বিরিয়ানি বিভ্রাট


biryani bivrat বিরিয়ানি বিভ্রাট
বিরিয়ানি বিভ্রাট


বিয়ের পর প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি গেছি। আমি বরাবরই একটু লাজুক, কম কথা বলতে অভ্যস্ত। এমনটা নয় যে নিজের ব্যক্তি সত্ত্বা নিয়ে গাম্ভীর্য নিয়ে থাকি। কিন্তু ওই লোকজনের সাথে সবসময় হেসেখেলে , হাউহাউ করে কথা বলতে মোটেও পারদর্শী নই আমি। কিন্তু আমার নববিবাহিতা স্ত্রী তার ঠিক উল্টোটা।

সে যাই হোক প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি আসতেই শ্বশুর মশাই শ্বাশুড়ি মা যত্ন আত্তির কোনো টুটি রাখলেন না। ঐদিকে পিতৃলয়ে পা রাখা মাত্রই আমার ' উনি ' লাফাতে লাফাতে তুতো ভাই-বোন দের সাথে আড্ডা দিতে চলে গেল। মাঝখান থেকে আমি রইলাম একা। সকালে জল খাবারে চিরাচরিত বাঙালি বাড়ির সেরা ভোজন গরম গরম ফুলকো লুচি ,সাথে খাসির মাংস ও শেষ পাতে জলভরা সন্দেশ সহযোগে সারলাম পেট পুজো। একটু বেলা বাড়তেই স্নান সেরে এলাম, একা একা কি আর করবো, খবরের কাগজ খানা নিয়ে বসলাম দোতলা ঘরে লাগোয়া  ব্যালকনি টায়। কিন্তু এতটা সময় পার হয়ে গেলেও আমার 'উনি'-র কোনো টিকিটিও চোখে পড়লো না। আর তুতো ভাই-বোন দের ও কোনো পাত্তা নেই। মনে মনে ভাবলাম যাক সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ওই শালা, শালী নিয়ে হাসি ঠাট্টা আমার ঠিক আসে না। তাছাড়া বিয়ের দিন জুতো চুরি করে রাখা, সারাদিন অভুক্ত থেকে সদ্য বিবাহ করে যে ঘরে প্রবেশ করবো সেখানেও দ্বার আটকে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার এত কিছু রসিকতার পরেও "জামাইবাবু, জামাইবাবু" বলে গায়ে ঢলে পড়ে টাকা আদায় করা সব এখনো টাটকা স্মৃতিতে গেঁথে আছে। এইসমস্ত রঙ্গ তামাশা, থেকে ব্যাবধানে থাকতেই আমি বেশি পছন্দ করি। তবে আমি মানুষটা এমনিতে রসিক প্রিয় না হলেও ভোজন রসিক তো বটেই। 
খবর কাগজ টা হাতে নিয়ে একটা লাইন ও পড়ি নি বোধহয় এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি শ্বশুর মশাই এসেছেন দৈপ্রহরিক খাবারের জন্য আমায় আহ্বান জানাতে। দুপুরের খাবারেও দেখলাম রকমারি মাছের পদ।  শ্বাশুড়ী মা দেখলাম খাবারের বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেন নি। ঘি-ভাত থেকে শুরু করে শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ডাব-চিংড়ি, তপসে ফ্রাই, দই-পোনা  কি নেই! সব আছে। লাজুক শরীরে সবটুকু লজ্জা বিসর্জন দিয়েই তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া, দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিতে সবেমাত্র শুয়েছি- হজম প্রক্রিয়ার সাথে সাথে সবে মাত্র তন্দ্রা ভাবটা চোখে লেগেছে এমনি সময় পঙ্গপালের মতো তাদের আবির্ভাব। মানে আমার শালা,শালী রা এসে হাজির। তাদের চেঁচামেচি, আর হুল্লোরে আমার কান ঝালাপালা হওয়ার দায়। আমি শুধু মাত্র নীরব দর্শক হয়ে তাদের মধ্যে পরে রইলাম । একটা সময় হট্টগোল থামিয়ে গভীর আলোচনায় তারা মগ্ন হলো। আলোচনা এই যে-জামাইবাবু কে বিরিয়ানি খায়াতে হবে। এটা তাদের আবদার। মিন্টু, পল্টু, শুভ, কার্তিক অন্যদিকে ঝুমা, পল্লবী,টিনা, আরশি সব মিলিয়ে আটজন শালা শালীর আবদার এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। সকলকে কোনোমতে থামিয়ে বললাম "হাঁ অবশ্যই খাওয়াবো। " স্বাভাবিক ভাবেই বিরিয়ানির নাম শুনে আমার ও মন টা কেমন যেন উৎফুল্লতায় চনমন করে উঠলো। কিন্তু এখনেই এবার ব্যাঘাত শুরু-
মিন্টু বললো "কলকাতা বিরিয়ানি খাবো, "তাকে থামিয়ে ঝুমা চিৎকার করে বলতে থাকে -'না না -জামাইবাবু থালেশ্বরী বিরিয়ানি খাবো। এদের কথা শুনেই এবার বুঝতে পারলাম এই তল্লাটে সব ধরণের বিরিয়ানি ই তাহলে এভেলেভেল। আবার তাকে প্রায় মুখ ঝামটা দিয়ে কার্তিক বললো "জামাইবাবু ঢাকাই বিরিয়ানি ই অর্ডার দাও।" এবার রণমূর্তি ধরে কার্তিকের চুলের ঝুটিটা ধরে নাড়া দিয়ে আরশি বলে" জামাইবাবু যে যাই বলুক হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি টাই ফাইনাল" । এতক্ষন পল্টু ছিল চুপ করে তেড়ে মেরে আরশির উপর প্রায় হামলে পরে গলা হাঁকিয়ে বললো-" সব কিছু কি তোর মতে হবে নাকি? আমরা লখনৌই বিরিয়ানি খাবো জামাইবাবু। এমন অবস্থায় আমার যে কি হাল হচ্ছে নিশ্চই বুঝতে পারছেন। 
অবশেষে শ্বশুর মশাই এসে এর বিহিত করলেন। ঠিক হলো-কলকাতা বিরিয়ানি আনা হবে। অগত্যা শ্বশুর মশাই এর কথা ফেলবে এমন সাধ্য তাদের নেই। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। খাবারটা দেব অর্ডার এমন সময় আবার বিস্ফোরণ- মিন্টু বলে আর্সেনাল ' থেকে অর্ডার দাও , আরশির পছন্দ দাদা-বৌদির বিরিয়ানি। আবার শুভর আবদার হাজী বিরিয়ানি, ঝুমা আদুরে গলায় বলে 'জামাইবাবু প্লিজ ঢাকাই বিরিয়ানি হাউসের বিরিয়ানি, ।আবার আমার 'উনি'ও এরমধ্যে যোগদেয় । তার বায়না আবার আমিনিয়া রেস্টুরেন্ট । শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয় বাড়ির পাশের আর্সেনাল থেকে বিরিয়ানি অর্ডার দেওয়া হবে।
 আবার শুরু হলো হট্টগোল। এবার শুরু হলো আসল বিরিয়ানি যুদ্ধ। কেউ বলে মটন বিরিয়ানি, কেউ চেঁচাচ্ছে চিকেন বিরিয়ানি, 'উনি' বলছেন পনির বিরিয়ানি, শুভ বেচারা বাচ্চা ছেলে ভেজ বিরিয়ানি বলে প্রায় কেঁদেই ফেললো। এমন চিৎকার শুনে অবশেষে শ্বাশুড়ি মা নিচেতলার ঘর থেকে উঠে এসে এই যুদ্ধের ইতি টানলেন। সকলের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘোষণা করলেন 'এপার- ওপার সবই থাক আজ মিলেমিশে -আজ আমি সকলের জন্য রাধবো ইলিশ বিরিয়ানি।"ইলিশের গন্ধ, আর বিরিয়ানির স্বাদে সবাই বাধলো একজোট , সকলের মুখে ফুটলো হাসি। আমি তো এদের ঠেলায় হয়েছিলাম এতক্ষন জুবু থুবু। এখন বুঝতে পারছি শ্বশুর বাড়ি গেলে এমনটাই অবস্থা হয় সকল জামাইবাবুর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ