এইদিকে বিনু পিসির বিবাহের জন্য জোরকদমে দেখাশোনা শুরু হয়ে গেল। জমিদার বাড়ির কন্যা তায় লেখাপড়া, গান- বাজনা তে পারদর্শী। এরূপ মেয়ের তো আর যে সে ঘরে বিয়ে হতে পারে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঠিক হলো শিব গঞ্জের নব ঘোষাল এর ছোট ছেলে অমর জিৎ এর সাথে বিনু পিসির দেখাশোনা হবে। দেখাশোনা তে বিনু পিসি বসেছিল। তখন তো বিনুপিসির মনের খবর কেউ জানত না। এমনকি বিজন বাবু ও না। বিনু পিসি চাইলেই আমার বাবা , জেঠু- জেঠিমা কে অর্থাৎ বিনু পিসি ওর দাদা বৌদিকে বলতেই পারতো। কিন্তু বলে নি। জানতো এটা ওনারা কিছুতেই মেনে নেবেন না। সদ্য যৌবনে প্রস্ফুটিত ফুলের চাওয়া পাওয়ার দিকে ধ্যান তখন কেউই দেয় নি। নব ঘোষাল বাবু রাও ছিলেন জমিদার। তখনও ওদের জমিদারি ব্যবস্থা আগের মতই। তাই অমর জিৎ এর মত জমিদার ছেলেকে হাত ছাড়া করতে চায় নি আমার দাদু। একসময় দেখাশোনা ফাইনাল হয়ে বিয়ের ঠিক ও হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের আর মাত্র পাঁচ - ছয় দিন বাকি। বিজন বাবু প্রতিদিন এর মতোই সেদিন ও বিনুকে গান শেখানোর জন্য বিনু দের বাড়ি ঢুকেছিলেন।
- ওহে, বিজন যে....একটা হুঙ্কার দেওয়ার মতো খুশির গর্জনে বিজন বাবু পিছনে তাকিয়ে দেখেন আমার জেঠু হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে আসছেন।
বিজন বাবু একটু থমকে দাঁড়ালেন।
- আরে, বিজন গান শেখাতে এলে বুঝি বিনুকে?
- হ্যা দাদা।
- আজকেই এই বাড়িতে তোমার শেষ চাকরি।
ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকিয়ে কৌতূহলী চোখে বিজন বাবু আমার জেঠুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
- আরে, বিজন তেমন কিছু ব্যাপার না। তোমার গান শেখানো নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আসলে আর কয়দিন বাদেই তো বিনুর বিয়ে হয়ে যাবে। তাই আর কি বলছিলাম।
এ কথা বলে বিজনবাবুর ঘাড়ে হাত রেখে জেঠু চলে যাচ্ছিলেন, আবার ঘুরে এসে বললেন হ্যা বিজন নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠাবো কিন্তু চলে আসবে।
( ছোটগল্প/ সামাজিক গল্প)
বিজনবাবুর নিজের অজান্তেই চোখ দুটো যেন ঘোলাটে হয়ে এলো। মেঘের মতো অন্ধকার নেমে এলো বিজনবাবুর জীবনে।
অতি কষ্টে সেদিন ঘরে ঢুকে দেখলেন বিনু চুপচাপ মুখ নিচু করে বসে আছে।
- কি হলো বিনু আজ বাদে ক- দিন বাদে শশুর ঘর যাবে, তাই বুঝি তোমার মন খারাপ?
বিজন বাবুর এইরূপ কথায় ভারী আশ্চর্য হয়ে বিনু বিজন বাবুর চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলেন। দুচোখ এ তখন জল টলটল করছে।
বিনুর চোখে জল দেখে বিজন বাবু বললেন, - একি তুমি অমন ভাবে কাঁদছো কেন?
- যে এতদিনে মনের ভাষা বোঝে নি সে আজ ও আমার চোখের ভাষা বুঝবে এইরকম আশা করাটা আমার ঠিক হয় নি।
মুহূর্তের মধ্যে বিজন বাবু তার নয়ন জোড়া নামিয়ে ফেললেন।
- কি হলো একবার বলুন তো আপনি আমায় ভালোবাসেন না? লজ্জার মাথা খেয়ে এত গুলো দিন পর আমায় কথাটা বলতেই হলো। আপনি তো একটা কাপুরুষ। নিজের ভালোবাসার কথা ভালোবাসার মানুষটি র কাছ থেকেও এতদিন আড়াল করে রেখেছিলেন। একবার আমার হাতে হাত ছুঁয়ে বলুন না স্যার , আপনি ও আমায় ভালোবাসেন?
বিজন বাবু ভেঙে পড়লেন, নিজের হাত এর তালুখানি মুঠো করে শক্ত করে দু- চোখ বন্ধ করে বললেন -ভালোবাসি বিনোদিনী, আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমি যে নিরুপায় বিনু। এ তো সম্ভব না। কেউ তো এই সম্পর্ক মেনে নেবে না।
- নাই নিক। আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমায় বিশ্বাস করি। আমি তোমার সাথে পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি । তবু আমি এখানে বিয়ে করবো না। আর যদি তুমি আমায় না বিয়ে করো তাহলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না আমার। আমি শুধু এই মন প্রাণ দিয়ে এতদিন তোমায় ভালবেসেছি। আমি তোমাকে ছাড়া অননকাউকে বিয়ে করতে পারবো না।
- ভালোবাসি বিনু, আমিও তোমায় খুব খুব ভালোবাসি।
এই ভাবেই কোনো এক সন্ধ্যায় দুটি হৃদয় একাকার হয়ে ছিল। সেইদিনই রাতের বেলা কাউকে কিছুটি না জানিয়ে দুঃসাহস এ ভর দিয়ে বিনু পিসি পালিয়ে গেল অজানা সুখের ঠিকানায়।
পরের দিন ই চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব পরে গেল। প্রথম দিকটায় খুব আড়াল করে খোঁজা হচ্ছিল। পাছে যদি গ্রাম বাসীরা এই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা রটিয়ে দেয় তাহলে বিনু পিসির ওই জমিদারের বাড়ির বিয়েটা বাতিল হয়ে যাবে। আমাদের বাড়ির কেউই তখন ও বিজন বাবুকে সন্দেহ করে নি।
(ছোটগল্প)( short story)
এদিকে বিজন বাবু ও বিনু পিসি মন্দিরে বিয়ে করে। একথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সারা পাড়া ঢি ঢি পরে যায়। বিনু পিসিকে আমাদের বাড়ির লোকেরা বিজন বাবুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। ততক্ষনে তাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বিনু পিসি স্বামীর অধিকার নিয়েই বিজন বাবুর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- প্রতাপ বাবুকে ( বিনু পিসির বাবা মানে আমার দাদু) বলে দেবেন। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র। বিনোদিনী সেনগুপ্ত এখন বিজন বিহারী রায় এর স্ত্রী বিনোদিনী রায়।
এ কথা শুনে জমিদার বাড়ির লোকেরা বাড়ি এসে সমস্ত কথা বলে।
চিরদিনের জন্য সেনগুপ্ত বাড়ির সিংহ ফটক বিনু পিসির জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর শুরু হয় বিনু পিসির অভাবের সংসার। জমিদার বাড়ির রাজকন্যা বিনু পিসি গরিব ঘরেই নিজেকে মানিয়ে নেয়। তাদের সংসারে অভাব থাকলেও সুখ- ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। অভাব দরজা দিয়ে ঢুকলেও ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায় নি। দাদু - ঠাকুমা এই বিয়ে মেনে না নিলেও বাবা - জেঠু মাঝে মাঝে লুকিয়ে বিনু পিসির সাথে দেখা করত। রাগ অভিমান তো ছিলই। কিন্তু একমাত্র বোনের প্রতি ভালোবাসাটা ও তো মিথ্যে ছিল না। কিন্তু বিনু পিসির কপালে সুখ হয়তো বিধাতা লেখেন নি। মাত্র একবছর বিনুপিসি সংসার করতে পেরেছিল। একদিন হঠাৎ ই মাত্র পাঁচ দিনের জ্বরে বিজন বাবু র মৃত্যু হয়। বিনু পিসি যেন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। আর হবেনি বা কেন।যে ভালোবাসার টানে নিজের শখ, আহ্লাদ, ঐশর্য্য, বাবা - মায়ের স্নেহ, পরশ ছেড়ে শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখে ঘর করতে চেয়েছিল তার আকস্মিক চলে যাওয়াতে পাথর হয়ে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
বিনু পিসি আর এই বাড়িতে ফিরে আসতে চায় নি। বাবা জেঠুৱাই নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকেই আবার বিনু পিসি এই বাড়িতেই থাকে। মায়ের মুখে শুনেছি বিনু পিসির নাকি আবার বিয়ে দেওয়ার ঠিক করেন দাদু। কিন্তু পিসি আর রাজি হন নি। তিনি বিনোদিনী রায় নামেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। আমি জন্মে থেকেই এই বিনুপিসিরেই কোলে পিঠে মানুষ হয়েছি। একটু বড় হতেই শুনেছি বিনুপিসির কাছে এই বাড়ির মেয়ে হয়ে আমি জন্মেছি । সেহেতু কাউকে মন যেন দিয়ে না ফেলি। নাহলে আমারও হয়তো তার মতোই পরিণতি হবে। বড্ড ভয় ছিল আমাকে নিয়ে বিনু পিসির। বিনুপিসি বড় দের সাথে খুব একটা কথা বলতেন না। নিজে নিজের মতোই একাদশী, ঠাকুর- বিগ্রহ আর ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দের নিয়েই সময় কাটিয়ে দিতেন।
আমি তখন সবে স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে প্রবেশ করেছি । স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে প্রথম কলেজ জীবনের স্বাদ। প্রজাপতির মতো তখন নিজেকে মেলে ধরার সময়। মনে তখন হাজার ও বসন্তের রং এরা ভিড় করে এসেছে। এই প্রথম গ্রামের বিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতা শহরে ভর্তি হয়েছি। বাংলায় অনার্স নিয়ে। চোখে কত রঙিন স্বপ্নরা বাসা বেঁধেছে। এই মুক্তির স্বাদ যেন অন্য রকমের। আমার দেশের বাড়ি হরিদেব পুরে হলেও কলকাতায় যেহেতু বাপ- কাকাদের ব্যবসা তাই কলকাতা তেও আমাদের একখানা বাড়ি ছিল। এই বাড়িতে আমার বড় জেঠুর দুই ছেলেই থাকতেন। তাদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। বড় জেঠুর ছেলে অরুণ ও তরুণ সেনগুপ্ত। আমি দাদাদের কাছেই তখন থাকতে শুরু করলাম পড়াশোনার সুবাদে। নতুন কলেজ জীবনে অনেক নতুন নতুন বন্ধু- বান্ধবী পেলাম। বিনুপিসি তখন দেশের বাড়িতেই বড় একলা। বিনু পিসির জন্য মাঝে মাঝে মন খারাপ হত বৈকি কিন্তু কিছু করার ছিল না। কিন্তু বিনু পিসির বলা কথা গুলো তখন বুকে বড় বাজতো। এই পরিবারের মেয়ে দের ভালোবাসার পরিণাম যে কি হতে পারে, সেই সম্পর্কে আমার ভীষণ রকম জ্ঞান ছিল। স্কুল জীবনেও প্রেম ভালোবাসা সম্পকে জ্ঞান থাকলেও সেইরকম কোনোদিন কারোর জন্য আমার হৃদয় টানে নি।
নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই অনেক বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আমার পরিচয় ঘটলো। সেই প্রথম কলেজ কেটে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া। গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা দেওয়া মনে পড়ে স্বর্ণালী, পিয়ালী, মধুমিতা, অনিরুদ্ধ, অলকেশ, পরিতোষ ওদের কথা। আমি সেই প্রথম আসতে আসতে বুঝতে অনুভব করলাম অনিরুদ্ধ র জন্য আমার একটা মনের ভিতর অনুভূতি র সৃষ্টি হচ্ছে। ওর অনুপস্থিতিতে আমার মনটা বড় বেশি অস্থির হয়ে উঠছে। বাড়ি ফিরে সন্ধেয় বেলাতে পড়া র টেবিল এও নোটস লেখাতে মন বসাতে পারছি না। কখনো কখনো আনমনে শুধু অনিরুদ্ধ র অবয়ব খানিই চোখের সামনে গাঢ় হয়ে ফুটে উঠত। বিনু পিসির কথা গুলো মাথাতে থাকলেও আমি যেন এক অজানা ভালোলাগায় তখন মেতে ছিলাম। টিউশন পড়তে গিয়েও মনে মনে অপেক্ষা করতাম কখন অনিরুদ্ধ আসবে। চোখাচোখি বসলে আমার অগোচরে ও আমায় দেখতো ওর অগোচরে আমি ওকে। এই ভালোলাগা ছিল যেন এক দুঃসাহিক ভালোলাগা। কেউ কাউকে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতাম না। কিন্তু দুজন নেই হয়তো নিশ্চিত ছিলাম আমরা একে অপরের পরিপূরক। অনিরুদ্ধ খুব ভালো লেখালেখি করতে পারতো। কলেজে ম্যাগাজিনে ওর লেখা অনেক পড়েছি আমি। তাছাড়া ওর লেখা একটি ডায়রিও আমি পড়েছিলাম। কি যেন কেন জানি না আমায় নোটস দেওয়ার অছিলায় খাতার মধ্যে ওই ডায়েরি খানি আমায় দিয়েছিল। পরে অবশ্য বলেছিল ভুল করে নাকি দিয়েছিল। কিন্তু আমি জানি ওটা ভুল না। ডায়েরি তে লেখা প্রতিটি অক্ষরেই যেন ও আমাকেই লিখেছিল। কি অসম্ভব ছিল ওর লেখনী শক্তি। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ওর লেখা পড়ে। আমি তখন আর ও বেশি করে ওর প্রেমে বিভোর।
চলবে
ছবি : সংগৃহীত
গল্পটি কেমন লাগছে জানাবেন। আমার লেখা গুলি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করে আমার ব্লগটি জনপ্রিয় করে তুলুন। আপনাদের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
0 মন্তব্যসমূহ