পণের বলি (sacrifice)

 


Sacrifice

পলাশপুর। একট প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে আনিশা। বাবা, মা, আর এক দাদা। এই ছিল তাদের সুখের সংসার। গ্রামের মেয়ে আনিশা বাবা, মা দাদার অত্যন্ত আদরের মেয়ে সে। আনিশার ছোটবেলাটা খুব মজার,খুব আনন্দের সাথেই কেটেছিল। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই স্কুলে যেত। আনিশার বাবা ছিলেন একজন গরিব চাষি। এই পলাশপুর এর প্রায় সকলের অবস্থায় ই একইরকম। ওই দিন আনি দিন খাই। বছরে একবার ধান হয়। একবার আলু। তার ওপর নির্ভর করে এখানকার সংসার। আনিশা র দাদা রিহামত খুব বেশি পড়াশোনা করে নি। ক্লাস সিক্স এ পড়তে পড়তেই পড়া লেখা শেষ করে বাবার সাথে চাষের কাজে লেগে পরে। সংসারের হাল কাঁধে নেওয়ার তাগিদে। রিহামত পড়াশোনাতেও খুব একটা ভালো ছিল না। তবে আনিশা পড়াশোনা তে ছোট থেকেই খুব মেধাবী ছিল। রিহামত আর ওর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আনিশা কে তারা অনেক দূর পড়াশোনা করাবে। মানুষের মতো মানুষ করবে। পলাশপুর এর কোনো মেয়ে মাধ্যমিক এর বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ পেত না। কারণ এখানে মাধ্যমিক অবধি ছিল স্কুল টা। এবার উচ্চশিক্ষা র জন্য তাদের বাইরে পড়তে যেতে হত। যেহেতু পলাশপুর ছিল অনুন্নত একটা গ্রাম, তাই এখানকার মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করা টাকেও বাঁকা চোখে দেখত।



হাসতে খেলতে আনিশা প্রাইমারী র গন্ডি পেরিয়ে বড় স্কুলে ভর্তি হল। ততদিনে রিহামত একজন চাষি। এছাড়া রিহামত রোজ অনিশাকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করত।বড্ড বেশি ভালোবাসতো তার বোনকে । আনিশার আরো কয়েক বছর যেতে না যেতেই আনিশা যখন সেভেন, এইট এ উঠলো তখন থেকেই ওর এক একটা সহপাঠিনি র বিয়ে হতে থাকলো। অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকে আবার এটাই প্রকৃতির নিয়ম ভেবে কিংবা এটাই ভবিতব্য মনে করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ত। পলাশ পুর গ্রামের আসে পাশেও আর তেমন স্কুল ছিল না। আসে পাশের গ্রাম থেকেও এইখানেই সবাই পড়তে আসত। স্কুল টি মাধ্যমিক অবধি হলেও মেয়ে রা কেউ অত ক্লাস ও পড়ার স্বাধীনতা পেত না। অনিশাই ছিল সেই মেয়ে যে প্রথম ওদের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে। আনিশার মায়ের ও ইচ্ছা ছিল আর পাঁচটা মেয়ের মত তার বিয়ে দিতে। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছিল রিহামত। আনিশা আমাদের গলার কাঁটা নয় মা আমাদের বাড়ির লক্ষহী। ও গুনে সরস্বতী। ওকে আমি অনেকদূর লেখাপড়া শেখাব। দেখবে মা ও একদিন অনেক বড় হবে। এই পলাশ পুর গ্রামে র ডাক্তার হয়ে আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে। এই গরীব মানুষ গুলোর পাশে এসে দাঁড়াবে। আমার যে ওকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন মা ।


রিহামত এর কথা থামিয়ে আনিশা কাঁদ কাঁদ হয়ে বলে আমি ডাক্তার হতে চাই না দাদা। আমি শিক্ষিকা হতে চাই। বোনের মুখে একথা শুনে বলে আরে, ঠিক আছে রে বোন। তুই যা হতে চাইবি তাই হবি। এখানে শিক্ষিকা রও তো খুব অভাব। তুই দিদিমণি হয়ে এসে মেয়েদের পড়াশোনার গুরুত্ব টা এদের আরো বোঝাতে পারবি। আমি জানি তুই পারবি। তুই ঠিক পারবি বোন দেখে নিস। 


এরপর আনিশা উচ্চ শিক্ষা র জন্য কলকাতায় চলে আসে। আনিশার কাকা কলকাতায় থাকে। কলকাতায় থেকেই সে পড়াশোনা টা চালিয়ে যায়। আনিশার কাকাও অনিশাকে খুব ভালোবাসতেন। আনিশা যেহেতু কলক্বতায় চলে আসে এখানে আসার সূত্রে অনিশার বাবা , মায়ের ও যাতায়াত বারে। দেখতে দেখতে আরো দুটো বছর পার হলো। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে দিল আনিশা। 


একদিন আনিশার কাকার কাছে একজন ঘটক আসেন সুপাত্রের সন্ধান নিয়ে। তখন অনিশার বাবা, মা ও কলকাতাই ছিলেন। ভালো ছেলে ছোট পরিবার এই দেখে শুনে আনিশার বাবা, মা র খুব পছন্দ হয়ে যায়। প্রথম দেখাতে সুপাত্র অলকেশ কে দেখেও আনিশার পছন্দ হয়ে যায়। আসলে কৈশোর পেরিয়ে যুবতী আনিশার মনেও তখন প্রকৃতি র নিয়মে ভালোবাসার ছোঁয়া লাগে। পাত্র পক্ষের সম্মতিতে ই আনিশার কলেজে পড়াশোনা করানোর অনুমতি নিয়েই বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় অলকেশ আলিশার। 


বিয়েতে বর পক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ই নগদ দুই লক্ষ টাকা, ছয় ভরি সোনা দেওয়া হয় আনিশার বাড়ি থেকে। এই জন্য তাদের জমি বন্দক দেওয়াও হয় । সুখের সংসারের উদ্যেশে, চোখে এক রঙিন স্বপ্ন এঁকে নতুন জায়গায় পাড়ি দেয় আনিশা। কিন্তু এই স্বপ্ন তার সফল হয় নি।


বিয়ের এক মাসের মধ্যেই ঝরে যায় এক সম্ভবনাময় প্রাণ। জীবন যুদ্ধে হেরে যায় আনিশা। শেষ হয়ে যায় আনিশা র জীবন।


বিয়ের পর থেকেই আনিশার শশুর, শাশুড়ি, ননদ এমনকি ওর স্বামীও ওর সাথে অকথ্য অত্যাচার চালায়। সব কাজ ঘাড়ের উপর ঘাড়ের উপর দিয়ে ওর জীবন টাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। কথায় কথায় উঠতে বসতে আরো টাকার দাবিতে তাকে খোটা দেয়। সমস্ত রান্না বান্না তাকে দিয়ে করিয়ে শুধু অল্প টুকু ভাত দিনের শেষে তাকে খেতে দিত তারা। বর ও তার পক্ষে ছিল না।

কলেজে পড়াবে বলেছিল। কিন্তু পড়াশোনার কথা তুললতে ই তাকে মারধর করা হয়। 


রিহামত আনিশার শশুর বাড়ী পুজোয় তত্ত্ব নিয়ে গেলে তাকে সাফ জানানো হয় আরো নগদ ৫ লাখ টাকা আর একটা ফ্লাট না দিলে তাদের মেয়েকে তারা তাড়িয়ে দেবে। রিহামত এর মাথায় আগুন জ্বলে যায়। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলে আপনাদের কথা মতো সব দিয়ে বিয়ে দিয়েছি জমি বন্দক দিয়ে আর আমাদের পক্ষে দেওয়া কিছু  সম্ভব নয়। তার প্রত্যুত্তরে আনিশা কে তারা বলে তাড়িয়ে দেবে। রিহামত ও নিয়ে চলে যেতে চায়। কিনটু আনিশা রাজি হয় না। ও আর একটু মানিয়ে নিতে চায়।


কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনিশা মানিয়ে নিতে পারল কওই। এক শীতের রাতে রিহামতের ফোনে ফোন করে অলকেশ বলে আপনার বোন সুইসাইড করেছে। শেষ হয়ে যায় আনিশা। হাতের শিরা কাটা ও গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় আনিশার নিথর দেহ পাওয়া যায়। যদিও আনিশার বাড়ির দাবি আনিশা শান্ত ভদ্র মেয়ে ওর পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। ওকে খুন করা হয়েছে। শশুর বাড়ী র লোকজন ও পালিয়ে যায়। আনিশার বর ওকে বলেছিল মরে যাওয়ার কথা।


ঘটনাটা সত্যি। আমি শুধু স্হান, কাল, নাম বদলেছি। আনিশা যদি সেইদিনই দাদার কথা শুনে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। বেঁচে যেত একটা প্রাণ। আসলে মেয়েরা কখনোই চায় না একটা সাজানো সংসার ভাঙতে, ধরে রাখতে চায়। অনিশাও চেয়েছিল তাঁর সংসারটা বাঁচাতে কিন্তু পারলো কৈ। হেরে গেল।


আজ এই পর্যন্ত ই। আমার ব্লগ ভালো লাগলে সাবস্ক্রাইব করুন প্লিজ। শুভ রাত্রি সকলে ভালো থাকবেন। আগামীকাল বাবার বাড়ি যাবো তাই গোছ গাছ করবো। একটু ব্যস্ত কাল আসব ব্লগ নিয়ে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ