বাণী দি

একটা নারী শরীর।স্কুলের তথাকথিত শিক্ষার গন্ডি না পেরোনো এক নারী। যার ইতিহাস,ভূগোল কিংবা বায়োলজি ,কেমেস্ট্রির মতো বইয়ের সাথে কোনো সাক্ষাৎ ই কখনো হয় নি।তবু সে শিক্ষিত, মার্জিত সমাজের কাছে নিরক্ষর হলেও মানবতার পরীক্ষায় স্বাসন্মানে উত্তীর্ন।কথা হচ্ছে আমার চেনা একজন আয়া।যাকে আমি বাণী দি বলে ডাকি।

শান্তনুর সাথে আমার বিয়ে হয় বছর চারেক আগে।ও একটি সরকারি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক।অনীলা দেবী মানে আমার শাশুড়ি মায়ের কখনোই পছন্দ ছিল না একমাত্র ছেলের বিয়ে চাকুরিজীবি কোনো পাত্রীর সাথে হোক।সদ্য স্বামী হারা শাশুড়ি মা চেয়েছিলেন ঘরোয়া মেয়েকে পুত্রবধূ করে নিয়ে আসতে।যাতে তার একার জীবনে কিছুটা সঙ্গ মেলে।কিন্তু অদৃষ্টের নিয়মেই আমার মতো একজন সর্বক্ষণের ব্যস্ত নার্স এর সাথেই ছেলের বিয়ে দিতে হয় তাঁকে।

নার্সের চাকরির জন্য আমায় কখনো ডে কখনো নইট এ ডিউটি করতে হতো।তাছাড়া পুজো পার্বণে, কোনো অনুষ্ঠানে ও সেইরকম ভাবে বাড়িতে সময় দিয়ে উঠতে পারতাম না।নব বিবাহিতা বৌমা বাড়ির বাসী কাজ করা থেকে শুরু করে,চা করা,পুজো করা,রান্না করা ,সমস্ত কাজ গুছিয়ে করবে এমনটাই আশা করেছিলেন শাশুরি মা।কিন্তু তা তাঁর মনের মতো না হওয়ায় তিনি কাউকে বলতে পারতেন না।নিজের মনেই গজগজ করতেন।আমার আর শান্তনুর তা দৃষ্টি এড়ায় নি।কিন্তু আমরাও তো ছিলাম নিরুপায়।এইভাবেই মায়ের(শাশুড়ি মা) নিঃসঙ্গতার অভাব থাকা সত্বেও আমরা রোজকার কর্মস্থলে বেরিয়ে পরতাম।বেরোনোর সময় বাড়ির রাস্তা থেকে লক্ষ্য করতাম করুন,নিরাপত্তাহীন মায়ের দৃষ্টি,যেন দিনের শুরু তেই বাড়ি ফেরার অপেক্ষারোত মন।

রোজকার রুটিন,শান্তনুর স্কুল,আমার হসপিটাল এইভাবেই কেটে গেল দুটো বছর।ইতিমধ্যেই আমি সন্তানসম্ভবা হলাম।সত্যি বলতে কি এতে আমরা যত না খুশি হয়েছি তাঁর চেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছিলেন মা।আমরাও খুব আশাবাদি হলাম এবার মা সর্বক্ষণের সঙ্গী পাবে।

দেখতে দেখতে নয় মাস পর হয়ে গেল।প্রেগনেন্সির জন্য সোনু(আমার ছেলে) হওয়ার দুমাস আগে থেকেই ছুটি নিয়েছিলাম।সোনু যেদিন হলো মা হওয়ার পরোমতৃপ্তি কেও যেন ম্লান করে দিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের সদ্য ঠাকুমা হওয়ার উচ্ছাস আর আনন্দ।সোনুর মধ্যেই তিনি তাঁর স্বামীকে খুঁজে পেলেন।নাতিকে প্রথম কোলে নিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বললেন 'বৌমা তোমার শশুর মশাই আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন।'নার্সিংহোম থেকে সোনু কে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মা ই সনুর দেখাশোনা করতেন।পরিপ্রেক্ষিতে বলি সোনু হয়েছিল ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ।ওই শীতের ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাতির কাঁথা, জামাকাপড় কেচে নিজে কে ঠাকুমা হওয়া সার্থক মনে করতেন।আমার আর শান্তনুর বারণ তার কানেই আসতো না।সোনু তিন মাসের হতেই আমার হসপিটালের ছুটি শেষ হয়ে গেল।এমতা অবস্থায় সোনুর সারাদিনের দেখভালের জন্য একজন আয়া নিযুক্ত করা খুবই প্রয়োজন ছিল।সেই সূত্রেই বাণী দির সঙ্গে আমার পরিচয়।বাণী দি কে আমরা কোনো এজেন্সি মারফত পাই নি।বাণী দি শান্তনুর স্কুলের পাশেই একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।বয়স পঁয়তাল্লিশ এর কাছাকাছি। বিবাহবিচ্ছিন্না, তার কাছেই শুনেছি কোনো সন্তান তার নেই।স্বামী বিয়ের পর পরই তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিবাহ করেছে।এখন ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে।আয়া র কাজ করে কোন মতে দিন চলে।

বাণী দি কে সোনুর দেখাশোনায় বহাল রেখে শান্তনু আর আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলাম।মা ও খুব খুশি ছিলেন বাণী দি কে পেয়ে।তাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল শুধুমাত্র সোনুর জন্য।কিন্তু বাণী দি মায়ের ও যত্ন নিতো।তাছাড়া মা কে সারাদিন সঙ্গ দেওয়া,তাঁর সাথে গল্প করা।এভাবেই মা ও অতীতের সব কথা বাণী দি কে নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিতেন।আর বাণী দি ও মাসিমা বলতে ছিলেন অজ্ঞান।আমি র শান্তনু সকাল নয়টার মধ্যেই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাণী দি সকাল আট টায় এসে হাজিরা দিত।আমরা তাকে সকাল দশটা থেকে কাজে আসতে বলেছিলাম।কিন্তু বাণী দির নাকি সোনু আর মাসিমা কে ছাড়া ভালো লাগে না।তাই আগেই চলে আসতো।আমরা বেরিয়ে যাওয়ার পরই সোনু কে স্নান করানো,খায়ানো, ওর সাথে খেলা,আবার মায়ের স্নান,কাপড় ধুয়ে দেয়া সমস্ত কিছুই বাণী দি একা হাতে করতেন।অল্প দিনের মধ্যেই তার সাথে আমারা নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম।

ঘটনাটা ঘটেছিল চোদ্দই জুলাই দুপুরবেলা।সোনু না ঘুমোবার জন্য খুবই বিরক্ত করছিল।তাই সোনুকে নিয়ে বাণী দি নীচে বাগানে ঘোরাতে এনেছিল।বাণী দি র অলক্ষেই চার জন দুষ্কৃতীর দল নিচের দরজা খোলা পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজা খোলা পেয়েই ঘরেঢুকে পরে।মুহূর্তের মধ্যেই উপর থেকে দুম দাম আওয়াজ,জুতোর শব্দ,চাপা গলা শুনতে পায়।বাণী দি বুঝতে পারে এটা কোনো বিপদের সংকেত।তিনি বুদ্ধি করেই সোনুকে তাড়াতাড়ি মলয় কাকু দের বাড়ি রেখে আসেন।ততক্ষনে দুষ্কৃতী রা ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।ইতিমধ্যেই তার চিৎকারে মলয় কাকু সহ পাড়ার লোকেরা জমায়েত হয়।বিপদ বুঝে দুষ্কৃতীরা ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিয়ে পাঁচিল টপকে পালায়।মায়ের উপর ভাগ্য ভালো তারা কোনো আঘাত হানতে সক্ষম হয় নি।এর মধ্যেই আমাদের ফোন করতেই পাড়ার লোকেরা আমরা তড়িঘড়ি বাড়ি আসি।এসে দেখি পাড়ার লোকেরা বাণী দি কে ঘিরে জমায়েত করে আছে।এবং আমাদের দেখেই তারা একসঙ্গে বলতে থাকে দুষ্কৃতী রা নাকি বাণী দির চেনাজানা।অচেনা কোনো মহিলার ভরসায় বাচ্ছা বয়স্ক মা কে ফেলে কাজে বেরোনোর ফল ভোগ করতে হতো তারা না আসলে ঠিক সময়ে।ইত্যাদি ইত্যাদি।তারা নাকি পুলিশ কেও খবর দিয়েছে বাণী দি কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।শান্তনু তাদের প্রানপনে বোঝানোর চেষ্টা করলো এতে যদি তার কোনো হাত থেকে তো চিৎকার করে আপনাদের ডাকবে কেন।তারা তো মানতে না রাজ।তাদের বক্তব্য সোনু কে বাগান ঘোরানোর নামে দরজা খুলে সাহায্য করেছে বাণী দি।আর বেগতি দেখে দুষ্কৃতী ভাগিয়ে লোক ডেকেছে।বাণী দি দোষ ঢাকতে চাইছে।

সন্ধে হয়ে এলো।পুলিশ গাড়ি এলো।আমার আর শান্তনুর জবানবন্দিতে বাণী দি কে থানায় যেতে হলো না।কিন্তু বাণী দি সেইদিন একটা কথাও বলে নি।নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল।লজ্জা অপমানের তকমা নিয়ে বাড়ি ও ফেরে নি।কিন্তু আমরা জানি সেইদিন সেই মুহূর্তে তড়িঘড়ি সোনুকে বুদ্ধি করে মলয় কাকুর বাড়ি না রেখে এসে যদি উপরে উঠে আসতো বাণী দি তাহলে অনেক বড় জীবনের দাম আমাদের দিতে হতো।শিক্ষিত মানুষের ভিড়ে অশিক্ষিত বাণী দি ইসেদিন আমাদের পরিবার কে বাঁচিয়ে ছিল।পরিচালিকা দের পুঁথিগত শিক্ষা না থাকলেও মানবতার শিক্ষা তারা ট্রেনিং ছাড়া ই পেয়ে যায় জীবনযুদ্ধে রোজগার করতে নেমে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ