দাদার প্রতিশ্রুতি



দাদার প্রতিশ্রুতি elder brother promise


দাদার প্রতিশ্রুতি

অন্দরমহলে তখন চলছে আনন্দের উচ্ছাস। আমন্ত্রিত সকল আত্মীয়- স্বজন ,পাড়া প্রতিবেশীরা সাজ সজ্জায় নিজেদের রাঙিয়ে অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছে মহানন্দে। পরী কে সাজানো হচ্ছে যে ঘরটায় সেখানেও পরীর খুব কাছের বান্ধবীরা তাকে তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ এ ব্যস্ত। যাতে সাজগোজের কোথাও বিন্দুমাত্র খামতি না থেকে যায়।এই দায়িত্ব টা অবশ্য পরী নিজেই দিয়েছিল তার বান্ধবী দের। যাতে জীবনের শ্রেষ্ঠ মহালগনে সে নিজে যথার্থই" পরী" মতো হয়ে উঠতে পারে।

একান্নবর্তী না হলেও মোটামুটি বড়ো সংসারেই পরী বড়ো হয়েছে। দাদু, ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমা, জাঠ তুতো দাদা বিজয় , আর বাবা মা এই নিয়েই তাদের সুখী পরিবার। বিজয় পরীর থেকে বছর সাতেকের বড়ো হওয়ার জন্য দাদা সুলভ সমস্ত শাসন, ভালোবাসা উভয়ই উপহার পেয়েছেপরী , বিজয়ের থেকে। পরীর আজ এই কোনের সাজে সাজতে বসে মনে পরে যাচ্ছে , ছোট বেলাকার নানা স্মৃতি। আজ তার দাদার ভালোবাসা, আবদার থেকে যে , সে একটু হলেও দূরে সরে যাচ্ছে সেই কষ্টটা যতই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে ততই যেন চোখ কোনো বাধাই মানছে না।

বিয়ের পর সব মেয়ে দের ই তো মা, বাবা কে ছেড়ে বাপের বাড়ির মায়া কাটিয়ে শশুর ঘরে যেতে হয়। এই কঠিন বাস্তবটা হয়তো মেয়েরা ছোট থেকেই শুনতে শুনতে সেই দুঃখের পাথরের ভারিত্ব টা নিজের শরীরে সইয়ে নিতে পারে, যদিও চোখের জল কোনো বারণ, কোনো বাধাই মানে না বিদায় বেলায়।

কিন্তু পরীর যখনই মনে পড়ছে দাদার সঙ্গ, ভালোবাসা, শাসন, অভিযোগ, অনুযোগ সমস্ত কিছু ছেড়ে তাকে অন্য জায়গায় অন্য ঘরে যেতে হবে তখনই তার বুক হু হু করছে, অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার বেদনায়।

পরীর আজ বিয়ে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গোধূলি লগনে সৌম্যর সাথে ওর শুভ পরিণয় সু সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু সেই ভোর বেলায় জলসইতে যাওয়া আচার থেকে শুরু করে গায়ে হলুদ , নানী মুখ কোনো অনুষ্ঠানেই পরী তার দাদাকে দেখতে পায় নি। যতবার জেঠিমনিকে সে জিজ্ঞাসা করেছে দাদার কথা , তত বড় ই সে একই উত্তর সে পেয়েছে।" তার পরী বনির আজ বিয়ে সে ব্যস্ত থাকবে না বুঝি?" তারই তো সব দায়িত্ব। কোথাও আছে হয়তো এইদিক ওইদিকে।"

সাজ প্রায় পুরো কমপ্লিট। উচ্চস্বরে উলুধ্বনি আর বাড়ি শুদ্ধ লোকের সমাগম, কোলাহলে পরী স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ' বর এসেছে,বর এসেছে"  বলে সবাই ছুটে চলেছে সদরের দিকে। গুটি কয়েক যে কয়জন বান্ধবী পরীর সাজের ঘরে ছিল তারাও পরীকে ফেলে নিমিষে উধাও হয়ে গেছে সৌম্য কে দেখতে।

এই সময়টা একা একা ঘরে পরী বিড়বিড় করে বলতে থাকে বান্ধবী পারমিতা, আর মিমির উদ্যেশ্যে--
যেন তোরা কোনোদিন ও সৌম্য কে দেখিস নি। একই সাথে তো আমরা সব কলেজ থেকে পড়েছি।

এমনই সময় দরজায় হটাৎ নক করার আওয়াজে পরী আবার যেন নিজের জগতে ফিরে এলো।
-- কি রে পরী রেডি তো? আর কত সাজবি? এখনো যদি সাজতে সময় নিস তোর ঐরূপ দেখে তো সৌম্য ভিরমি খাবে রে, পাগলী। দাদার গলার আওয়াজ পেয়ে পরী, ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দাদাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।
-- এ বাবা!! বোকা মেয়ে , একটা। কাঁদছিস কেন? মেকআপ তো সব গোলে গোলে পরে যাচ্ছে রে। কি হবে এবার?
--ফালতু ইয়ার্কি করিস না দাদাভাই, তুই সারাদিন কোথায় ছিলিস আগে বল? আজ কের দিনে তোকে সকাল থেকে দেখতে না পেয়ে আমার কষ্ট হয়েছে তুই জানিস?
-- কষ্ট? কষ্ট আমি কোনদিন ও তোকে দিতে চাই নি রে পরী। আর প্রাণ থাকতে দেব ও না।
--তৎক্ষণাৎ দাদার মুখটা চেপে ধরে পরী বলে -- ওরকম অলুক্ষনে কথা আর কোনোদিন বলবি না দাদাভাই। আমি জানি, হ্যাঁ! শুধু আমি ই মাত্র জানি তুই আমার জীবন জুড়ে কতটা বিরাজ করছিস। তুই পাশে না থাকলে তো আজ কের এই শুভ লগন টাই আসতো না রে। আমার সাথে সৌমর কোনো দিন ও বিয়ে টা হতো না। মনে পারে দাদাভাই? কলেজে তখন আমার প্রথম বৎসর। সেই বছরই ক্লাসমেট সৌমর সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেহেতু ছোট থেকেই আমার যত আবদার গল্প আড্ডা তোর সাথে তাই তুই আমার থেকে বয়সে এত টা বড়ো হলেও নিদ্বিধায় তোকেই  বলেছিলাম আমার সৌম্যর সম্পর্কের কথা। তোকে তো বলেছিলাম সৌম্য অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে নয়। কিন্তু ও খুব মেধাবী । ওর বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়ির নিচের তোলার ভাড়ার টাকা, আর মামার বাড়ির সাহায্যে মা ছেলের দিন চলে। আমি জানতাম, বাবা জেঠু দাদু কেউই এই সম্পর্ক তাই মেনে নেবে না। কিন্তু তখন তোর ই বা কত বয়স সবে চাকরিতে জয়েন করেছিস। আমার মাথায় হাত দিয়ে তুই কথা দিয়েছিলিস " দেখে নিস পরী ওই সৌমর সাথেই আমি তোর বিয়ে দেব"।

তারপর আজ সৌম্য যে নিজের মেধায় কলেজের প্রফেসর হয়েছে ওর এত নাম,যশ হয়েছে- বাবা, জেঠু ও সৌম্য কে নিয়ে এত গর্ব করছে - তার পিছনে তোর অবদান তো অশেষ দাদাভাই।
--- চুপ কর পরী, কি বলছিস এখন? সবাই শুনতে পেয়ে যাবে তো?
---শুনতে পেল আজ কিছুই অঘটন ঘটবে না দাদাভাই। কারণ প্রফেসর জামাইকে বাবা, জেঠু আর কেউই কিছু বলবে না।তুই যদি প্রতি মাসে স্যালারি থেকে অতগুলো টাকা সৌম্যকে  দিয়ে ওর পাশে ওর পরিবারের পাশে না দাঁড়াতিস আজ হয়তো সৌম্য এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতো না। আমি তো জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার টা তোর থেকেই পেয়েছি দাদাভাই। তোকে ছেড়ে, এই পরিবার ছেড়ে যেতে আজ খুব কষ্ট হচ্ছে রে।
-- পাগলী আমার। আমাদের ছেড়ে কোথায় আর যাচ্ছিস তুই? বরং আমাদের পরিবারে আরেকজন আদর্শ ছেলে, সুখী পরিবারের বন্ধন ঘটাতে চলেছিল তুই।
-- কি রে বিজয়? দাদা- বোনের রাগ অভিমানের কথা মিটল? 
জেঠিমনির কথায়  দুজনেরই কান্না মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
পিঁড়িতে তুলে পরীকে নিয়ে সবাই এবার বিয়ের মণ্ডপে হাজির হলো। শুরু হলো বিয়ের আচার অনুষ্ঠান। মন্ত্র পাঠ।
ঠাকুর মশাই বলে উঠলেন -- কন্যা দান করবেন কে?
--সৌম্য, আর  পরী জোড়া গলায় বলে উঠলো" দাদাভাই"।
 এইভাবে বিজয় ই পরী কে তুলে দিল সৌম্যর হাতে। দুটি প্রাণ আজ বিজয়ের হাতের মাধ্যমেই মিলেমিশে এক হয়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ