সাতপাকে বাঁধা

 



Satpake bandha


সুসজ্জিত ফুলশয্যার খাটে র একপাশে মধুরিমা বসে আছে। কিছুক্ষন পরেই অমিত ঘরে ঢুকলো। অমিত এর রুমে আসার শব্দে মধুরিমা একটু নড়েচড়ে বসলো। মনে মনে একটু ভয় লাগলেও নিজেকেই নিজে সাহস দিল। যাই হয়ে যাক,  আমি কিছুতেই এই আননোন পারসন টার সাথে এক ঘরে থাকবো না। এই সব ফুল , রজনীগন্ধার মালা, গা ভর্তি গয়না জাস্ট অসহ্য লাগছে তার। তারপর ম্যাজমেজে গরম। মধুরিমা হাপিয়ে উঠছিল । একরাশ বিরক্তি নিয়ে মধুরিমা ফুসছিল। হটাৎ ই খাট টা একটু নড়ে উঠতেই, মধুরিমা একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। নিজেকে আরো একটু গুটিয়ে নিল। 


অমিত পকেট থেকে ডায়মন্ড রিং টা বার করে মধুরিমার আঙুলে পরাতে যাবে সেই মুহূর্তে ই হাত টা ছিনিয়ে নিয়ে মধুরিমা বললো, আপনার সাহস হলো কি করে আমার পারমিশন ছাড়া আমার গায়ে টাচ করার? মধুরিমার এহেন আচরণে অমিত আশ্চর্য হয়ে যায়। 

- কিন্তু আমরা তো স্বামী - স্ত্রী মধু। ফুলশয্যার রাতে বর নতুন বউ কে গিফট দিয়ে এক সাথে পথ চলার দিন শুরু করবে এটাই তো স্বাভাবিক। 

অমিত কে থামিয়ে মধুরিমা বললো , সেটা আপনার মনে হতে পারে। কিন্তু আমার না । আমি আপনাকে স্বামী বলে মানি না। আর কখনো মানতেও পারবো না। আর হ্যাঁ, আমায় মধু বলে ডাকবেন না। এই নাম টা ধরে ডাকার শুধু একজন এরই অধিকার আছে। যদিও সে এখন আমার জীবনে অতীত। আর আমার জীবন টাকে তছনছ করে দেওয়ার মূলে আছেন একমাত্র আপনি। 


- আমি ? 

-ইয়েস, আপনার সাথে যদি আমার সন্মন্ধ টা না হত, তাহলে দিনটা আমায় দেখতে হতো না।

- আচ্ছা, আপনি একটু শান্ত হন। আমাকে অতটাও খারাপ মানুষ ভাবার দরকার নেই। আমি অতটাও খারাপ নয়। ঠিক আছে এই আমি আপনার থেকে চার হাত দূরে গিয়ে বসলাম। এবার বলুন তো আপনার সমস্যা টা কি? আপনার কি কোনো প্রেমিক আছে? মানে আপনি কি কাউকে ভালোবাসতেন?

- কি হলো ? কিছু বলছেন না যে? এই মাত্র তো এত বড় বড় কথা বলছিলেন। এখন আবার মুখে কুলুপ এঁটে আছেন যে বড়?

মধুরিমা , এবার অমিত এর দিকে কটমট করে তাকিয়ে ঝেরেমেরে খাট থেকে নেমে , বলতে থাকলো, 

- হ্যা, অফকোর্স আমি একজনকে ভালোবাসতাম। ইনফ্যাক্ট এখনো বাসি।

- তাহলে আমায় কেন বিয়ে করলেন?

- দেখুন , আমি রাজ কে ভালবাসি। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। কিন্তু ও আমায় ছাড়াও অনেক মেয়ের সাথে ডেট করে, আমি এগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু রাজ বলতো এইগুলো নাকি আজকাল কার কমন ব্যাপার। ও একটু আধটু ডেট এ গেলেও ভালো নাকি শুধু আমাকেই বাসে। কিন্তু আমি এইসব সহ্য করতে না পেরে ওর সাথে খুব ঝগড়া করে ব্রেকাপ করে দিই। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ভেবেছিলাম ও নিজের ভুল বুঝে ঠিক আমার কাছে ফিরে আসবে । কিন্তু....

এবার মধুরিমাকে থামিয়ে অমিত বলতে থাকলো,  তারপরের ঘটনা ঠিক এইরকম তাই তো, তুমি জেদের বসে, মা বাবার পছন্দ করা পাত্রে র সাথে বিয়ে করে নিলেন কি  আমি ঠিক বললাম তো।

মধুরিমা চোখের জল মুছে কোনো কথা না বলে অমিত এর কথার সম্মতি জানালো।

অমিত সবটা শুনে ঠান্ডা মাথায় বললো, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি আপনার সাথে কোনো দিন ও খারাপ আচরণ করবো না। আপনার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবো না। আপনার কাছে স্বামীর দাবি জারি করবো না। শুধু আপনার কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট আপনি প্লিজ এই রুম থেকে আলাদা থাকবেন না। আমরা যদি আলাদা আলাদা রুমে থাকি আমার মা, বাবার চিন্তা বাড়বে। ওনারা বড় আশা নিয়ে এই বিয়েটা দেখে শুনে দিয়েছেন। আমরা একই রুমে থাকবো কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না। আমি রুমের ওই সোফা টায় শোব। আপনি খাটে। আর হ্যা, লোক সমাজে বাইরে আমি আপনাকে তুমি বলেই সন্মধন করবো আপনিও যদি দয়া করে আমায় তুমি বলেই,

- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে , খানিক টা বিরক্তির সুরে মধুরিমা।

অমিত নিজের খেয়াল এ একটু হেসে নিজের কপাল কে দোষারোপ করে শুয়ে পড়লো সোফায়। 


এই ভাবেই কেটে গেল মাস তিনেক। বাইরের লোক এমনকি মধুরিমার শশুর শাশুড়ি ও ভাবতেন তারা হয়তো দাম্পত্য জীবনে খুব সুখী। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল ঘোর ব্যবধান। এরই মধ্যে একদিন অমিত এর মা, বাবা সংসারের দায়িত্ব দিয়ে কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে পরলেন উত্তর ভারত ভ্রমণে। মধুরিমার হাত এ তখন সংসারের দায় ভার। সময় টা তখন কার্তিক এর শেষ। এতদিন শাশুড়ি মা বাড়ি থাকায় মধুরিমাকে ভোর বেলা উঠে অমিত এর জন্য  অফিসের টিফিন করতে হত না। মধুরিমার শাশুড়ি ই বৌমা কে  করতে দিতেন না। বলতেন কাজ করার স্বামী সেবা করার অনেক সময় আছে। সময় তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন আমি পারছি করছি। যখন আমি পারবো না তখন করবি। তাই মধুরিমাও একটু বেলা করে উঠত। কিন্তু এখন চাপে পরে ভোর ভোর উঠে কাজ করতে হচ্ছে। তাই ঠান্ডা লেগে মধুরিমার জ্বর এসে গেল । এত জ্বর এ মধুরিমা প্রায় দুই দিন ঘোরের মধ্যে কাটাল। অমিত অফিস কামাই করে, সারারাত জেগে মধুরিমার সেবা করল। সময় মতো ওষুধ খায়ানো থেকে শুরু করে, গরম সুপ করে খাওয়ানো সব টা একা হাতে সামলেছে। দুদিন পর মধুরিমা একটু সুস্থ হয়ে ওঠে। কাজের দিদি মধুরিমার মাথা ধোয়াতে এসে মুধুরিমার কাছে অমিত এর অনেক গুনগান করে।

-এই দুদিন তুমি যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে না দিদিমণি , কি বলবো। এইদিকে মাসিমা, মেসো ও বাড়ি নেই। দাদাভাই একাই সব টা সামলেছে। সত্যি ই তোমরা সাক্ষাৎ হর পার্বতীর জুটি। মধুরিমা মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে থাকে কাজের দিদির কথা গুলো।

- জানো দিদিমণি, এই দুদিন অমিত দাদা তোমায় সারারাত জেগে জল পট্টি দিয়েছে। সময় মতো ওষুধ দিয়েছে। আমায় তোমার রান্না টা করতে দেয় নি। তোমার জন্য আলাদা সুপ,  স্টু অমিত দাদাই করেছে। শুধু আমায় বলতো...

- কি হলো থামলে কেন? বলো শুধু কি? 

মধুরিমা একরাশ কৌতূহল নিয়ে রুগ্ন শরীরে উত্তেজিত হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে।

- আহ! এই সময় এইরকম ঝেরেমেরে কেউ ওঠে? এখনি মাথা ঘুরে যেতে পারতো। আর এক কেলেঙ্কারি র সৃষ্টি হত।

- আমি ঠিক আছি গো দিদি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তুমি বল না , যে কথাটা বলতে বলতে থেমে গেলে?

- আরে বলছি, দাদা বাবু সব কিছু নিজে করেছে। আর শাড়ি , ব্লাউজ খুলিয়ে তোমায় একটু শরীর টা স্পঞ্জ করে দেওয়ার জন্য আমায় বলতো। বলি, এতদিন বিয়ে হয়ে গেল এখনো দাদাবাবুর শরম গেল না। 

বলে ফিকফিক করে হাসতে লাগলো।


এরপর মধুরিমা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এল। দিন এগোতে চলল আবার চেনা নিয়ম এ। এখন আর রাতের সময় চোখ বুজলে আর রাজ এর অবয়ব ভেসে ওঠে না মধুরিমার চোখে। তার সব টুকু দৃষ্টি, অন্তর জুড়ে এখন অমিত এর বাস।এখন অমিত এর জন্যই মন টা সব সময় ছটফট করে। অমিত অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর অপেক্ষায় ঘড়ির কাঁটা গোনে মধুরিমা। অমিত ফোনে কথা বললে ওর রাগ হয়। মধুরিমা বুঝতে পারে ওর সমস্ত হৃদয় জুড়েই এখন অমিত বিরাজ করছে। সেখানে রাজ এর ছায়া টুকুও নেই। মনে পড়ে না ওর স্মৃতি। শুধু ভেসে ওঠে অমিত। মধুরিমা একদিন ঠিক ই করে ফেলে ওর মনের কথাটা বলেই ফেলবে অমিতকে। 


সেইদিন অমিত অফিস বেরিয়ে গেলে মধুরিমা অপটু হাতেই অমিত এর ফেবারিট ডিশ মাটন বিরিয়ানি, আর চিকেন চাপ তৈরি করে ইউটিউব দেখে। অমিত অফিস থেকে ফিরলেই ওকে যত্ন করে খেতে দেয়। এই স্পেশাল মেনু গুলো মধুরিমা প্রথম করলেও রান্নাটা কিন্তু অসাধারণ হয়েছিল। অমিত নিজে মুখে তো তারিফ করেইছিল। আবার মনে মনে ভাবছিল মধুরিমা কিন্তু দারুন রান্না করে। আসলে রান্নাটা মধুরিমা খুব ভালোবেসে করেছিল। তাই ভালো হয়েছিল। যে কোনো জিনিসই মন দিয়ে ভালোবেসে করলে ভালো হবেই। 


রাতে শুতে এসে অমিত সোফায় শুয়ে লাইট নেভালো। মধুরিমা নিজের মনের কথাটা বলবে বলবে করেও বলতে পারছিল না। বিছানায় শুয়ে খালি এপাশ ওপাশ করছিল। কিছুক্ষণ পরেই মধুরিমা খাট থেকে উঠে অমিত এর সোফার কাছে এসে দাঁড়াল। 

- ঘুমাও নি কেন কিছু বলবেন?

অন্ধকারে অমিত এর গলার আওয়াজ এ চমকে উঠলো মধুমিতা।

- না, তেমন কিছু না। আসলে আজকে ভীষণ ভয় ভয় লাগছে কেন জানি না। তাই আর কি?

- তাহলে আর কি চলুন আজ সারা রাত জেগে গল্প করেই কাটিয়ে দেওয়া যাক। 

- না, মানে আপনাকে একটা কথা কদিন ধরে ভাবছিলাম বলবো বলা হয়ে উঠছে না। 

- হ্যা, কি কথা বলুন। 

- মানে , আমি আপনাকে....মানে তোমাকে?

- কি বলুন 

মধুরিমা চোখ বুজে ছিল । কিছু বলতে পারছে না।

হটাৎ লাইট টা জ্বলে উঠলো আর অমিত বললো, আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমাকে মন দিয়ে ফেলেছেন।মানে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন কি তাই তো ?

মধুরিমা সঙ্গে সঙ্গে অমিত কে জড়িয়ে ধরলো।

অমিত ও মধুরিমাকে। 

- আমি জানতাম মধুরিমা আপনি একদিন ঠিক আমায় ভালোবাসবেন । একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এ বিশ্বাস আমার ছিল। কারণ আমরা যে সাতপাকে ঘুরে অগ্নিকে সাক্ষহী রেখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এ যে উপরওয়ালার সৃষ্টি মধুরিমা । আপনাকে যে আমার কাছে ফিরে আসতে হত

ই।

-আমি তোমায় খুব ভালোবাসি অমিত। তুমি?

- আমিও। আর সারাজীবন এই ভাবেই আগলে রাখবো তোমায় মধু।

- এই, এবার আমার মধু বলার অধিকার হয়েছে তো?

মধুরিমা , অমিত এর গালে হালকা চুমু দিয়ে বলে হয়েছে মশাই। মধু বলে ডাকার অধিকার শুধু তোমারই থাকবে আজীবন বুঝলে? 

রাত ফুরিয়ে ভোর এর আলো ফুটে উঠলো একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে একটা নতুন সকাল, নতুন জীবনে পা রাখলো অমিত মধুরিমা। ওদের বিবাহিত জীবন খুব সুখের হোক এই কামনা করি।


সমাপ্ত


আজকের ব্লগটা এই পর্যন্তই । দেখা হচ্ছে আগামী কাল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ