- জানতো এই মুকুটপুর জায়গাটা ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস টা এখানেই পেয়েছিলাম। আর সেটা হলো ভালোবাসা। তাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে এখানেই।
- আমি তো শুনলাম এই একটু আগে তুমি বললে তোমরা এই কিছুদিন হলো এখানে এসেছ?
- হম! কিন্তু আমার ছোট বেলাটা কেটেছে এখানেই। ক্লাস নাইন অবধি আমরা এখানেই ছিলাম। তখন আমার বাপির এখানেই পোস্টিং ছিল। তারপর বাপির আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এলো। আমরা আবার কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলাম।
আমি তখন এখানেই একটি সরকারি গার্লস হাই স্কুলে পড়তাম। স্কুল যাওয়ার পথে আমায় একটা আমবাগান এর ভিতর দিয়ে রাস্তা ছিল সেটি পেরিয়ে স্কুল যেতে হত।প্রত্যেকদিন দেখতাম একটি ছোট গাছের ডালে একটি করে চিঠি সুতো দিয়ে বাঁধা থাকতো। আমি ঐ গাছটার তলা দিয়ে গেলেই চিঠিটা দেখতে পেতাম। আর তারসাথে সাইকেল এর বেল এর আওয়াজ শুনতে পেতাম। প্রথম কয়দিন ব্যাপারটা আমি পাত্তা দিই নি। কিন্তু আমারও ওই চিঠি টার প্রতি কৌতুহল ছিল। একদিন স্কুল যাওয়ার পথে দেখি সেইদিন ও একটি চিঠি ঝুলছে। সাথে সাইকেল এর বেল এর আওয়াজ। আমি ভরসা করে চিঠিটা খুলতেই দেখি চিঠি তে লেখা আছে....
- কি লেখা ছিল?
- লেখা ছিল তিন্নি আমার তোমাকে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু তোমার সামনাসামনি আমি কখনোই আসতে পারবো না।
আমার পড়া প্রথম চিঠি ওটাই ছিল। আমি তো রীতিমতো চমকে গিয়েছিলাম। চিঠি গুলো যে আমাকেই লেখা হত আমি ভাবতেই পারি নি প্রথমে। আমার নাম টা দেখে আমার বুকের ভিতর টা ধড়াস করে উঠেছিল। সদ্য যৌবনে সেই প্রথম আমি প্রেমপত্র পেয়েছিলাম। তখন এখনকার মত এত ফোন নম্বর, ফেসবুক , হোয়াটস আয়াপ ছিল না। এরপর আমি প্রতিদিন ই যখন স্কুল যাওয়ার পথে ওই চিঠি পেতাম। সাথে ওই সাইকেল এর বেল এর আওয়াজ। কিন্তু সেই মানুষটিকে কখনো দেখতে পাই নি। চিঠির লেখা গুলো ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। কিন্তু চিঠির প্রতিটা লাইন আমার মনকে ছুঁয়ে যেত। আমার হৃদয়কে তোলপাড় করে দিত। আমিও তারপর পাল্টা চিঠি ওখানে বেঁধে দিতাম। কতবার ওকে চিঠিতে লিখেছি কাছে আসার জন্য ও আসে নি।
তিন্নি আর সেই ছেলেটি হাটতে হাটতে অনেকটাই চলে এসেছিল। তারপর তিন্নি কথা বলতে বলতেই চিৎকার করে বলে ওই তো আমার ফ্রেন্ডস রা। ছেলেটি দেখে কয়েকটি ছেলে মেয়ে তিন্নিকে দেখতে পেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ।
- তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তিন্নি? তোমায় না ফোনে পেয়ে আমার যা অবস্থা টা হচ্ছিল। তুমি বুঝবে না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে আহ্বান। এই তো আমি এসে গেছি। আমি ঠিক আছি। ।
সেই ছেলেটিকে উদেশ্য করে তিন্নি সবাইকে বললো এটা আমার নতুন বন্ধু। রাস্তায় দেখা হলো। ওর জন্যই তোমাদের খুঁজে পেলাম আহ্বান। আহ্বান অনেকটা অনিচ্ছাকৃত সত্ত্বেও ছেলেটির সাথে হাত মেলাল। আর বাকিরাও হাসি মনে ছেলেটিকে তাদের দলে ওয়েলকাম করলো।
তারপর ছেলেটি ওদের বললো, তোমাদের এত রিস্ক নিয়ে হেঁটে হেঁটে এতদূর আশা উচিত হয় নি। আমি এখানেই থাকি আমি কি তোমাদের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব?
- হে, আমাদের গাড়ি আছে। আমি বললে তিন - তিনটে গাড়ি এখনি চলে আসবে। বেশ ঝাঁজের সাথে তিক্ততা নিয়ে আহ্বান বললো।
- সরি ভাই। আসলে জায়গাটা খুব একটা ভালো না। তাই বলছিলাম।
ছেলেটির সাথে এবার তিন্নি দের দলের সব ছেলে - মেয়েরা সহমত পোষণ করলো। তাছাড়া এতটা হেঁটে এসে আর হেটেই ফিরে যাওয়ার মতো তাদের মানসিক কিংবা শারীরিক কোনটারই অবস্থা ভালো ছিল না।
ছেলেটি অনেক কষ্টে ফোন এর নেটওয়ার্ক এনে ফোন করে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল ওদের। গাড়ি আধা ঘন্টার মধ্যে চলে এলো। বাকিরা স্বাচ্ছন্দে গাড়িতে উঠে বসলেও আহ্বান এর চোখে- মুখে তখন ও বিরক্তির ছাপ।
- ওরে তোর হবু বর কে এতক্ষন আমরা সামলেছি। এবার তুই সামলা তিন্নি। এই বলে পিউ তিন্নিকে জোর করে আহ্বান এর পাশে বসিয়ে দিল। ছেলেটি আড় চোখে দেখে নিল আহ্বানকে। তিন্নি ছেলেটির সামনে বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। শহরে ওদের কোয়ার্টার এর সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। ছেলেটিকে অনেক বার তিন্নি সহ ওর বন্ধুরা তিন্নিদের কোয়ার্টার এ আসার অনুরোধ করলেও ও গেল না। ছেলেটিকে বিদায় এর সময় তিন্নি বললো, কি নামে ডাকবো বলো তো তোমায়?
- ওই যে বলেছিলাম আগন্তুক।
- বেশ, আগন্তুক আমার তো তোমায় আমার জীবনের কাহিনীটা সবটা বলা হলো না।
- কিছু কথা না হয় অসম্পূর্ণই থাক।
- না, আমি তোমায় সব কিছু বলতে চাই । প্লিজ আমায় একটা সুযোগ দাও। তোমার ফোন নম্বর টা দাও প্লিজ।
- না তা হয় না।
- তাহলে একবার দেখা করবে আগন্তুক?
- বেশ।
- কোথায় বলো?
- তুমি যেখানে বলবে?
- আমি তো এখানকার কিছুই তেমন চিনি না। ওই সামনেই একটা ঝিল আছে। কাল বিকালে একবার দেখা করবে?
- ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
এই বলে আগন্তুক চলে গেল।
তিন্নি কিছুক্ষন ওর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখলো। ওর মনে হলো ওর জীবন থেকে কি যেন একটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অস্থির মনে হতে থাকলো। কিন্তু একদিনের ক্ষণিক এর পরিচয় এ একটা ছেলে কেন ওর মনে এতটা দাগ কেটে গেল ও বুঝতে পারলো না। আনমনে ছেলেটির চলে যাওয়ার দিকে দেখতেই থাকলো।
- আরে, তিন্নি চলো রুম এ চলো- একটা চটক দার ভারী গলার আওয়াজ এ তিন্নির ঘোর কাটলো।
- হ্যা, আসছি চলো।
সারারাত তিন্নি ভালো করে ঘুমোতে পারলো না। বার বার ছেলেটির কথা মনে পড়তে লাগলো। ঘুম না আসায় একলা রুমের আলোটা জেলে ও আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কোনো এক অদৃশ্য তিন্নি ই যেন তিন্নি কে বলছে তোর তো আর কয়েকদিন পরেই আহ্বান এর সাথে বিয়ে। তাহলে একদিনের পরিচয় একটা ছেলেকে নিয়ে তুই এত কেন ভাবছিস? তিন্নির সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। বেসিন এর সামনে গেল। চোখে মুখে জল দিয়ে বেসিন সংলগ্ন আয়নার সামনে মুখ টা দেখতেই ওই আয়নায় আবার ছেলেটির মুখ টি ভেসে উঠলো। তিন্নি ভয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু না! পিছনে তো কেউ নেই। তিন্নি মনে মনে ভাবল আমার সাথে এইরকম কেন হচ্ছে। আমি না চাইতেও আমার ভাবনার মধ্যে ছেলেটি কেন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। তিন্নি আগামী কাল বিকেল এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।
ঝিলের ধারে সেই ছেলেটি ঠিক সময়ই পৌঁছে গিয়েছিল। তিন্নি এসে দেখলো ছেলেটি তখন এসে গেছে।ছেলেটিকে দেখে গতকাল কের মতোই তিন্নি আবার খুশি হয়ে গেল । ওর সামনে এসে বেশ মিষ্টি সুরে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল তিন্নি
- কখন এলে?
-এই একটু আগে। কেন দেখা করতে চাইলে বলো?
-তোমার কি খুব তাড়া- মনের ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে তিন্নির গলা থেকে বেরিয়ে এলো।
- না । বলো।
- আমার কালকের অসম্পূর্ণ কাহিনীটা তোমার কাছে পুরোটা শেয়ার করতে চাই।
- হম। বলো
- জানো তো আমিও ওকে চিঠি দিতাম। ওকে একটি বার দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ওই আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা।
- আর যার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে ওই আহ্বান! আহ্বানকে তুমি ভালোবাসো না?
- বাড়ি থেকে ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
- বুঝলাম।
- ওর সেই চিঠি গুলো এখনো আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে। তারপর একদিন আমার বাপির বদলির অর্ডার আসে। আমরা এখান থেকে চলে যাই। যাওয়ার আগে একটিবার আমার সাথে ওকে অনেক করে দেখা করার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু ও আমার অনুরোধ রাখে নি। ও সামনে আসতে নাকি ভয় পায়। যদি আমি ওকে পছন্দ না করি এই ভয়ে। কতবার আমি ওকে বলেছি আমি তোমায় ভালবেসে ফেলেছি । তুমি প্লিজ সামনে এস। ও আসে নি। কথা রাখে নি। তিন্নি কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। এইভাবেই আমাদের সম্পর্ক টা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমি না দেখেই ওকে ভীষণ ভালো বেসে ফেলেছিলাম । আজ ও ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
- ভালোবাসা এইরকম ই হয় তিন্নি। ভালোবাসা রুপ দেখে হয় না। দুটি মনের মিলন ই ভালোবাসা। কিন্তু তোমার অতীতকে ভোলানোর জন্য তোমার সামনে তো বর্তমান এসে গেছে তিন্নি। আহ্বান তোমায় ভালবাসে। তোমার বাড়ি থেকে ওর সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। দেখো তুমি সুখী হবে। আমি যাওয়ার আগে তোমায় একটা গিফট দিতে চাই তিন্নি।
ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর ছোট বক্স বের করে তিন্নির হাতে দিল ছেলেটি।
কি আছে এতে - অবাক হয়ে তিন্নি বললো
খুলেই দেখো। এই বলে ছেলেটি চলে গেল।
তিন্নি হা করে তাকিয়ে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর তিন্নি বাক্স খুলে দেখলো, তাতে বেশ কয়েকটি চিঠি আছে।
তিন্নি একে একে খুলে দেখলো এইগুলি তারই দেওয়া চিঠি।
আর কিছু চিঠি যা তিন্নির কাছে পৌঁছায় নি শেষ পর্যন্ত নিলয় এর লেখা।
তিন্নি আমি আজ ও তোমায় ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি। এত গুলো বছর পর যখন শুনলাম তোমরা আবার এখানে এসেছ। আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জানলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তুমি ভালো থেকো তিন্নি। আমি ই সেই হতভাগা নিলয়। খুব ভালোবাসি তোমায়। আমার প্রাপ্য শ্রেষ্ঠ পাওনা তো আমি পেয়েই গেছি তিন্নি। তোমার মন থেকে আমি কখনো মুছে যাব না আমি জানি। এইটুকু সান্তনা নিয়েই আমি চলে গেলাম আবার অন্তরালে। হয়তো চিরদিনের জন্য।
নিলয়! তুমি ই আমার নিলয়। তিন্নি চিঠি গুলো আগলে খুব কাঁদতে থাকলো।
- এতগুলো বছর তোমার চিঠি গুলো নিয়েই তো বেঁচে ছিলাম। সামনে যখন এলে ধরা কেন দিলে না নিলয়? আমি যে তোমায় খুব ভালোবাসি নিলয়। তুমি আমার সাথে এটা করতে পারলে নিলয়? আমি তোমায় কোথায় খুঁজবো নিলয়? নিলয় প্লিজ ফিরে এসো নিলয়। তিন্নির হাতে থাকা নিলয় এর লেখা সেই চিঠি খানা আগলে তিন্নি বসে রইল, অপেক্ষায়। গভীর অপেক্ষায়।
সমাপ্ত
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ