সুখ দুঃখের ঠিকানা (অন্তিম পর্ব)

 

Sukh dukher thikana last part


সত্যিই আমার তো  নিজের কোনো আইডেন্টিটি নেই। আমার নিজস্ব সত্ত্বা বলতে আজ কিছুই নেই। রাগের মাথায় বলা অনুরুপের কথা গুলো আমার মন কে আরো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিল।  গভীর অভিমান নিয়ে চলে এলাম নিজের অন্ধাকার ঘরে। অন্ধকার ঘরটা আরো আজ বড় বেশি অচেনা লাগছিলো। আমি তো অন্ধকার পছন্দ করি। একা একা কত সন্ধেয় এইভাবেই নিরালায় কেটেছে। সময় কাটতো না । মেয়ে বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে। নিজে নিজের মতো এখন স্টাডি করে। আমায় প্রয়োজন পড়ে না। শশুর মশাই বরাবরই খুবই শান্ত মেজাজের। তাকে নিয়ে আমায় বড় বেশি ভাবতে হয় না। সময় মতো খেতে দিই। রাতে বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে আসি। অনুরূপ এর তো প্রতি দিন ই ডিউটি। কোনো দিন হসপিটালে কোনো দিন প্রাইভেট চেম্বার। নিঃসঙ্গ শুধু আমি। একটা সময় এই সংসারের জন্য অনেক করেছি। নিজেকে নিয়ে কখনো ভাববার ফুরসৎ ই পাই নি। যাদের জন্য করলাম, নিজের মূল্যবান সময় গুলো খরচ করলাম সেই মানুষ গুলোর কাছেই আমি আজ বড় অবহেলিত। পাশের ঘর থেকে সুমি হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আজকাল ফোনে ফোনেই একসঙ্গে অনেক বন্ধুদের সাথে কানেক্ট করা যায়। প্রায় দিনই সুমি আড্ডা দেয় ফ্রেন্ডস দের সাথে। কিন্তু কোনো সন্ধেয় বেলাতেই ফ্রি হলেও আমার পাশে বসে দুটো কথা বলে না। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার তো কেউ নেই। আমি বড় একা, খুব একা। তবে সুমির উপর অল্প একটু অভিমান হলেও আমি কিন্তু রাগ করি না। কিংবা বড় হয়েছে মা কে একটুও বোঝে না, এই সব লম্বা চওড়া ডায়লগ ও দিই না। আমি চাই ওর মতো করে ও জীবন টাকে উপভোগ করুক। ছোট থেকে তো বহু কষ্ট করে সৎ শিক্ষাই দিয়ে এসেছি। সবাই এর মা, বাবাই প্রতিটা সন্তানকে তাই করেন। এবার বড় হলে সন্তানদের ব্যাপার। ওরা কোন পথে এগোবে। আমার কতব্য আমি করে গেছি।


একদিন সন্ধেয় বেলায় দেখলাম মেয়েটা আমার কাছে আবদার করে বসলো  - মা আমায় সেই ছোটবেলাকার মতো সরু সরু আলু দিয়ে চাউমিন করে দিতে পারবে? তাতে অল্প একটু গোলমরিচ আর সস মিশিয়ে দেবে। উফফ! তুমি এই ডিশ টা না জাস্ট ফাটাফাটি করো। ছোটবেলায় ওই চাউমিন টা স্কুলে টিফিন এ নিয়ে যেতে দারুন লাগতো।

- তা বেশ, কিন্তু আলু দিয়ে চাউমিন করে দিলে তোর তো আবার ডায়েট এর গন্ডগোল হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং ওটস এর নুডুলস বানিয়ে দিচ্ছি।

- না মা, একটা দিনই তো আবদার করছি। প্লিজ করে দাও না। একটা দিন না হয় আমার ডায়েট টা তোলা থাক। আজ চলো না তুমি আমি দুজনে মিলে হাতাহাতি করে চাউমিন টা করি। আমি তোমায় আলুটা কেটে দিচ্ছি। আর হ্যা, ঝুরি ঝুরি করে ডিম ভেজে দিতে ভুলো না কিন্তু 

মেয়ে আজ আবদার করে তার পছন্দের খাবার নিজের মুখে খেতে চেয়েছে। কোনো মা না করে দিতে পারে। সুমি আর আমি খুব ভালো একটা সন্ধ্যে সেদিন কাটিয়েছিলাম। সুমিকে নিজের এত কাছে আজ পেলাম। গল্পে আড্ডায় ওকে জিগ্যস করলাম - কিরে, সুমি তোর কোনো মনের মানুষ আছে নাকি ?


( Bengali story / short story/ বাংলা গল্প)



উত্তর এ ও বলেছিল - ধুস! কি যে বলো না তুমি?আমি তোমার মত এইরকম বদ্ধ ঘরে বোবা হয়ে থাকতে নারাজ। তার চেয়ে বরং এই বেশ আছি। নিজের কেরিয়ার, পড়াশোনা, বন্ধু- বান্ধব হই চৈ। জাস্ট এনাফ মা। লাইফে কোনো কষ্ট নেই। কোনো না পাওয়ার বেদনা নেই। কারো জন্য রাত জেগে ভাবনা নেই, আমার ভেজা বালিশ নেই। কারো কাছে জবাবদিহি করার কেউ নেই। আমি আমার নিজের মর্জির মালকিন। তুমি আর বাবা আমায় কষ্ট করে পড়াশোনা শিখিয়েছ, বড় করেছ, বিশেষ করে তুমি মা অনেক আত্মত্যাগ করেছ, তোমার শিক্ষার আমি খেলাব কখনো করবো না আমি। তুমি যে আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছো সেই স্বাধীনতা র ও কখনো খেলাব করবো না। আজ সকাল থেকেই মনটা খুব কষ্ট হচ্ছে জানো মা, পাছে তুমি আমার চোখের জল দেখে ফেলো তাই নিজেকে তোমাকে একটা সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দিলাম। কাল আমি রিসার্চ এর জন্য ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাব। তোমাদের ছেড়ে এত দূরে । সবসময় হাসি খুশি হয়ে থাকি বলে ভাবছো হয়তো আমার কষ্ট হচ্ছে না? জানি মা তোমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের সর্বস্ব টা দিয়ে তুমি আমায় গড়ে তুলেছে আজকে সবচেয়ে কষ্টের আর আনন্দের দিন তো তোমার মা। এ যে তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে মা। একমাত্র তোমার জন্য। তুমি চিন্তা একদম করবে না মা। সাবধানে থাকবে। আর হ্যা যাওয়ার আগে তোমায় একটা জিনিস আমি দিয়ে যেতে চাই।

- কি রে সুমি?

-এই নাও। স্মার্ট ফোন। 

-এটা কি হবে আমার। ও সব আমার দরকার নেই 

-আরে দরকার আছে। ভালোবেসে দিচ্ছি যখন নিতেই হবে তোমায়। 

-আচ্ছা বেশ , নিলাম। কিন্তু এটা কি করে ব্যবহার করবো? আমার ছোট ফোন ই ঠিক আছে।

-আহা! আমি তো তোমায় শিখিয়ে দেব।

-ও সব আমার মাথায় ঢুকবে না। ভজঘট ব্যাপার স্যাপার।

-খুব ঢুকবে। ছোটবেলায় তুমি আমায় কত কিছু শেখাতে বলো তো। যতক্ষন না পারছি পড়িয়েই যেতে। আজ আমি টিচার। তুমি স্টুডেন্ট। পারবে না  মানে। শিখিয়ে দিলেই খুব পারবে। 

সেই প্রথম সুমিই শিখিয়ে দিল স্মার্ট ফোন এর ব্যবহার। ফেসবুক, হোয়াট স্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, গুগল আরো কত কিছু। আমার ক্লান্তিময় দুপুরের, অবসন্ন সন্ধের, নীরব মধ্যরাতের সঙ্গী হলো এই মুঠোফোন।


( Bengali story / short story/ বাংলা গল্প)


ফেসবুকের মাধ্যমে ই আবার নতুন করে সার্চ করতে লাগলাম আমার পুরনো দিনের বন্ধু বান্ধবী দের। আমার সুপ্ত ভালো লাগা, যৌবনের সেই সদ্য প্রুস্ফুটিত প্রেমের দোলা লেগেছিল যাকে দেখে সেই অনিরুদ্ধ কে ফেসবুকে খুজলাম। পেয়েও গেলাম। কত বয়স হয়ে গেছে। কাঁচা পাকা চুল হয়েছে। আগে চশমা পড়তো না এখন চোখে এখনকার স্টাইলের চশমা। মুখে বয়স এর ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু মুখের এই হাসিটা সেই আগের মতোই চিরন্তন।  আমি চির কৃতজ্ঞ এই স্মার্ট ফোন এর কাছে। এর মাধ্যমেই আমি অনেক স্মৃতি পেলাম। আবার আগের বন্ধু গুলোর সাথে কথা হলো। আমার সময় গুলো বেশ ভালো কাটতে লাগলো। অনিরুদ্ধ কে ফ্রেন্ডরিকয়েস্ট টা পাঠাতে গিয়েও মনটা বড্ড বেশি অস্হির হয়ে পড়ছিল। কি জানি এত গুলো দিন, এতগুলো বছর, এতগুলো মাস পর ও আমার এই ছবি দেখে চিনতে পারবে কি! কি জানি কি মনে হতে দৌড়ে গেলাম আলমারির কাছে। ফটো এলবামে থাকা একটা পুরোনো দিনের সাদা কালো ছবি বের করে ফোনে ফটো তুলে ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার করে দিলাম। যাতে অনিরুদ্ধর আমায় চিনতে সুবিধা হয়। কাঁপা কাঁপা ঘামসিক্ত হাতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা পাঠিয়েই দিলাম অনিরুদ্ধ কে। উফফ! সে কি অস্থিরতা! আমি  কি কাজ টা ঠিক করলাম! এত গুলো বছর পর অনিরুদ্ধর আদেও আমার কথা মনে আছে তো! কি জানি! পুরুষ মানুষ মানেই তো ব্যস্ত... ব্যস্ত তার জগৎ হয়তো আমার এই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট টা ও দেখবেই না। শত শত রিকোয়েস্ট এর ভিড়ে আমি হয়তো হারিয়েই যাবো । ফোনটা পাশে রেখেই টেবিলে মাথা রেখে আদি অন্ত অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি। ফোনে নোটিফিকেশআসার আওয়াজ এ আমি চমকে উঠি। দেখি একটা মেসেজ।


- কেমন আছো কোজাগরী?

অনিরুদ্ধ র মেসেজ পেয়ে বুকের ভিতর টা যেন ঢিপঢিপ করতে শুরু করে দিল। তার সাথে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলো। একদিকে ভয় একদিকে ভালো লাগা এক দুই এর মাঝখানে আমি বড় অসহায়। ও আমায় চিনতে পেরেছে! এত গুলো বছর পরেও অনিরুদ্ধ আমায় চিনেছে! আমি যে নিজের মনকেই নিজে বিশ্বাস করাতে পারছি না। 

- এতগুলো বছর পর আমায় মনে পড়লো বুঝি?

অনিরুদ্ধ র থেকে পাওয়া দ্বিতীয় মেসেজ টি আরো আমায় চঞ্চল করে দিলো। 

আমি রিপ্লাই দিলাম।

- আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ?

- এই বেশ চলে যাচ্ছে। দশটা চারটের কলেজ , টুকটাক লেখালিখি... এই নিয়েই জীবন কেটে যাচ্ছে। তোমার কি খবর? কলেজ পড়তে পড়তেই তো বিয়ে করে নিলে। এখন কি করো?

- কি আবার! ওই সংসার.... তুমি কবে বিয়ে করলে?

- ওটাই তো এখনো পর্যন্ত করা হলো না.... আসলে  সংসারের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাই নি। এই বেশ ভালো আছি।

শুনেছিলাম তোমার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছে। বর ডাক্তার। তা খুব সুখী তুমি তাই না? 

ভেবেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কিন্তু না দিলেও বেমানান । 

লিখলাম। হ্যা। সংসার এ থাকতে গেলে সুখী তো থাকতেই হবে। সুখী থাকতে হবে। পরিবারের সকলকে সুখী রাখতে হবে। 


- হমম... এটা কিন্তু কোজাগরী তুমি ঠিক ই বলেছ। 

এই ভাবেই চলতে থাকে অনিরুদ্ধ আর আমার মধ্যে ফোনালাপ। 

আসতে আসতে আমাদের মধ্যে সখ্যতা আরো নিবিড় হলো। কলেজ লাইফের না- বলা অনেক কথা আমরা লেখায় কবিতায় একজন আর একজন এর কাছে প্রকাশ করলাম। এক অদ্ভুত ভালোলাগা আমায় ভরিয়ে তুললো। আমি  নিঃসঙ্গ জীবনে একটা নতুন প্রাণ ফিরে পেলাম। বদ্ধ বাড়িটাও একটা স্বর্গ মনে হতে থাকলো। বুঝলাম শরীর এর বয়স হলেও মনের বয়স হয় না কখনো। 



( Bengali story / short story/ বাংলা গল্প)




কিন্তু আমার এই ভালোলাগা পরিবর্তন কিছুই চিরস্থায়ী হলো না। আমার এই সাজ সজ্জা সব কিছুর মধ্য আমার স্বামী অনুরূপ ওর সন্দেহের তীর ছুড়ে দিল। ধরা পড়ে গেলাম আমি স্বামীর কাছে। একদিকে অনিরুদ্ধর বন্ধুত্বের হাতছানি, অন্যদিকে আমার সংসার স্বামী এই দুই এর মাঝে আবার আমি আটকা পরে গেলাম। বুঝলাম আমার মুক্তি নেই। এই দাশগুপ্ত বাড়ির চার দেওয়াল ই আমার শেষ নিঃশ্বাসের ঠিকানা। অনুরূপ বললো যে এত গুলো বছর পরেও নিজেকে সংযত করতে পারলো না, তাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। ভালোবাসা , আর বিশ্বাস একই দেওয়াল এরই দুটি দিক। বিশ্বাস টাই যখন নেই তখন আর ভালোবাসা....

আমি ভেঙে পড়লাম। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে গেল।

রাতের পর রাত চোখ এ ঘুম আস্ত না। মেসেজ এ তখনও অনিরুদ্ধ র বন্ধুত্বের হাতছানি। আমি নীরব হয়ে গেলাম। কোনো মেসেজ এর উত্তর দিতাম না। শুধু সিন করে দেখতাম। একদিন অনুরূপ বললো - পুরোনো প্রেম কে বুঝি এখনো জলাঞ্জলি দিতে পারো নি? এই বয়সে এসেও এটা করতে পারলে তুমি? ছি! আমাদের বংশের চরিত্রহীনা তুমি।

- ব্যাস অনুরূপ ব্যাস। কি করেছি আমি ? আমি কি আমার ছোটবেলার সহপাঠীর সাথে একটু কথাও বলতে পারবো না? তুমি পুরুষ তুমি সব পারো । আর আমি সারাজীবন তোমাদের দিয়েই গেলাম। নিজের শখ আহ্লাদ কিছু আমার থাকতে পারে না? 

রাত তখন নিঝুম। আমার হাতে শশুর মশাই এর প্রেসক্রাইব করা দশ টি ঘুমের ওষুধ। জগ থেকে এক গ্লাস জল ঢাললাম। ওষুধ গুলো খেয়ে নিজে একটু শান্তিতে পরাপারে যাবো এমন সময়...

- কয় গো বউ মা... বউ মা.... বুকের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে । তাড়াতাড়ি একটু এসো মা।।

হাতে থাকা কাঁচের গ্লাস টা গেল পড়ে। রুদ্ধশাসে গেলাম বাবার ঘরে।

কোথায় কষ্ট হচ্ছে বাবা.... কোথায় বাবা...

অনুরূপ তাড়াতাড়ি এসো দেখো না বাবা কেমন করছে! 

কই দেখি...

এখুনি হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে বাবাকে। বাবার স্টোক হয়েছে।

চলো কোজাগরী।

বাবাকে বাঁচাতেই হবে কোজাগরী। ডাক্তার অনুরূপ দাশগুপ্তের ভীত মুখটির দিকে তাকিয়ে ওর কাঁপা কাঁপা হাত দু খানি ধরে বললাম কিছু হবে না বাবার। আমি আছি তো। 

পরম আদরে বুকে টেনে নিল অনুরূপ আমায়।।

আমি আবার মিশে গেলাম আমার সুখ দুঃখের ঠিকানায়।



( Bengali story / short story/ বাংলা গল্প)


(সুখ দুঃখের ঠিকানা)



সমাপ্ত


ছবি : সংগৃহীত


গল্পটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন।  অনেক কষ্ট করে একটি গল্প লিখতে হয়। আপনাদের একটি কমেন্ট আমায় লিখতে আরো উৎসাহিত করবে। আমার ব্লগ চ্যানেলটি জনপ্রিয় করতে আরো বেশি করে শেয়ার করুন। আমার নিত্যনতুন গল্প পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমার ব্লগ টি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ