যারা আমাদের প্রতিনিয়ত দুঃখ দেয় তারাই আবার আমাদের দোষ দেয়। আমাদের খুঁত খোঁজে। আমাদের প্রতিটা পদে অপমানিত করে। কিন্তু আমরা মন প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি তাদের মন জুগিয়ে চলতে, তাদের পছন্দ সই সমস্ত কিছু হাতের সামনে রেখে দিই। তাদের দরকারি জিনিস পত্র টাইম মতো তাদের হাতের সামনে রেখে দিই। তবু তারা আমাদের একটা কিছু ভুল পেলেই কথা শোনাতে ছাড়ে না। এটাই হয়তো কপালের লিখন। তবু আমরা মুখ বুজে সবটা সহ্য করি। আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তা কে বলি আর কত ! আর কত সহ্য করব ভগবান। আমায় সবটা সহ্য করার মতো ক্ষমতা দাও। আমায় শান্তি দাও। একটু মানসিক শান্তি দাও। ব্যাস শুধু এটুকুই চাই...
একটা গরীব ঘরের মেয়ে কখনো শ্বশুর বাড়িতে কারো প্রিয় হতে পারে না। পান থেকে চুন খসলেই বাপের বাড়ি নিয়ে কথা শুনতে হয়। বাবা, মা র শিক্ষাকে তারা কাঠগড়ায় তোলে । তারা একবারও ভাবে না একটা মেয়ে তার ঘর, বাড়ি, আপনজন সব ফেলে এসেছে । তাদের একটু মেয়েটাকে মানিয়ে নিতে হবে। উল্টে তারাই মেয়ে টার সামান্য ভুল ত্রুটি দেখলে কথা শোনায়। যে ঘরটা তার নিজের বলে জন্মের পর থেকে জেনে এসেছিল আজ সেই ঘরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে হয়। তবুও সবসময় অনুমতি মেলে না। ভালো কিছু খেতে, পড়তে চাইলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। যদি বাপের বাড়ি তুলে কথা শোনায়... মেয়েরা দুদিন না খেয়ে থাকবে তবু ভালো। কিন্তু বাবা- মায়ের অপমান কানে শুনতে পারবে না। এই জন্যই অনেক মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায় অল্প বয়সে। দেনা পাওনা দিতে না পারার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, কিংবা মেয়ে দেখতে ভালো না , রং কালো বার বার এই অভিযোগে।
একলা ঘরে রাতের আঁধারে একাকী মেয়েটা গুমরে মরে। সারাদিনের খাটা খাটনীর পর ক্লান্ত মনটা একটু সতেজ হতে চায় স্বামীর আলিঙ্গনে। কিন্তু মেয়েটার কপালে সেটাও জোটে না। সেখানে ও জোটে চরম ভৎসনা। বিষণ্ন হৃদয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কখন যে ঘুমিয়ে পরে টের পায় না। ঘুম ভাঙে গভীর রাতে। নিশ্চুপ রাত তখন টিপ টিপ তারার আলোয় বড়ই নিঝুম। মেয়েটা এসে জানালার পাশে এসে বসে। নিজের মনকে সে জিজ্ঞাসা করে আপন কেউ ছেড়ে চলে গেলে সে কি করতো? মন বলে যে আপন সে কখনোই চলে যায় না। আর যে যায় সে কখনোই আপন ছিল না। মেয়েটা আরো কাঁদতে থাকে। বার বার মা বাবার কথা মনে পরে যায় তার। মা, বাবার মুখ টা ভেসে ওঠে। সমাজের এই বিয়ে বিয়ে খেলাটা কে ধিকার জানায়। বাড়ি ফেরার জন্য মন আকুল হয়ে ওঠে।
বিয়ের প্রথম রাতের কথা মনে পড়ে যায়। কে যেন তার হাতে হাত রেখে বলেছিল আমি সারাজীবন তোমায় ভালোবাসবো। তোমার খেয়াল রাখবো। বিনিময়ে তুমি শুধু আমায় এবং আমার পরিবারের সকলের পাশে থেকো। মেয়েটা কথা রেখেছিল। তার যথাসাধ্য চেষ্টা দিয়ে পরিবারের সকলের কথা শুনে চলতো। কিন্তু বিনিময়ে সে পেল চরম অবমাননা। আসলে সে ছিল গরিব ঘরের মেয়ে। আস্তে আস্তে পরিবারের প্রতিটা সদস্য থেকে নিজের স্বামীর কাছেও সে পর হয়ে গেল। তার সর্বস্ব দিল সে। আর হারালো ও সব কিছু। যৌবন, মূল্যবান সময়, সন্মান , ভালোবাসা সব... সব কিছু হারালো।
একটা সময় পর এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে শশুর বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া হয়। যে বাড়িতে একসময় তাকে লক্ষহী রূপে বরণ করা হয়েছিল আজ সেই ঘর থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থের কাছে হেরে যায় ভালোবাসা। সংসার টা টিকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা মেয়েটা করেছিল। সব কিছু কথা তাদের মেনে চলত। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সকল ফাই ফরমাস খাট তো। তবু তাদের মন পেল না। দিন রাত ঠাকুর কে ডাকতো তারা যাতে তার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করে, একটু যেন স্বামীর সহানুভূতি পায়। কিন্তু না... কিছুই তার জন্য হয়তো বিধাতা লেখে নি। লিখেছে চরম অপমান।
ভগ্ন হৃদয়ে রুগ্ন চেহারা নিয়ে বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফেরে। মা- বাবার মেয়ের চেহারা দেখে বুক ফেটে যায়। বাবা অভিমান করে বলে আমার রাজকন্যা র এত কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না। আর সহ্য করতে পারছি না। আমার মেয়ের এইরূপ দেখা র আগে আমার মরণ হল না কেন। মা আঁচলে মুখ গুজে চোখের জল ফেলে। মেয়ে নির্বিকার। চোখের জল নেই। কঠোরে ঢোকা কালি মাখা চোখ গুলো নির্বিকার। আনমনে মেয়ে বলে গেল অনেক চেষ্টা করেছি মা জানো তো ... অনেক মাথা নত করেছি। পারলাম না মা তোমার মত করে আমার সংসার টা ধরে রাখতে। আমি ফিরে এলাম মা। আমি তোমাদের কাছে ফিরে এলাম।
আর কখনো মা , তোকে ওই ঘরে যেতে হবে না। আমি ভুল করে আমার রাজকন্যা কে কসাই খানায় দিয়েছিলাম। আমার প্রতিমার মতো মেয়ের যারা কদর করতে পারে নি সেই ঘরে আর কখনো মেয়ে পাঠাবো না। আমি পঁচিশ টা বছর আমার মেয়েকে খাইয়ে পরিয়ে বড়ো করেছি আর সারাজীবন পারবো। আমি আমার মেয়েকে কখনো ওই ঘরে পাঠাবো না। ডাল ভাত হোক, নুন ভাত আমার মেয়ে যা জুটবে তাই খাবে। মেয়ের জন্য বাবার দরবার সারাজীবন উন্মুক্ত। আমার প্রতিমা আমার ঘরেই থাকবে ঘর আলো করে।
কিছুদিন কেটে যায়। মেয়েটা একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু ঘর থেকে বাইরে বেরোতে পারে না চক্ষু লজ্জার ভয়ে। পাড়া প্রতিবেশীর লোকেরা ব্যাপার টা একটু বাঁকা চোখে দেখে। অনেকেই ফাক পেয়ে মেয়ের মা কে নানা রকম পরামর্শ দেয়। এতে মায়ের মন ও বদলাতে থাকে। একাকী মেয়েকে পেয়ে মা বোঝায় বিয়ের পর শশুর ঘর ই মেয়েদের আসল ঘর হয়। সমস্যা সব সংসারেই থাকে। একটু মানিয়ে নিতে হয়। আসলে মেয়েদের জীবন টাই এইরকম। মানিয়ে নিতে নিতে আর মেনে নিতে নিতেই জীবন ফুরিয়ে যায়। তাদের কষ্ট, দুঃখের কথা ভাবলে চলে না। তাদের অন্যের অসুবিধা র কথা ভেবে সবাই এর দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়।
মেয়ের মনে মায়ের জন্য একটু হলেও রাগ অভিমান হয়। তবু আবার মনকে একটু একটু করে শশুর বাড়ির প্রতি মায়া জন্মাতে শেখায়। মনে পরে শশুর বাড়ির প্রতিটা মানুষের কথা। স্বামীর কথা। আবার মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকে। আবার মনে প্রেম আসে ভালোবাসা আসে। আসলে প্রেম ভালোবাসা ছিল ই মনে। তা আবার উজ্জ্বীবিত হয়। মনে মনে সে বলে অপেক্ষা করতে আমি রাজি। অপেক্ষা করে যদি তোমায় পাওয়া যায় তাহলে আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি। আবার নতুন করে সে স্বপ্ন দেখে। অবার ঘর বাঁধার সপ্ন তাকে বিভোর করে তোলে। আবার নতুন করে টান অনুভব করে। আগের সব বীভৎস স্মৃতি একটু একটু করে তার গোচর থেকে ফিকে হতে শুরু করে। আবার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
মনে নতুন আশার সঞ্চার ঘটে। প্রানপনে ভগবান কে ডেকে যায় সে। অনেক মানত করে, অনেক জায়গায় পুজো দেয়। একবার যেন সে এসে তাকে ও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সে একটি বারের জন্য ও অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে এ বাড়ি ছেড়ে ও বাড়ি চলে যাবে। আসলে মেয়েদের মন কখনো সংসার ভাঙতে চায় না। মেয়েরা হয় ভালোবাসার কায়াল। একটু ভালোবাসা পেলেই তারা সব কিছু উজাড় করে দিতে পারে। মনে মনে ভাবে কোথায় যেন সে একটা পড়েছিল ভগবান বলেছেন চিন্তা করছ কেন তোমার ভবিষ্যৎ তোমার অতীতের চেয়েও সুন্দর হবে। সে কথাটা আজ মনে প্রানে বিশ্বাস করে বুক বাধে। নতুন করে সব কিছু মানিয়ে নেবে বলে। এইবারে সে আর কোনো কিছুতে খুঁত ধরতে দেবে না। ঠিক সংসার করবে।
এইভাবেই একটা মেয়ে আবার সংসারে ফিরে যায়। আবার সব সহ্য করে থাকে। এইভাবেই তাকে মানিয়ে নিতে নিতে জীবন কাটাতে হবে সেটা সে নিজেকে বুঝিয়ে নেয়। একসময় এই সব এর সাথে সে নিজেকে সয়ে নেয়। দিন যায়, মাস যায় , বছর ঘোরে সন্তান হয় দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। নিজেকে নিয়ে ভাবার সে আর সময় পায় না। তাকে নিয়ে করা সমালোচনা গুলো সে আর গায়ে মাখে না। এগিয়ে চলে ভবিষ্যতে র দিকে। নিজের সন্তানের মুখ চেয়ে। তার জন্য জীবন প্রাণ পাত করে তাকে বড় করে তোলার চেষ্টা করে। যাতে সে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ যেন তার মতো তার সন্তানকে কথা শোনাতে না পারে। মোদ্দা কথা কারো না কারো জন্য ভেবে, করেই মেয়েদের জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়। তবু একসময় তারা সবাই এর কাছেই হয়ে যায় পর, অবহেলার মানুষ। এটাই মেয়ে দের জীবন। বাস্তবে আজ ও মেয়েদের এইরূপ চিত্র দেখা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ