সুখ দুঃখের ঠিকানা প্রথম পর্ব



 

Bengali woman pic

Short story ( ছোট গল্প)



সেনগুপ্ত পরিবারের কন্যা  আমি। আমার বাবারা ছিলেন চার ভাই ও এক বোন। বাবাই ছিলেন ভাই দের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বাবা , জেঠু দের ছিল বিশাল বড় মিলের কারখানা। কলকাতায় বিশাল ব্যবসা। আমরা থাকতাম  দেশের বাড়ি হরি দেবপুরে। এখানে ছিল আমাদের বিশাল বড় বাড়ি। আমার  দাদু ও তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন বংশপরম্পরায় জমিদার। তাই তখনকার আমলরেই পুরোনো বাড়ি ছিল আমাদের। বাড়ি বলা ভুল হবে এক ঝটকায় দেখলে জমিদার বাড়ি ই বলা যেতে পারে। অন্দরমহল, রন্ধন শালা, বৈঠকখানা, নাট মন্দির, দুর্গা মন্দির, ঝোলা বারান্দা , বিশাল বড় উঠোন, বাড়ির লাগোয়া বাগান বাড়ি, সিংহ দুয়ার, বাড়ির পূর্ব দিকে মস্ত বড় পুকুর, অতিথি শালা আরো কত কি! হ্যা, এই বাড়ির ই মেয়ে ছিলাম আমি। আমার জেঠু দের সবাই এর দুটো করে পুত্র সন্তান। শুধু আমার বাবারই কন্যা সন্তান। ওহ! আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এতক্ষন আমার সম্পর্কে বলছি কিন্তু আমার নাম টাই এখনো বলা হলো না। আমার নাম কোজাগরী। কোজাগরী সেনগুপ্ত। আমি কোজাগরী লক্ষহী পুজোর দিন পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছিলাম। শুনেছিলাম আমার ঠাকুমাই না কি এই নাম টি দিয়েছিলেন। আমি কন্যা সন্তান বলে তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না। কিংবা আমার বাবা, মা ও আমায় যথেষ্ট ভালবাসতেন। কিন্তু আমায় সবচেয়ে চেয়ে যে বেশি ভালোবাসতো তিনি হলেন আমার পিসি । পিসির নাম ছিল বিনোদিনি রায়।বাড়ির সবাই তাকে বিনু বলেই ডাকতেন। কিন্তু কোথাও যেন বিনু নামটা এই সেনগুপ্ত বাড়ির মানুষ দের মুখ থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। সে অনেক বড় কাহিনী। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে। 


(ছোটগল্প( short story) বাংলা গল্প)

(সামাজিক গল্প)


আমার দাদু ও  তেনার দাদা মিলে সবে কলকাতায় কারখানাটি তৈরি করছেন। দেশের বাড়ির শত শত বিঘে জমিদারির  ব্যবসা ছেড়ে অন্য ভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে তখন ব্যস্ত। ঠাকুমার  কোল জুড়ে আমার বিনু পিসি এলো। এত বড় জমিদার বাড়ির একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন তিনি। রূপে লক্ষহী, বিদ্যায় , অঙ্কনে, সংগীতে যেন মা স্বয়ং সরস্বতী যেন আমার বিনু পিসির ওপর সমস্ত আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছিলেন। টকটকে দুধ সাদা গায়ের রং ছিল আমার বিনু পিসির। হাসলে যেন বিনু পিসির মুখের দিকেই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। গালের নীচে ঘোর কালো একটি তিল ছিল। আমার বিনু পিসির বরাবরই চোখে কাজল দিতে পছন্দ করতো। ঘন কালো ভ্রু যুগোলের নীচে কাজল কালো চোখ গুলো যেন জ্বলজ্বল করতো। কি মোহ ময় ছিল সেই রূপ। বিনু পিসি পড়াশোনা, গান বাজনা সব কিছুই শিখেছিল বটে, কিন্তু বাড়িতেই তার সমস্তটা আয়োজন করা হয়েছিল। তখনকার দিনে মেয়ে দের বাড়ির বাইরে বেরোনোর চল ছিল না একদমই । অতিথি শালার পুবের দিকে একটা মস্ত বড় ঘর ছিল। সেই ঘরে গান বাজনার নানা রকমের বাদ্য যন্ত্র ছিল। বেহালা, বীনা, তানপুরা, সারেঙ্গি, সেতার, হারমোনিয়াম, তবলা আরো অনেক কিছু। এই গুলি আসলে দাদুর পূর্বপুরুষ এর সময় নাটমন্দিরে ব্যবহার করা হত। তখন গানের আসর বসানো হত। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমিদার রা, গণ্য মান্য ব্যক্তিরা আসতেন গানের আসরে। চলতো মদের ফোয়ারা। অন্দরমহলের কোনো মহিলা , কিংবা, চাকরানি দের  ওই নাট শালায় প্রবেশ ছিল নিষেধ। এ সবই বিনু পিসির কাছে ই আমার শোনা। 


Rajbari



যায় হোক বিনু পিসি খুব আদর এ যত্নেই বড় হতে থাকলো।তখনকার দিনে মেয়েদের আরো ছোট বয়স এ বিয়ে দেওয়ার রেওআজ ছিল। বিনু পিসি সদ্য যৌবনে যেন আরও রূপসী হয়ে উঠলো। বিনু পিসির যৌবন কালের ছবি অনেক দেখেছি। সত্যিই বিনু পিসি ছিল অপরূপা। কোমড় ছাপানো কালো ঘন চুলের বাহার, মিষ্টি হাসি যে কাউকেই মুহূর্তেই ঘায়েল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিনু পিসি কে গান শেখাতে আসতো বিজন বিহারী রায়। আমার দাদুই ওনাকে নিযুক্ত করেছিলেন বিনু পিসিকে গান শেখানোর জন্য। বিজন বাবুর সম্পকে আমি যতটুকু জেনেছি সব টাই বিনু পিসির কাছ থেকে। এই বাড়িতে ওই নামটি উচ্চারণ টিও করা ছিল পাপ। সদ্য যৌবনে একটি প্রস্ফুটিত ফুল মন দিয়ে বসেছিল তার গান এর মাস্টার মহাশয় কে। বিজন বাবু যখন প্রথম বিনু পিসিকে গান শেখাতে আসেন তখন বিনু পিসির বয়স তেরো কি চৌদ্দ।আর বিজন বাবুর একুশ। বিনু পিসি বলতেন, বিজন বাবু যখন প্রথম আমায় দেখেন তখন তো উনি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েই ছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম না তাকিয়ে কি উপায় আছে নাকি বিনু পিসি। তোমার ডাগর কালো চোখ দুটির পানে যেই তাকাবে সেই তো মুগ্ধ হয়ে যাবে। আর বিনু পিসি মুগ্ধ হয়েছিল বিজন বাবুর সৌজন্যতা য়, ব্যবহারে, তার ওতো টুকু বয়সে সংগীতের প্রতি এতটা জ্ঞান অর্জনতা দেখে। সেই তেরো- চোদ্দো বছরের সেনগুপ্ত বাড়ির একমাত্র কন্যা কখন যে মনে মনে তার হৃদয়খানি তার গানের মাস্টারমশাই কে দিয়ে বসেছে সে নিজেই বুঝতে পারে নি। তারপর এই ভাবেই কেটে গিয়েছিল আরো দু - দুইটি বছর। বিজন বাবু মন প্রাণ ঢেলে তার একান্ত অনুগতা ছাত্রী কে সংগীতে পারদর্শী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর ঐদিকে ছাত্রীর হৃদয়ে তখন মাস্টার মশাইকে নিয়ে এক রোমাঞ্চকর উন্মাদনা। ভালোবাসার ঢেউ খেলেছিল দুটি হৃদয়েই। বিজন বাবু বার বার নিজের অন্তর আত্মা কে সংযমী করতে চেয়েছিলেন। এ হয় না, হতে পারে না। বিনোদিনী আমার ছাত্রী। ওরা অনেক বড়লোক। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র কন্যা। আর আমি  , আমি তো সাধারণ ঘরের ছেলে। আমি কখনোই বিনোদিনীর যোগ্য নই। মন থেকে ওই দুটি কাজল কালো চোখের প্রেমে পরেও বিজন বাবু নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজের ভালোবাসা থেকে। এই ভাবেই আরো একটি বছর পেরিয়ে গেল। মুখে কিছু না বললেও বিনোদিনী মনে মনে বিনদবুকে নিয়ে একটি সুখের সংসার এর স্বপ্ন দেখতেন। যে স্বপ্নে একটি সাধারণ ঘরের বধূ ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে পুবের জানালা খুলে দিয়ে গানের রেওয়াজ এ বসছে, পাশে তার স্বামী ও তার সাথে সুরে সুর মেলাচ্ছে। ধীরে ধীরে সূর্য তার নিজস্বতা প্রকাশ করছে এই ভাবে প্রতিটা সকাল শুরু হচ্ছে টালির ছাই দেওয়া বিজন বিনোদিনীর নতুন সংসারে।

Beautiful lady

(সুখ দুঃখের ঠিকানা)


একদিন গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বিনু পিসি বাড়ির বাগানটায় গাছ গাছালির দেখাশোনা করছিলেন। হটাৎ নারায়ণ বাবুর প্রবেশ। নারায়ণ বাবু কে দেখে বিনু পিসি একটু কুশল বিনিময় সারলেন। উনি অন্দর মহলে প্রবেশ করার পর কি যেন কেন মনের খেয়াল এ বিনু পিসিও গাছের কাজ কর্ম ছেড়ে মহলের দিকেই যাচ্ছিলেন। কয়েকটি কথা তার কানে এলো, 

- আপনি তো এই তল্লাটের জমিদার বাবু। প্রতাপ  বাবুর অঙ্গুলি নির্দেশে এখনো পুরো গ্রাম উঠে বসে।

আমার দাদুর নাম ছিল প্রতাপ সেনগুপ্ত।

কিন্তু দাদু হেসে বললেন না না নারায়নবাবু এইসব কি বলছেন। জমিদারি তো সব উঠেই গেছে বাবার আমলে, এখন আমি আর দাদা ( কাঞ্চন সেনগুপ্ত) মিলে কলকাতার ব্যবসা টা তেই ধ্যান জ্ঞান দিচ্ছি।

- তা ঠিক আছে। এই রকম সম্ভ্রান্ত পরিবার এই তল্লাটে বড় দুর্ল্লভ। আসার পথে বিনু মা কে দেখলাম। বেশ বড় হয়ে গেছে। ওর তো এবার বিবাহের ব্যবস্থা করা দরকার।

কথা গুলো কানে বিধতেই বিনুর বুকটা ধক করে উঠলো। সে নিজের ঘরের দিকেই এগোচ্ছিলো। তার পা দুটো যেন ওখানেই আটকে গেল। হটাৎ বিবাহ নিয়ে আলোচনা শুনে বিনু পিসির হৃদয়ের মধ্যে সবকিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল।


চলবে ....


ছবি : সংগৃহীত


আমার লেখা গুলি ভালো লাগলে আমায় একটি কমেন্ট করে উৎসাহিত করতে পারেন। তাতে আমি লেখার আরো সাহস পাই। আমার ব্লগ টি জনপ্রিয় করে তুলতে অনেক অনেক শেয়ার করুন। তাহলে আমার এই লেখালেখির শখ টা পূর্ণতা পাবে। আর যারা যারা আমার ব্লগ দেখেছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। এই লেখাটি একটু অন্যরকম লেখার চেষ্টা করছি। দোষ ত্রুটি ক্ষমা করবেন। শুভ রাত্রি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ