সুখ দুঃখের ঠিকানা ( তৃতীয় পর্ব)

 

Weeding pic

একদিন আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটি বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ  এলো। আমার কলকাতা নিবাসী দাদা- বৌদি দের সাথে আমিও গেলাম দেশের বাড়ি। উদেশ্য দেশের বাড়ির সকলে মিলে ওই বিয়ে বাড়িতে যোগদান করার। আমার মনে তখন অন্য রকম আমেজ। নিজেকে পরিপাটি করে সবসময় সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করছি। বার বার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখছি বিনু পিসির মতোই চোখের কোলে ঘন কালো কাজল টানছি। পায়ে নুপুর। সেই নুপুর এর ঝংকারের তালে তালে আমার নতুন প্রেমে পড়ার উচ্ছাস টা আরো বেড়ে উঠছে। যায় হোক সেই দিন জেঠিমনি র একটি লাল রং এর বেনারসি পরে মনের মতো করে সেজে পরিবারের সকলের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। 


( ছোট গল্প/ গল্প)




অনুষ্ঠানে ভিড়ের মাঝে আমায় দেখে পছন্দ হয়ে গেল বিয়ে বাড়িতে আমন্ত্রিত একজন এর। উনি ই হলেন আমার শাশুড়ি মা। পাত্র কলকাতা নিবাসী। বয়স এ আমার থেকে বছর দশেক এর বড়। পেশায় ডাক্তার। একমাত্র ছেলে। এই সন্মন্ধ আর বাড়ি থেকে হেলায় হারায় নি। আমার ওখানেই দেখাশোনা শুরু করেন বাড়ির লোকেরা । আমার মত? কেউ নেই নি। কেউ একেবারের জন্যও জিজ্ঞাসা করে নি এই ব্যাপারে আমার মত আছে কিনা। উপযুক্ত পাত্র কি না। কোনো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ছাড়াই সবাই রাজি হয়ে গেল। মনের অন্তরে যৌবনের প্রথম বসন্তের প্রুস্ফুটিত ফুল টি সকলের অগোচরে শুকিয়ে যেতে থাকলো । না বলা ভালোবাসা মনের অন্তরেই তিলে তিলে শেষ হয়ে গেল। সদ্য দেখা স্বপ্ন গুলো কে শেষ করে ফেললাম। আসতে আসতে ভুলে গেলাম আমার বন্ধু আমার অন্তরের প্রেমিক অনিরুদ্ধ কে। 



দাশগুপ্ত বাড়ি তে পা রাখলো কোজাগরী দাশগুপ্ত। দুধে আলতা পায়ে রাঙিয়ে দিয়ে দাশগুপ্ত পরিবারের বউ হয়ে এলাম। সমস্ত আশা, ভালোবাসা, পরিবার পরিজন ছেড়ে চলে এলাম নতুন একটি পরিবারে। অনেক দায়িত্ব অনেক কর্তব্য পালন করতে। তখন থেকে এটিই হয়ে গেল আমার পরিবার। সুখে দুঃখে এই পরিবারের মানুষ গুলির সাথে থাকা পাশে থাকাই হলো আমার একমাত্র ব্রত। আমি বিয়ের আগে স্বামীকে চাক্ষুষ দেখি নি। দেখাশোনার সময় ছবিতে দেখেছিলাম। শুভ দৃষ্টির সময় প্রথম দেখলাম। উনিও আমায় সেই দেখলেন। ফুলসজ্জ্যার রাতে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা একটা মানুষের মুখোমুখি আমি। সেই অবসন্ন, ক্লান্ত দিন অতিবাহিত করার পর তিনি আমার শরীর স্পর্শ পর্যন্ত করে নি। দু - চারটে আদুরে আলাপ শুধুমাত্র করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন আমার মনের ইচ্ছা। আর ইচ্ছা! তাকে তো কবেই জলাঞ্জলি দিয়ে আপনাকে আপন করে নিলাম ডাক্তার অনুরূপ দাশগুপ্ত। মন মনে বিড় বিড় করে ঠিক এই কথাটিই সেদিন আমি আওড়েছিলাম। উনি ঈষৎ আমার মুখের সামনে ঝুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন - "কি বললে বুঝতে পারলাম না। তুমি নির্ভয়ে তোমার ইচ্ছা আমায় প্রকাশ করতে পারো। আর হ্যা, আমরা এখন সম্পকে স্বামী স্ত্রী । আমাকে তুমি - "তুমি " বলেই সন্মধন করবে। সেই প্রথম মানুষটিকে নিজের করে নিলাম। বললাম নিজের ইছেটুকুর কথা। তিনি বলেছিলেন সংসার করতে হলে কিংবা যে কোনো সম্পর্ক এরই প্রথম ধাপ হলো বন্ধুত্ব। আগে ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হোক। একে অপরের ভালো লাগা মন্দ লাগা সম্পকে জানি, বুঝি তারপর আমরা দাম্পত্য সম্পর্কের দিকে এগোব। তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হলো। আমার ইছেটুকু পূরণ করতে উনি আমায় কলেজে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু সেই কলেজে নয়। বাড়ির কাছাকাছি একটি কলেজে। আমি গ্রাজুয়েট হলাম । আস্তে আস্তে আমরা একে অপরের কাছাকাছি চলে এলাম। আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হলো। বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের দাম্পত্য এর জীবন শুরু হলো। আমার স্বামী আমায় সবসময় চোখে হারাত।

Fulsojjar bed


কিন্তু গ্রাজুয়েট হওয়ার পর আমার আবার সদ্য দেখা স্বপ্ন গুলো আস্তে আস্তে চুরমার হয়ে গেল। সবে গ্রাজুয়েশন এর রেসাল্ট খানি হাতে পেয়েছি। স্বপ্ন তখন উচ্চ শিক্ষার। হটাৎ ই একদিন দুপুর বেলা  শাশুড়ি মা ডাকলেন তার ঘরে। তিনি তখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন। শশুর মশাই ঘরের এক কোনে চেয়ার এ বসে  খবরের কাগজে পাতা উল্টাচ্ছিলেন। আমি ঢুকতেই শাশুড়ি মা উঠে বসলেন। পাশে টেবিল এ থাকা পানের বাক্স থেকে একটি পান বের করে মুখে দিয়ে বললেন 

- দেখ বৌমা, তুমি এই দাশ গুপ্ত পরিবারের একমাত্র বৌমা। আমার আদরের ছেলের বউ। আমার এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, তোমার এই বাড়িতে আগমনে এই কদিনেই  আমার সংসারে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমার ছেলের পেশা তেও অনেক উন্নতি হয়েচে। তুমি মা সাক্ষাৎ কোজাগরী লক্ষ্মী। আমি বলি কি বৌমা কিছু মনে করো না মা, আমার তো বয়স হয়েছে। তোমার শশুর বাবারও শরীর টা ভালো যাচ্ছে না। আর লেখাপড়া না করে এবার সংসারে মন দাও।  অনেক তো পড়ালেখা করলে মা। এই যোগ্যতা তেই তোমায় ঢের মানাবে আমার অনুর  ( অনুরূপ) কাছে। তাছাড়া তুমি তো রূপে মা লক্ষ্মী।


সেইদিন থেকেই ওনার কথা মতো সংসারের সব দায়িত্ব, কর্তব্য মাথায় পেতে নিলাম। সংসারের মধ্যেই আস্তে আস্তে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম। স্বামী আমায় ভীষণ ভালো বাসত। তিনি ঘুরতে যেতে ভীষণ পছন্দ করত। আমায় অনেক অনেক জায়গায় ঘোরাতে নিযে গেছে। বিয়ের বছর পাঁচেক আমরা অনেক জায়গায় ঘুরেছি। অনুরূপ একবারও আমায় বাচ্ছা নেওয়ার জন্য চাপ দেয় নি। বলত তোমার যখন ইচ্ছে আমায় বলবে। সেদিন ই আমরা আমাদের মধ্যে আর একটি প্রাণ আনবো। আমিও অনুরূপ কে ভালোবাসার থেকেও অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতাম। একবার উত্তর ভারত ঘুরে এলাম অনুরূপ এর সাথে। ঘুরে এসে পরের দিন খুব ক্লান্ত ছিলাম। অনুরূপ নিয়ম মতো পরদিনই হসপিটালে কাজে চলে গেছে। আমি শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। শাশুড়ি মা ঘরে ঢুকলেন। আমি টের টুকু পেলাম না। আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আসলে বেশ কয়েকদিন এর জন্য ঘুরতে বেড়াতে বেরোলে ঠিক ঠাক ঘুম হয় না। তাই বাড়িতে অসময় এই চোখ টা লেগে গিয়েছিল। আচমকা কপালে একটি নরম হাতের স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যায়। 

- মা, আপনি! আমায় ডেকেছিলেন বোধ হয় । আমি আসলে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। তাই শুনতে পাই নি।  

শীতল হাতের ছোঁয়া খানি কপালে বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন

- জানি। বাইরে থেকেঘুরে এলে শরীর এর উপর কতটা ধকল পরে। সবার শরীর তো সমান না। ঠিক আছে বউ মা তুমি ঘুমাও। বিশ্রাম নাও।

- কিন্তু আপনি কিছু বলতে এসেছিলেন তো মা। না বলেই যে চলে যাচ্ছেন। কি বলবেন মা?  বলুন না।

খানিকটা ইতস্তত করে উনি বললেন , তেমন কিছু না। তোমার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম । তাই একবার তোমার ঘরে উকি দিয়ে গেলাম। 

কিন্তু এতদিন হয়ে গেল আমি এই বাড়ির বৌমা। এই বাড়ির সমস্ত দায় দায়িত্ব র ভার আমার ওপর। শাশুড়ি মায়ের সাথে এত ওঠা বসা। ওনার যে মনে কি চলছে আমি খানিকটা হলেও আচঁ করতে পারলাম।

শাশুড়ি মা উঠে যাচ্ছিলেন, আমি আঁচল খানি টেনে বললাম। বসুন মা। কি বলবে বলছিলেন বলুন না মা। 

- বলছি বউ মা রাগ কোরো না কেমন।

- এত কিন্তু কিন্তু বোধ কেন করছেন। আমি তো আপনার মেয়ের মতো। আমার ভুল ত্রুটি হলে আপনিই তো শুধরে দেবেন।

- না না। ভুল - ত্রুটি কিছু করো না বউ মা। কিন্তু বউ মা তোমাদের পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে। এদিকে আমার তোমার শশুর মশাই এর বয়স হচ্ছে। এই বয়সে নাতি- নাতনি নিয়ে সময় গুলো কাটাতে চাই। তাই বলছিলাম এবার আর ঘুরে না বেরিয়ে বাচ্চা নাও। 

আমি লজ্জায় নত মস্তকে ইতিবাচক ঘাড় নাড়লাম।

শাশুড়ি মা খুশি হয়ে আমায় একটা চুমু দিয়ে চলে গেলেন।

অনুরূপ বাড়ি ফিরতে আমি ওকে বললাম সমস্ত ঘটনা। অনুরূপ আমায় জিজ্ঞাসা করলো তোমার কি মত? আমি ও ভেবে দেখলাম এবার একটা বাচ্ছা নেওয়ার দরকার। আমি শুধু লজ্জায় অনুরূপ কে জড়িয়ে ধরলাম। অনুরূপ আমার মনের কথা বুঝতে পারলো।


এর পর আমার কোল আলো করে এলো লগ্নজিতা। নাতনি হওয়ার আনন্দে আমার শশুর শাশুড়ি মা আমায় সিতা হার, বাউটি দিয়েছিলেন। আমার মেয়ে যেদিন হয় সেইদিন দাশগুপ্ত বাড়ির সবচেয়ে খুশির দিন। আমার শাশুড়ি মা শঙ্খ বাজিয়ে উলু দিয়ে মেয়েকে ঘরে আনলেন। আমার মেয়ের নামকরণ ওর দাদুই করেছিলেন। আমি আর অনুরূপ আমার মেয়েকে ভালোবেসে সুমি বলে ডাকি। তখন থেকে সুমি কে নিয়েই আমার জগৎ তৈরি হলো। এবার প্রকৃত সংসার নামক জগৎ টা তে পুরোপুরি জড়িয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম আমার উচ্চ শিক্ষা না হওয়ার ক্ষোভ, ভুলে গেলাম সদ্য যৌবনের ভালোবাসার কথা, ভুলে গেলাম নিজের ব্যক্তিগত সুখ, আনন্দের কথা ভাবতে।  তখন সুমি কে ঘিরেই আমার একটা আস্ত জগৎ। সংসার নামক জীবন টাই আমার কাছে স্বর্গ। আস্তে আস্তে অনুরূপ এর কাছ থেকে আমার একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হতে থাকলো। অনুরূপ এর ও আগের থেকে কাজের প্রেসার বাড়তে লাগলো। ও তখন ওর কেরিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত।


চলবে


ছবি : সংগৃহীত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ