জুঁই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মৃনাল বাবু চেয়ার এ গিয়ে বসেন। মৃনাল বাবু নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেন , বাচ্চা এম যে অনিক কে ডাকতে বললাম জরুরি কথা আছে বলে, কিন্তু কি জরুরি কথা ! কি কথা ওকে বলবো আমি!
- আমায় ডাকছিলে বাবা?
অনিক এর কথায় মৃনাল বাবু ঘাড় তুলে দেখলেন।
আয়। বস এখানে।
- কি বলছিলে বাবা?
উমমম! মানে তেমন কিছুই নয় রে। আসলে জিজ্ঞাসা করছিলাম সকাল বেলায় পরীক্ষার জন্য ফর্ম কিনবি বলছিলিস তা কেনা হয়েছে?
- হ্যা, বাবা কেন হয়ে গেছে। আর ফিলাপ করে জমাও দিয়ে দিয়েছি।
- তা বেশ বেশ! এবারে তুই আসতে পারিস।
- আচ্ছা বাবা।
অনিক চলে যাচ্ছিল। মৃনাল বাবু আবার ডাকলেন।
- অনিক!
- হ্যা, বাবা ....কিছু বলছো?
- বলছি বাবা এই পরীক্ষা র প্রিপারেশন কেমন হয়েছে?
- খুব ভালো বাবা। দেখো বাবা আমি পাশ করবোই।
- বাহ! খুব ভালো। এই কনফিডেন্স টাই তো চাই। আমি তো জানি তুই পারবি ই। পারতে তো তোকে হবেই অনিক। তোর মুখের দিকে তাকয়েই তো আর কটা দিন দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছি।
Sonman part -3 Bengali story | Bangla golpo
অহনা সন্ধেয় বেলায় পড়তে বসলেও, ওর পড়ায় একদম মন বসতে চাইছে না। বার বার চোখের সামনে আয়ুশ এর মুখটাই ওর সামনে এসে যাচ্ছে। নিজেকে অনেক বার কন্ট্রোল করে বৃথাই চেষ্টা করলো। শেষে বই বন্ধ করে। বই এর উপরই মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। সন্ধের সময় অনিক, সপ্তক, অহনা সবাই পড়তে বসে। আর জুঁই সকলের জন্য চা করে, রাতের খাবার করে। অহনা জুঁই কে রান্নার কাজে টুকিটাকি হেল্প করতে চায়। কিন্তু জুঁই করতে দেয় না। বলে, এই বয়স টা পড়াশোনা করার বয়স। টাইম নষ্ট করার জন্য নয়। সংসারের কাজ করার জন্য তো সারাটা বছর পরে আছে। সন্ধে বেলা চা দিতে এসে জুঁই দেখে অহনা টেবিল এ বই এর উপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে।
- কি রে , তুই ভর সন্ধে বেলাতেই ঘুমিয়ে পরলি অহনা? শরীর খারাপ নাকি?
কপালে হাত দিয়ে জুঁই দেখলো। জুঁই এর গলা পেয়ে অহনা ঝেরেমেরে উঠে বসলো। আমতা আমতা করে বললো,
- কই না তো দিদি। ওই পড়তে পড়তে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।
- পড়াশোনায় একদম ফাঁকি দিস না অহনা। তাহলে তুই নিজেই ফাঁকি পরে যাবি।
টেবিল এ চা রেখে জুঁই সপ্তক আর অনিক কে দিতে গেল।
অহনা একটা মস্ত বড় হাই তুলে চা এ চুমুক দিলো।
......…............................................ .......................
Sonman part -3 Bengali story | Bangla golpo
তোমার এত কিসের জরুরি তলব তাড়াতাড়ি বলো বিকাশ। আমায় এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে।
- এত কিসের তাড়া জুঁই? আমারও তো ইচ্ছে করে তোমার সাথে একটু টাইম কাটাতে, তোমায় পাশে বসিয়ে দু চোখ ভোরে তোমায় দেখতে। নয় বছর ধরে তোমায় ভালোবাসছি জুঁই। আর কত আর কত অপেক্ষা করাবে আমায় বলো? আমি যে আর পারছি না। তোমার কি মনে হয় না এবার আমাদের বিয়ে করে সংসার করা উচিত? বলো জুঁই।
- বিয়ে, সংসার, সন্তান কোন মেয়ে চায় না ! সব মেয়েরাই চায়। আমিও স্বপ্ন দেখি একটি সুখের সংসারের। কিন্তু আমার পক্ষে যে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়। বৃদ্ধ বাবা, ছোট ছোট ভাই বোন দের রেখে আমি শুধুমাত্র সুখে থাকার জন্য ওদের ও কষ্ট দিতে পারি না বিকাশ।
- কিন্তু মা কে যে এবার তোমার আর আমার সম্পর্কের কথাটা জানাতেই হবে জুঁই। এতদিন শুধু তুমি বারণ করেছিলে তাই বলি নি। এখন মা নিজেই আমার বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে। এবার আর আমার কিছু করার নেই জুঁই।
...................................
ঘটক মশাই আপনি এই মেয়েটির বাড়ির সাথেই যোগাযোগ করুন। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে সামনের রবি বার ই দেখা করতে যাবো। ঘটক মশাই রায় গিন্নির হাত থেকে পাত্রীর ছবি খানি পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, অব্যশই পাত্রীর বাড়ি আপনার ইচ্ছার কথা জনাব রায় গিন্নি। এখন তবে যাই আমি?
আজ্ঞে, আসুন - খানিকটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে ক্যাবলা বললো কথাটা। ক্যাবলা হলো রায় বাড়ির পার্মানেন্ট চাকর। ভালো নাম কেল্টু চরণ।
ঘটক মশাই বেরিয়ে যাওয়ার পর কেল্টু চরণ রায় গিন্নির সামনে এসে দাঁড়াল। রায় গিন্নি তখন সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়তে ব্যস্ত ছিলেন। পড়তে পড়তে ম্যাগাজিন এর পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন, কি রে ক্যাবলা কিছু বলবি?
Sonman part -3 Bengali story | Bangla golpo
- বলছি কি যে গিন্নি মা আমাদের বিকাশ দাদাবাবুর সাথে ওই ছবিতে থাকা মেম সাহেব টিকে বেশ মানাবে। এক্কেরে রাজ জোটক যাকে বলে।
গিন্নি মা তথা রায় টেক্সটাইল এর মালকিন অঞ্জু রায় এর মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
( এমন সময় বিকাশ এর প্রবেশ। বিকাশ হলো গিন্নি মায়েরই একমাত্র সন্তান। রায় টেক্সটাইল এর হবু মালিক। অঞ্জু রায়ের হিরের টুকরো সন্তান।)
- মা তোমায় আজ এত খুশি লাগছে, কি ব্যাপার?
বিকাশ দেখতে পেয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন , রায় গিন্নি।
- বিকাশ তুই এসে গেছিস? এই তোর কথাই হচ্ছিল ক্যাবলার সাথে ।
- আমার নিয়ে কথা বলছিলে ক্যাবলার সাথে? তাহলে নিশ্চই কিছু ঘাবলার কেস আছে। আচ্ছা ব্যাপারটা কি বলতো ? এই ক্যাবলাটা কে তো দেখে মনে হচ্ছে আনন্দে হাবুডুবু খাচ্ছে।
- আমি বলবো গিন্নি মা?
- না...ক্যাবলা শুভ কথা মা কেই বলতে হয়।
- ওহ! তোমরা দুজনে মিলে কি শুরু করেছ বলতো । যা বলবে বলো তাড়াতাড়ি। এত সাসপেন্স এ রাখো কেন।
- তোর জন্য আমি একটা সুন্দরী মেয়ের সন্ধান পেয়েছি ঘটক মশাই এর কাছ থেকে। আমি কিন্তু ঘটক মশাইকে কথা দিয়েই দিয়েছি তুই আর আমি সামনের রবিবার মেয়ে র বাড়ি যাবো।
- মা, তুমি এটা কি করলে ! আমায় না জিজ্ঞাসা করে....
- হ্যা , এটা একটু ভুল ই করে ফেলেছি। কিন্তু কি বলতো মেয়েটি দেখতে এতটাই সুন্দর যে আমি কথা দিয়ে ফেলেছি। আমারও তো বয়স হচ্ছে বল। সেই কোন ছোটবেলায় তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ঘর বিজনেস সব একা হাতে সামলেছি। আমি আর পারছি না বিকাশ। আমার তো ইচ্ছে জাগে ঘরে একটা বৌমা আসুক। ঘর আলো করে থাকুক। নাতি - নাতনির মুখ দেখতেও তো ইচ্ছা করে। তাছাড়া তোর বয়স তো কম হলো না। এর আগে তোকে বিয়ের কথা বলতেই তুই অনেকবার নাকচ করে দিয়েছিস। কিন্তু আমি আর কোনো কথা শুনতে নারাজ বিকাশ। আমার শরীর টাও তো বিশেষ ভালো নয় বল। মায়ের মুখ চেয়ে অন্তত বিয়েতে রাজি হয়ে যা।
বাংলা গল্প
ক্যাবলা এতক্ষন গিন্নি মা ও বিকাশ এর মাঝে দাঁড়িয়ে তাদের মান- অভিমান এর কথা শুনছিল। বিকাশ এর সেই দিকে লক্ষ্য যেতেই ও ক্যাবলা কে ভাগিয়ে দিল। ক্যাবলা ওখান থেকে সরে পড়লো ঠিকই। কিন্তু আড়াল থেকে বিকাশ ও গিন্নি মায়ের কথা গুলো শুনতে থাকলো।
- কিন্তু মা তোমায় একটা কথা অনেকদিন ধরে বলবো বলবো করেও বলা হয় নি।
- কি বল বিকাশ কি কথা।
- মা আমি একজনকে ভালোবাসি। অনেক বছর ধরে।
- ভালোবাসিস? একটা মেয়েকে?
- হ্যা
- তা আগে আমায় জানাস নি কেন?
- জুঁই ই আমায় বারণ করেছিল বলতে?
- তা ওই জুঁই ই বুঝি তোর ভালোবাসার নাম?
- হ্যা মা। বেশ মিষ্টি নাম। তাহলে একদিন জুঁই এর বাড়িতেই যাবো ওকে দেখে এসে কথা বার্তা ফাইনাল করে নেব।
বিকাশ খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরলো মা কে।
ক্যাবলা দূর থেকে শুনে মনে মনে বললো এটা কি হলো? কথা হচ্ছিল একটা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে অন্য মেয়ের সাথে! ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো।
...........................................
আজ ও অহনা কলেজ যাওয়ার জন্য বাস স্টপ এ এসে দেখলো আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে। অহনা দেখেও না দেখার ভান করে বাস এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।
- অহনা, চলো বাইকে উঠে এসো। আমিও কলেজে যাবো তো।চলো এক সাথেই যাই।
-ধন্যবাদ। না না । তুমি যাও। আমি বাস এই চলে যাব।
-অহনা সবাই দেখছে। প্লিজ বাইকে উঠে এসো।
অহনা বাধ্য হয়েই আয়ুশ এর বাইকে বসলো।
বাইক চালাতে চালাতে ই আয়ুশ জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন অহনা।।
অহনা বেশ নিচু গলায় বলল বাবা, বড়দিদি, আর আমার দুই দাদা আর আমি।
- আর তোমার মা?
- মা নেই। অনেক ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। আমার বড়দিদি ই আমার দাদাদের, আমাকে সন্তান এর মত ভালোবাসেন, শাসন করেন।
- আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা ডাক্তার। হার্ট স্পেশালিস্ট। মা স্কুল টিচার।
- ও ... আচ্ছা।
- আচ্ছা, তোমার থেকে আমি কেন তোমার বাড়ি সম্পর্কে এত কিছু জিজ্ঞাসা করছি, কিংবা আমি ই বা কেন আমার সম্পকে এত কিছু বলছি তোমার জানার আগ্রহ নেই?
- হমম। কেন জিজ্ঞাসা করছো?
- কারণ টা খুবই সিম্পল। কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি অহনা।
কথাটা বলেই আয়ুশ বাইক টা থামিয়ে দেয়। বাইক থেকে নেমে হাটু ভাঁজ করে বসে একটা গোলাপ নিয়ে আয়ুশ অহনাকে বলে, আমি তোমায় ভালোবাসি অহনা। উইল ইউ লাভ মি অহনা?
অহনার হাত- পা কাঁপতে থাকে। বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে থাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় অহনা উত্তর দেয়, আমরা খুব গরীব। বাবা একটি কারখানায় সামান্য মাইনের চাকরি করে। খুব কষ্টে আমাদের লেখা পড়া শেখাচ্ছে। আমি তোমার যোগ্য নই আয়ুশ।
- আমি সব জানি অহনা। আমি সব জেনেই তোমায় ভালো বেসেছি। আমি কলেজে যেদিন তোমায় প্রথম দেখি সেইদিন থেকেই আমার তোমাকে ভালো লাগতো। কিন্তু এতদিন তোমায় বলতে পারি নি। তোমার সম্পর্কে সব জেনে তোমায় দেখে ভালবেসেছি। প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিল না অহনা।
- কি বলো তো আয়ুশ। আমরা গরীব। এই গরীব মানুষের কিছু না থাক, আত্মসম্মান বোধ টা থাকে প্রখর। লোকে ভাববে তোমার টাকা তোমার উজ্জ্বল ভবিষৎ এই সব দেখে আমি তোমায় ফসিয়েছি। না আয়ুশ , আমি যেমন আছি বেশ ভালো আছি। আমি কোনো অপবাদ, বা কলঙ্কের দাগ নিয়ে বাঁচতে চাই না। বাকি টুকু পথ আমি হেঁটেই যেতে পারবো । আসি।
অহনা হনহন করে এগিয়ে গেল কলেজের দিকে। আয়ুশ নীরব দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো।
চলবে ....
0 মন্তব্যসমূহ