেন মানুষের ছায়া বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। মনের ভুল ভেবে চন্দ্রিমা পাশ ফিরে শুলো। শোয়া মাত্রই সে অনুভব করলো কে যেন তার পাশে গা ঘেষে বসলো। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল 'দিদিমণি আমি তো ওদের সাথে যেতে চাই নি, তবু আমায় জোর করে কেন পাঠালেন? ওরা আমায় বাড়ি নিয়ে গিয়ে কত অত্যাচার করেছে জানো ! আমি ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছি বলে প্রথমে আমার ডান হাতে গরম তেলে ঢেলে দিল। উফফ!! সে কি অসহ্য যন্ত্রনা। ওরা আমার হাত, পা বেঁধে রেখে উত্তপ্ত রডের ছ্যাঁকা দিতে লাগলো। দেখো দিদিমণি দেখো!! আমার শরীর এর লাল দগদগে ঘা গুলো । ওই পিশাচ গুলো তারপর আমার মুখে এসিড ঢেলে দিল। আমার শরীর থেকে চামড়া গুলো গুটিয়ে গলে যেতে লাগলো। মরণ যন্ত্রনায় মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে থাকলাম।শরীরের অসহ্য জ্বালা সহ্য করতে পারছিলাম না। চিৎকার করতে থাকলাম। কিন্তু কেউ শুনতে পেল না।নরপিশাচ গুলো টেলিভিশনের সাউন্ড জোর দিয়ে আমার ওপর পাশবিক অত্যাচার করতে থাকলো। তারপর দা নিয়ে এসে চালিয়ে দিলো আমার গলায়। "
এইসব কথাগুলো প্রায় একেবারে জ্ঞানহারা অবস্থাতেই চন্দ্রিমা শুনছিলো। সাহসে ভর দিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো তার পাশে বসে আছে রিনা। চোখ দুটো এসিড এর মারাত্মক প্রভাবে আর আস্ত নেই। চামড়া গুলো পুড়ে সাদা হয়ে নুন ছা ল বেরিয়ে গেছে। চুল গুলো ও পুড়ে গেছে।গলার নলি থেকে তখন ও টাটকা রক্ত টপটপ করে পরে ওর পরনের শাড়ি রক্তাক্ত হয়ে ভিজে যাচ্ছে। এইসব দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রিমার শরীরটা অসাড় হয়ে গেল। এইভাবেই কতক্ষন বিছানায় পরে ছিল চন্দ্রিমা নিজেই জানে না।
ঘুম ভাঙল সকালে অফিসের মিস্টার দাসের কলে। ফোনটা তুলতেই চন্দ্রিমাকে খবর দিলো থানা থেকে - কালকের অভিযোগকারী রিনা দেবীকে খুন করা হয়েছে। বডি ময়নাতদন্ত ও অভিযুক্তদের গ্রেফতারের জন্য এক্ষুনি বেরোতে হবে।
চন্দ্রিমা বুঝতে পারলো সমাজের নারীরা আজও কতটা অসহায়।
0 মন্তব্যসমূহ