মা ( Bangla golpo/ Bengali story)

 

Ma ( mother / short story/ Bengali story/ Bangla following)


পেশায় অধ্যাপিকা কমলা সরকার। মেয়ে তিস্তা কে নিয়েই তার সংসার। তিস্তাই তার জীবনের সবকিছু। একমাত্র সন্তান কে তাই তিনি সবসময় চোখে হারান। এইদিকে তিস্তা মায়ের এইরকম ছেলেমানুষী স্বভাবে খুব রেগে যায়। তিস্তা পড়তে গেলে গানের ক্লাসে গেলে এখনো ওর মা ই স্কুটিতে চাপিয়ে নিয়ে যায়। আবার ফেরার সময় নিয়ে ফেরে। এই জন্য তিস্তার টিউশন এর বন্ধু - বান্ধবী রা খুব হাসাহাসি করে। তিস্তার লজ্জা লাগে, ও অপমানিত বোধ করে। এই নিয়ে তিস্তা ওর মা কমলা কে অনেক বুঝিয়েছে, - " মা প্লিজ , আমায় টিউশন এ গানের স্কুলে তোমায় আর নিয়ে যেতে নিয়ে আসতে হবে না। আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। কলেজে পড়ছি।

এখনো যদি আমায় সব সময় দিয়ে আসা নিয়ে আসা করো তাহলে সবাই ভাববে তুমি আমায় এখনো ভরসা করতে পারো না। তাছাড়া এই ব্যাপারটা  নিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করে আমার একটুও ভালো লাগে না। তোমার এখন বয়স হচ্ছে মা। তাছাড়া সারাদিন কলেজে পড়িয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড় তুমি। তোমার ও তো একটু বিশ্রাম এর প্রয়োজন। "


( Bangla golpo | Bengali story| short story )



চাটুতে রুটি শিকতে শিকতে কমলা মেয়ের কথার জবাব দেয়, মায়ের কাছে সন্তানরা কখনো বড় হয় না। ছোট ই থাকে। আমি যতদিন পারবো ততদিন আমিই তোকে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করবো। তিস্তা বুঝলো , মাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। মা খুব কড়া ধাঁচের মানুষ। অগত্যা তিস্তা অন্য পথ অবলম্বন করল। সে বেশ অভিমান নিয়ে বললো, তুমি আমায় একটুও স্বাধীন ভাবে থাকতে দাও না মা। তুমি সবসময় আমায় চোখে চোখে রাখো। আমরও তো ইচ্ছে করে সবাই এর মত হেসে খেলে পড়াশোনা করে লাইফ টা কাটাতে। কিন্তু তুমি তা হতে দাও না। তুমি আমার হ্যাপিনেস টাই কেড়ে নিচ্ছ মা। তোমার জন্য , শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার বন্ধুরা আমায় দেখে খিল্লি করে। আমি বন্ধু দের সাথে প্রানভরে হাসতে পারি না। কথা বলতে পারি না। পড়া হয়ে গেলেই আনতে চলে আসো। ওরা কত গল্প, আড্ডা দিতে দিতে বাড়ি ফেরে। ফুচকা খায়। ছুটির দিনে একসাথে সিনেমা যায়। কখনো কোনো শপিং এ যায়। পুজোর সময় একসাথে ঠাকুর তলায় বসে আড্ডা দেয়। ঠাকুর দেখতে যায় সারারাত । আর তুমি তো এই সব আমায় কিছুই করতে দাও না। তোমার জন্য আমার বন্ধুরা আমার সাথে সেই ভাবে মিশতেও চায় না।প্লিজ মা, আমি এখন বড় হয়েছি। এখন আমায় আমার মতো চলতে দাও না। তিস্তার মুখে কথা গুলো শুনে কমলার মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিস্তা ছাড়া যে কমলার জীবনে কেউ নেই। কিছু নেই। ওকে ঘিরেই তো ওর বেঁচে থাকা। ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ এর স্বপ্নই তো কমলা দেখে আসছে। তিস্তার জন্যই দিন- রাত এক করে লড়াই করছে, পরিশ্রম করছে। আর সেই তিস্তাই বলে কিনা ওর মা নাকি ওর জীবনের হাসি কেড়ে নিচ্ছে! বুকের কাছটা কেমন দলা পাকিয়ে আসছে কমলার। নিজের অজান্তেই চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। কমলা আরো গোজ হয়ে দ্রুত আটা বেলতে থাকে। কিছুক্ষন দুজনেই কিছু কথা বলে না। তিস্তা ভাবতে থাকে ইস! মাকে একটু বোধ হয় বেশিই বলা হয়ে গেল। মা নিশ্চই কষ্ট পাচ্ছেন।



( Bangla golpo | Bengali story| short story )



কিছুক্ষন পর কমলা বললো, খেয়ে নে তিস্তা। রাত অনেক হলো। দুজনে মুখোমুখি খেতে বসলেও কেউ একটাও কথা পর্যন্ত বললো না। সারারাত কমলার চোখে ঘুম নেই। কমলা শুয়ে শুয়ে সারারাত ভাবলো, সত্যিই তো মেয়েটাকে বড্ড বেশি যেন শাসনে রাখছি। ওর ও তো একটু বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঘুরতে স্বাদ জাগে বৈকি। তিস্তার উপর রাগ করাটা সাজে না। কমলা ডুবে যায় অতীতের স্মৃতিকথায়। কমলাও তখন সবে কলেজে উঠেছে। কলেজ জীবনে সদ্য যৌবনে পদার্পন করে অনেকেই ভুলসিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আর সেই সিদ্ধান্তের ই মাশুল গুনতে হয় সারাটা জীবন দিয়ে। কমলার অতীতেও এইরকম ভয়ঙ্কর কাহিনী আছে। তাই কমলা ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। কমলা ঠিক করলো আজকের পর থেকে আর সে তিস্তাকে এতটা শাসনে রাখবে না। তাকে মেলতে দেবে অসীম আকাশের মাঝে। স্বাধীনতার স্বাদ দেবে। একটা হাসিখুশি জীবন দেবে। কারণ তিস্তার সুখই যে কমলার সুখ। আর তিস্তার মুখে হাসি ফুটলেই যে কমলার মুখে হাসি ফুটবে। ওই দিকে তিস্তার চোখেও ঘুম নেই। মা কে আজ ও বড় বেশি উঁচু নিচু কথা শুনিয়েছে। অনুতাপে ও মরমে মরছে। সত্যিই তো তার মা কেন ওকে চোখে চোখে রাখবে না? তিস্তা মনে মনে আওড়াতে থাকলো ওর সব বন্ধু বান্ধব দের মা, বাবা, দাদু, ঠাম্মা, পরিজন আছে। আমার কে আছে.... মা ছাড়া তো আমার কেউ নেই। স্কুলে যখন বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো তখন তিস্তা দেখতো সবাই এর মা, বাবা এসেছে। একমাত্র ওরই বাবা নেই। বাড়ি গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতো মা সবাই এর তো বাবা আছে। আমার কেন নেই? আমার বাবা কোথায় আছেন ? উত্তরে কমলা বলতো আমি ই তোর বাবা, আমি ই তোর মা। তিস্তা মনে মনে ঠিক করলো কাল সকালে উঠেই মায়ের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।


কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখলো সব কিছু যেন অন্য রকম। কমলা খুশি মনেই তিস্তা কে বলল আজ থেকে তুই একাই টিউশন, গানের স্কুল যাবি। বন্ধুদের সাথে অবসরে গল্প, আড্ডা দিবি। মায়ের মুখ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই খুশিতে তিস্তার মুখে প্রাণভরা হাসির ঝিলিক খেলে গেল। কিন্তু হ্যা সাবধানে স্কুটি চালাবি। বেশি রাত করবি না। ঠিক আছে মা। লাভ ইউ মা। মায়ের গালে একটা চুমু দিয়ে তিস্তা বেরিয়ে গেল গানের ক্লাসে। মেয়ের মুখে হাসি দেখে কমলার চোখ দুটি জুড়িয়ে গেল। 


( Bangla golpo | Bengali story| short story )


এরপর থেকে তিস্তা একাই যাতায়াত করত। বন্ধু বান্ধবদের সাথে ডিনার করে ফিরত। কত রাত কমলা টেবিল এ খাবার নিয়ে বসে থাকত। তিস্তা ফিরে এসে বিরক্ত হয়ে বলতো মা তোমায় বলেছি বাইরে খেয়ে নেব। তুমি কেন খেয়ে নাও না।

জবাবে কমলা বলত, মা হলে বুঝবি। সন্তানরা ঠিক মতো খেয়েছে কি না জেনে কোনো মা মুখে গ্রাস তুলতে পারে।

দিনের পর দিন এই ভাবেই কাট তে থাকলো। তিস্তা প্রেমে পড়ল অঙ্কুশ নামে একটি ছেলের সাথে। অঙ্কুশ একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। উচ্চ বংশ। কিছুদিন প্রেম করার পর তিস্তা ওর মাকে বললো ও একটি ছেলেকে ভালোবাসে। তার নাম অঙ্কুশ। ও তাকেই বিয়ে করতে চায়। মেয়ে যাকে পেলে খুশি হবে কমলাও তাতেই খুশি। কমলা কোনো অমত করলো না। কমলা মেয়েকে বললো অঙ্কুশ দের বাড়িতে কথাটা জানাতে। কারণ কমলা দেরি করতে চায় না। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তিস্তা বললো, মা অঙ্কুশ এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে ইচ্ছুক নয়। এমনকি আমিও । এবার কমলা রেগে গেলে , বিয়ের আগে আমি এত মেলামেশা পছন্দ করি না তিস্তা। ভালবেসেছ অসুবিধা নেই। কিন্তু বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে নিতে হবে। অগত্যা তিস্তা বিয়ের ব্যাপারে এ অঙ্কুশ কে চাপ দিতে থাকলো। অঙ্কুশও নানারকম টালবাহানা দিতে থাকলো। দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল। তিনমাস হয়ে গেল তিস্তার পিরিয়ড হচ্ছে না। সাথে গা বমি ভাব। মাথা ঘোরা। কমলা ডক্টরের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার বাবু বললেন, তিস্তা প্রেগনেন্ট। তিস্তা খুব ভেঙে পড়ল। অঙ্কুশ এর সাথে যোগাযোগ করে তার প্রেগ্নেসির কথা বলতেই অঙ্কুশ ফোন কেটে দিল। তারপর থেকে অঙ্কুশ এর ফোন সুইচ অফ। তিস্তা খুব কাঁদতে থাকলো। কমলা ওকে দূরে সরিয়ে না নিয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো। তিস্তা কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা আমি এই ছোট্ট প্রাণ টাকে কিছুতেই নষ্ট করতে পারবো না মা। কমলা শেষ চেষ্টা করতে ছাড়ে নি। ও তিস্তা কে নিয়ে অঙ্কুশ দের বাড়ি গিয়েছিল । কিন্তু জুটেছিল শুধুই ভৎসনা, অবজ্ঞা, কটু উপদেশ। ওরা বলেছিল এ কাজ নাকি ওদের ছেলে করতেই পারে না। তিস্তারই চরিত্রের দোষ। এটা অন্য কারো কাজ । ওদের ছেলের না।


এই ভাবে জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিস্তা খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েছিল। কমলাই ওকে বোঝালো মা রে, অনেক গুলো বছর আগে আমিও এই ঘটনার শিকার হয়ে অনেক দূরে চলে এসেছিলাম শুধু তোকে পৃথিবীর রূপ, আলো দেখাবো বলে। আত্মীয়, স্বজন, সমাজ সকলের চোখে হেয় হয়ে অনেক দূরে এসে শুধু তোকে নিয়েই বেঁচে আছি। কেন তোকে সবসময় চোখে চোখে রাখতাম এবার বুঝতে পারছিস তো? কাঁদতে কাঁদতে তিস্তা বললো আমায় ক্ষমা করে দাও মা। আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। 

-ওঠ মা, আর কাঁদিস না। তুই কাঁদলে যে তোর ভিতরে যে প্রাণ টা আছে তারও খুব কষ্ট হবে। এখন ওকে পরম মমতায় বড় করার দায়িত্ব তোর। 

এখন থেকে তিস্তা নিজের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রাণটির খেয়াল  রাখা শুরু করলো। আবার পড়াশোনা ও শুরু করলো। দেখতে দেখতে নয় টা মাস পার হয়ে গেল। তিস্তার কোল আলো করে এল এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। নাতির মুখ দেখে কমলা খুব খুশি। মা, দিদিমার আদরে ,ভালোবাসায় ছোট্ট রেহান বড় হতে থাকলো। ছোট্ট রেহান কে খাওয়াতে এখন তিস্তা বেশ নাজেহাল হয়ে পরে। তখন কমলা বলে দেখছিস তো বাচ্চারা ঠিক মতো না খেলে মায়ে দের কি হয়? তিস্তা শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি হাসে।



সমাপ্ত


ছবি : সংগৃহীত


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ