সুখ দুঃখের ঠিকানা চতুর্থ পর্ব

 

Bengali story sukh dukhher thikana 4 th part
  


(Bengali short story/ Bengali story / ছোট গল্প/ গল্প)



সুমির স্বাস্থ্য, শরীর, ওকে সময় মতো খাবার খাওয়ানো,ফল খাওয়ানো, অন্য দিকে অনুরূপ এ কেও টাইম মতো হাসপাতাল বেরোনোর জন্য তৈরি করে দেওয়া। বৃদ্ধ শশুর , শাশুড়ির ওষুধ পত্র সময় মতো তাদের খাইয়ে দেওয়া এইসব নিয়েই আমার সারাটা দিন কেটে যেত। বাইরের জগতের সাথে সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেল। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ এর বন্ধু বান্ধবী দের চেনা মুখ গুলো ও অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ এর অভাবে অচেনা হয়ে গেল। বছরে দু বার হাতে গোনা এক সপ্তাহের জন্য বাপের বাড়ি যেতাম। কলকাতায় দাদা বৌদি রা মাঝে মাঝে এখানে আসতেন। ওই টুকুই। সুমি যখন মাত্র তিন বছর। হটাৎ ই একদিন জানতে পারলাম বিনু পিসি আর নেই। ছুটে গিয়েছিলাম শেষ দেখাটা একটি বার দেখার জন্য। যে মানুষটা জীবনের সমস্তটা বসন্ত কাটিয়ে দিল একটি মানুষ এর স্মৃতি আকড়ে ধরে সেই মানুষটাকে একটি বারের জন্য স্পশ করতে খুব ইচ্ছে হয়ে ছিল। পিসি বেঁচে থাকতে যখনই বাপের বাড়ি যেতাম বিনু পিসি বলতেন, সকলের ভাগ্যে সুখের সংসার হয় না রে। তুই বড় ভাগ্যবতী রে কোজাগরী। মনের মতো ঘর পেয়েছিস, বর পেয়েছিস, কত জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছিস। দেখিস নিজের বরের খেয়াল সবসময় রাখিস। আঁচলে বেঁধে রাখিস বর কে। আমি তো আর বেঁধে রাখতে পারলাম না। খেয়েই ফেললাম। বিনু পিসির চোখ দিয়ে বয়ে যেত নোনা জলের ধারা। কোন  ছোট বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। সংসার করেছিল মোটে এক বৎসর। ওই এক বৎসরের স্মৃতি টুকু আগলেই উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমি পৌঁছানোর আগেই বিনু পিসিকে দাহ করতে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আমার আর শেষ বারের মতো বিনু পিসির মুখ খানি দেখা হলো না। আমি ই ছিলাম সেনগুপ্ত পরিবারের একজন যার কাছে বিনু পিসি তার অতীতের সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ সব কিছু বলেছিল। কিন্তু আমি ! আমি তো আমার মনের কথা আজ ও কাউকে বলতে পারি নি। 

Bengali story sukh dukhher thikana 4 th part


আসতে আসতে সুমি বড় হতে থাকলো। ওর পড়াশোনার দায়িত্ব ও আমার ওপর পড়লো। সুমি ভর্তি হলো কলকাতার একটি নামকরা স্কুলে। গাড়ি তে করে যাতায়াত করে। সুতরাং আমার যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কালের নিয়মে সংসার গড়িয়ে চলে। সুমি একটু একটু করে দাদু, ঠাম্মি, মা, বাবার আদরে বড় হতে থাকে। আমার সুমি প্রথম থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো। ও অনেক বড় বেলা অবধি ই আমার কাছেই শুধু পড়েচে। সুমি নাচ শিখেছে, আঁকা শিখেছে। সুমিকে স্যার বাড়িতেই আঁকাতে আসতেন। তখন আমি স্যারের জন্য চা করে দিতে যেতাম। আমার ও মনে মনে আঁকতে খুব স্বাদ জাগতো। মনে মনে ভাবতাম আচ্ছা লোকে তো বলে শেখার কোনো বয়স নেই। আর সুমি কে যখন স্যার বাড়িতেই আঁকা শেখায় তাহলে আমিও তো শিখতে পারি। তার জন্য তো আর বাড়ির বাইরে যেতে হয় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। স্বামী আমায় সাধারণত কোনো কাজে বাধা দিত না। এক সন্ধ্যায় অনুরূপ সবে একটি ওটি সেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোফায় গা টা এলিয়ে দিয়েছে। আমি চা নিয়ে গেলাম। দেখলাম ওর মুড টা ভালোই আছে। জিজ্ঞাসা করলাম আজকের ওটি কেমন হলো? 

বলল ভালো, খুব ভালো। পেশেন্ট এখন ভালো আছেন।

শুনেও খুবখুশী হলাম।

দুজনে মুখোমুখি বসে চা খেতে খেতে নিজের মনের কথাটা পেরেই ফেললাম।

- শোনো না, বলছি সুমিকে যে স্যার আঁকা শেখাতে আসবে ভাবছি ওনার কাছে আমিও আঁকা শিখব। আসলে কি বলো তো শেখার তো কোনো বয়স থাকে না....

- কি ? আর ইউ ম্যাড কোজাগরী?তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? এই বয়স এ আঁকা শিখবে তুমি?

লজ্জায় , অপমানে মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল আমার।

- নিজের খাম খেয়ালী পোনা গুলোকে প্রশয় না দিয়ে সুমি র দিকে ভালো করে নজর দাও। মা তো খুব অসুস্হ মা এর দেখভাল করো। এইসব ছোটখাটো চিন্তা ভাবনা তোমার মাথায় আসে কি করে কোজাগরী? সংসারের ভালো, মন্দের দিকে একটু নজর দাও। আমি এমনি এমনি আজ এত বড় ডাক্তার হয়ে যাই নি। এতে রয়েছে  মায়ের অনেক  নিরলস পরিশ্রম, আত্মত্যাগ। আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত সুমিকে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দেওয়া।


অনুরুপের মুখের ওপর আমি কিছু বলতে পারি নি। আমি তো আমার সাধ্যমত সংসারের সমস্ত দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছি। শশুর, শাশুড়ি মায়ের খেয়াল রাখছি। সুমি র পড়াশোনা , নাচ, আঁকা সমস্তটার দিকে নজর রাখছি।  কিন্তু এত কিছুর মাঝে যে আমার নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে, নিজের কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে। এগুলোরও তো মূল্যায়ন দরকার। আমার আপন বলতে আমার অবসরের সঙ্গী বলতে আমার সর্বক্ষণের কাজের দিদি আরতি দি। আর খোলা জানালা, উন্মুক্ত ছাদ। কিনতু আমি ও তো কিছু আমার নিজস্ব কর্ম নিয়ে নিজেকে খুশি রাখতে চেয়েছিলাম। সেটা অনুরূপ বোঝে নি। ভালোবেসে ভালরাখা মানে যে শুধু এই নয় ভালো বস্ত্র দিচ্ছে, ভালো খেতে দিচ্ছে, মাথার ওপর নিভর্শীল একটা ছাদ দিচ্ছে এটাই যথেষ্ট। ভালোবাসার মানুষটির ও নিজের মতো করে একটু বাঁচতে ইচ্ছে করে। ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে এটা অনুরূপ কখনো বোঝে নি। কালের নিয়মে অনুরূপ অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে এখন স্বনামধন্য ডাক্তার। ওটি, চেম্বার এইসব নিয়েই ও এখন ব্যস্ত। আমার সাথে দু দণ্ড ভালোভাবে কথা বলারও ওর সময় নেই। দেখতে দেখতে সুমি বড় হয়ে গেল। শাশুড়ি মাও ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে গমন করলেন। শশুর মশাই খুবই একা হয়ে গেলেন। বরাবরই মানুষটা কোনো সাতে পাঁচে থাকতেন না। সারাদিন রেডিও, নিউজ পেপার নিয়েই কাটিয়ে দিতেন। শাশুড়ি মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ওনার চলে যাওয়া টা উনি মেনে নিতে পারেন নি। প্রথম থেকেই আমার সাথে খুব কমই কথা বলতেন। উনি বরাবরই সবাই এর সাথেই খুব কম কথা বলতেন। শেষ জীবনে নিজের কাছের মানুষটাকে হারানোর যে যন্ত্রনা কতটা ভয়াবহ তা বাবাকে ( শশুর মশাই ) দেখে বুঝেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম আমার মা কে তো বাবা এক মাসের ব্যবধানেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। যাক মাকে অতটা কষ্ট ভোগ করতে হয় নি। বাবা মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আমার মাও মারা যান। 

Bengali story sukh dukhher thikana 4 th part


এরপর একদিন অনুরূপ এর একজন সহকর্মী হটাৎ ই মারা যান রোড এক্সিডেন্ট এ। আমার স্বামী স্বাভাবিক ভাবেই ওই বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ান।তার নাবালক পুত্র ও স্ত্রী এর পাশে দাঁড়ান। এরপর শুরু হয় আর ও মানসিক দ্বন্দ্ব। শশুর বাড়িতে প্রবেশ কালীন কোনোদিন শশুর, শাশুড়ি মায়ের  সাথে পর্যন্ত  উঁচু গলায় কথা বলি নি। কিন্তু এই প্রথম শুরু হল অনুরূপ ও আমার মধ্যে নিত্য কথাকাটাকাটি, সন্দেহ, রাগ- অভিমান। সব কিছু মিলে মিশে দুজনের মধ্যে আরো দূরত্বের সৃষ্টি হলো।

- তোমার মত স্বার্থপর মানুষ আমি এই দুনিয়ায় একটাও দেখি নি কোজাগরী। এক জন এর  স্বামীর অবর্তমানে তার দরকার এ যদি আমি তারপাশে দাড়াই তাহলেই সেটা পরকীয়া হয়ে গেল? এত নিচ মানসিকতা তোমার কোজাগরী? ছি! ছি! আমার তো ভাবতেই লজ্জা লাগছে তুমি আমার স্ত্রী। এতটা ব্যাকডেটেড তুমি?

- ব্যাকডেটেড তো তুমি আমায় তৈরি করেছ ডক্টর অনুরূপ দাশ গুপ্ত। দিনের পর দিন এই চার দেয়ালের মধ্যে আমায় বন্দি করে রেখেছ। শুধু বলেছ সংসার দেখো, মা বাবার খেয়াল রাখো। সংসারের ভালো মন্দ দেখতে দেখতে যে আমার জগৎ টা শুধুমাত্র বাড়ির এই কজন কে মিলিয়েই তৈরি হয়েছে অনুরুপ। আমি তো এই টুকু জগৎ ছাড়া আর কিছুই জানি না। নিজেকে নিগড়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সাজানো জগতের একটা কোনো তিল জিনিসও যে আমি কারো হতে দেব না অনুরূপ। 

- কেন বুঝতে পারছো না কোজাগরী আমি কারো হয়ে যাই নি। আমি তোমার ছিলাম। শুধু তোমারই আছি।

- না... আমি বিশ্বাস করি না। তাহলে দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমায় না জানিয়ে তুমি ওখানে....

- কি বললে কোজাগরী রাতের পর রাত! 

- ছি! তুমি কতটা নিচয় নেমে গেছো তুমি নিজেও জানো না। মুখের ভাষা সংযত করো কোজাগরী । ভুলে যেও না তুমি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বউ। মা বেঁচে নেই তো কি হয়েছে, বাবা এখনো বেঁচে আছে ন। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমার নাইট এ ডিউটি থাকে। এতবছর তাই করে আসছি। আর তুমি আমায় নিয়ে এতকাল পর আমার চরিত্র এর দিকে তুমি আঙ্গুল তুলছ? কি দিই নি তোমায় কোজাগরী? কোন দিক থেকে তোমায় মন্দ রেখেছিলাম আমায় বলতে পারো?

- কখনো আমার মন টাকে বুঝতে চেয়েছো ? আমারও কিছু ব্যক্তিগত একেবারে নিজস্ব চাহিদা ছিল সেগুলো মেটাতে তুমি ছিলে অপারক মিস্টার অনুরূপ।

- জাস্ট শাট আপ কোজাগরী। আমি আছি বলেই তুমি এত বড় বড় কথা বলতে পারছো। এত ঠাট - বাট শুধু আমার জন্যই। কি আছে তোমার ? তোমার নিজস্ব কি পরিচয় আছে? তুমি শুধু আমার ওপর নিভরর্শীল। 


চলবে ....

ভালো লাগলে একটা কমেন্ট করে জানাবেন। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ