একটুপর খেয়ে অহনা রওনা দিল কলেজে। সপ্তক ও কলেজে পড়ে। তবে একই কলেজে নয়। সপ্তক কমার্সের স্টুডেন্ট। আর অহনা আর্টস এর। অহনা ইতিহাসে অনার্স দ্বিতীয় বৎসর। অহনা কলেজ যাবে বলে বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বাস আসছিল না। এদিকে আজ ওদের কলেজে এক্সাম। খুব ইম্পরট্যান্ট এক্সাম না হলেও ক্লাস টেস্ট আর কি। সময় মতো পৌঁছানো টা খুব জরুরি। অহনা বেশ বিরক্ত হচ্ছিল। নিজেকে নিজেই দোষারোপ দিচ্ছিল। কেন যে বাড়ি থেকে একটু আগে বেরোলো না ও। তাহলে আগের বাস টা পেয়ে যেত। এখন বাস এর জন্য অপেক্ষা করতে হলে ঠিক টাইম এ কলেজ পৌঁছানো হবে না। তবে অহনার অনেক বান্ধবীরা এই এক্সাম টা দেবে না। না দিলেও ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু অহনার বেলায় একটু তফাৎ আছে। অহনার বড়দিদি জুঁই পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। তাই যেকোনো ধরণেরপরীক্ষাই হোক না কেন, পরীক্ষা দিতে ই হবে। বড়দিদি জানতে পারলে খুব রেগে যাবে। অহনার সমস্ত বিরক্তির অবসান ঘটালো একটি বাইকের আওয়াজ। অনবরত বাইকের হর্ন এর শব্দে ও পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।অহনা নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না, ও কি ঠিক দেখছে! ওর আর আয়ুশ এর ব্যবধান এখন মাত্র এক হাতের। আয়ুসেরই বাইকের হর্ন এর শব্দে ও পিছন ঘুরে তাকিয়ে ছিল।
- কি হলো কতক্ষন বাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে? উঠে এসো। কলেজে পৌঁছে দিচ্ছি।
মাথা নিচু করে খোলা চুল গুলো আঙুলের সাহায্যে পিছনে দিয়ে লজ্জিত গলায় অহনা বলল, ঠিক আছে। ধন্যবাদ। আমি বাস এই চলে যেতে পারবো।
- আমি যতদূর জানি তোমার আজ পরীক্ষা আছে। তাই আর লজ্জা না পেয়ে বাইকে চেপে বসো।
অহনা চমকে গেল। আজ ওদের পরীক্ষা আয়ুশ কি করে জানলো! এই দিক ঐদিক একবার তাকিয়ে অহনা আয়ুশ এর বাইকে চেপে বসলো।
কলেজে সব বান্ধবীরা আয়ুশ এর বাইকে চেপে আসছে দেখে ভারী অবাক হয়ে গেল। বাইক থেকে নামতেই কেউ কেউ আবার দুস্টু মিষ্টি গান গাইতে শুরু করে দিল। আয়ুশ ওদের ব্যাপার স্যাপার দেখে মুচকি হেসে বাইক ব্যাক করে চলে গেল।
Sonman part - 2 Bengali story| Bangla golpo| বাংলা গল্প
আয়ুশ চলে যাওয়ার পর অহনার বান্ধবী রা ওকে ছেকে ধরলো। কি রে, কলেজের সবচেয়ে স্মার্ট, হ্যান্ডসাম আবার পড়াশোনায় টপার ছেলেটাকে কি করে পটালি রে? যায় বলিস তোদের দুটিকে বেশ মানিয়েছিল কিন্তু। অহনা লজ্জা পায়। তবু বান্ধবীদের বলার চেষ্টা করে আয়ুশ এর সাথে তার কোনো পার্সোনালি পরিচয় নেই। অহনা শুধু জানে আয়ুশ এই কলেজের ফার্স্ট বয়। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর ইউনিয়ন এর লিডার। ব্যাস এইটুকুই। কিন্তু আয়ুশ ও যে অহনা কে চেনে এটা দেখে অহনার যেমন ভালোলাগে ছিল। তেমন মনের ভিতর অজানা ভয় ও প্রবেশ করে।
মৃনাল বাবুর আজ অফিসে ঢুকতে একটু দেরী ই হলো। কারখানার ম্যানেজার খুব কড়া। আজকাল কার পাশ করা ম্যানেজার কিনা বয়স কম রক্ত ফুটছে, টাইম এর একটু -আধটু এইদিক ঐদিক হলেই ট্যাশ ট্যাশ করে কথা শোনাতে ছাড়ে না। বয়সে মৃনাল বাবু ম্যানেজার এর বাবার বয়সী হলেও খুব চড়া মেজাজে আজ মৃনাল বাবুর সাথে কথা বলেছেন উনি। দেরিতে আসার কারণে। এটা সরকারি অফিস নয় যে যখন ইচ্ছে যাবেন, যখন ইচ্ছে আসবেন। আরো কত কিছু। বয়স এর ভারে আজকাল শরীরটাও খুব একটা স্বাদ দিচ্ছে না তার। তার ওপর ম্যানেজারের সাথে এইরকম বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে সারা শরীরটা যেন কেমন একটা অসাড় অসাড় লাগছে। মৃনাল বাবুর বয়স ষাট পেরিয়েছে অনেক দিন আগেই। কায়িক পরিশ্রম এর কাজ করেন না বলেই অনেক অনুরোধ এর জোরে মৃনাল বাবুর এখানে চাকরিটা এখনো অবধি রেহাই আছে। কারখানার হিসাব নিকাশের কাজ করেন উনি। আর কাজ না করে তো উপায় নেই। যতদিন না অনিক একটা সরকারি চাকরি পাচ্ছে। আজ মৃনাল বাবু নিজের টেবিল এ বসতে গিয়ে দেখেন, সব স্টাফ এ রাই তাকে করুন দৃষ্টিতে দেখছে। বড় লজ্জা লাগছিল মৃনাল বাবুর। কিন্তু লজ্জা পেলে যে হবে না। তাহলে যে চাকরিটা হারাতে হবে। মৃনাল বাবু কাজে মন দিলেন। সারাদিন ধরে ব্যবসায়িক লেনদেন হিসেব দেখে দুপুরের দিকে চেয়ার এ গা এলিয়ে মৃনাল বাবু একটু চোখ বুজলেন। সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি মধুর একটা স্বপ্ন তার দু চোখ আলো করে ভরিয়ে তুললো। মৃনাল বাবু স্বপ্ন দেখলেন , অনিক এর চাকরিটা হয়ে গেছে। প্রথম মাসের মাইনের টাকাটা বাবার হাতে দিয়ে ও অনিক বাবার পা ছুয়ে প্রণাম করলো। তারপর একখান ভালো শার্ট, প্যান্ট বাবাকে উপহার দিলেন। সারাবাড়ি ময় খুশির রেওয়াজ। আজ বড় খুশির দিন। সপ্তক আর অহনা মহা উৎসাহে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কখন ওদের জামা কাপড় টাও দাদা সামনে এসে হাতে দেবে। বাবাকে জামা উপহার দেওয়ার পর অনিক সোজা চলে গেল দিদির কাছে।
- দেখ তো দিদি এই শাড়িটা তোর জন্য নিয়ে এলাম। তোর পছন্দ হয়েছে কি না।
জল ভর্তি টল টল চোখে জুঁই বলল , খুব পছন্দ হয়েছে রে ভাই। ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অহনা আর সপ্তক তো এক ছুট্টে ওদের পাওনা গুলো নিয়েই দৌড়। কি সুন্দর একটা অপরূপ দৃশ্য। আনন্দে মৃনাল বাবুর চোখে জল এসে পড়ল।
Sonman part - 2 Bengali story| Bangla golpo| বাংলা
.......এই যে, শুনছেন ! মৃনাল বাবু আপনাকে বলছি বয়স তো অনেক হলো। এখন না পারেন টাইমে আসতে আর না করেন ঠিকঠাক কাজ। কোম্পানি যে কি করতে আপনার মত বুড়োকে এখনো পর্যন্ত বসিয়ে খাওয়াচ্ছে বুঝি না বাবা!
আচমকা ম্যানেজার বাবুর গলা খাকারী তে মৃনাল বাবুর ঘুম খান ভেঙে যায়। হতভম্বের মতো ম্যানেজার এর দিকে চেয়ে দেখেন। ম্যানেজার গজড়াতে গজড়াতে চলে গেলেন। কারখানার আরো কর্মচারীরা ওনার দিকে সবাই এক এক করে তাকিয়ে আবার কাজে মন দেন। মৃনাল বাবু আবার হিসাব এর খাতায় মনোযোগ দেয়। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন তারপর সমস্ত অন্ধকার যাবে ঘুচে, অনিক চাকরিটা পেয়ে গেলেই মৃনাল বাবুর ছুটি। মৃনাল বাবুর একার রোজগেরেই যে তার পরিবার টা চলছে। মৃনাল বাবু শত অপমান সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করতে শুরু করেন।
উত্তপ্ত দুপুর। কলেজের লাইব্রেরি তে ছুটির পর সপ্তক এসে একটু দরকারি বই গুলো নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করে। দরকারি নোটস গুলো খাতায় লিখে নেয়। সপ্তক এর মত আরো দু চারজন এইরকম কলেজ লাইব্রেরি তে এসে নোটস নেয়। আসলে যাদের সব বই কেনার ক্ষমতা নেই। সপ্তক মন দিয়ে নোটস গুলো লিখতে থাকে।
- হাই!
সপ্তক বই থেকে চোখ তুলে দেখে রিচা ওর সামনে। সপ্তক বেশ বিরক্ত হয়। সেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই মেয়েটি সপ্তক এর পিছনে পড়েছে। বড়লোকের আদরে বিগড়ে যাওয়া মেয়ে রিচা। চ্যাটার্জি ইন্ডাস্ট্রি র মেয়ে রিচা চ্যাটার্জি। এই কলেজে পরে। রিচা প্রেমে পড়েছে সপ্তকের। রিচা খুবই স্পষ্টবাদী মেয়ে। রিচা জানিয়েছে যে সে সপ্তক কে পছন্দ করে। ভালোবাসে। সে এ কথা অনেকবার সপ্তক কে জানিয়েছে। কিন্তু সপ্তক বার বার রিচাকে এড়িয়ে গেছে। একে তো সপ্তক একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তার ওপর রিচার মতো দাম্ভিক মেয়ে কে সপ্তক এর একদম পছন্দ নয়। রিচাকে লাইব্রেরি তে তার সামনে দেখে বিরক্ত হয়ে সপ্তক জিগ্যস করে,
- কি চাও তুমি? লাইব্রেরি পর্যন্ত আমায় ফলো করেছ? তোমার কি লজ্জা, সংযম বলতে কিছুটি নেই? একটা মেয়ে হয়ে একটা ছেলের পিছনে ঘুরঘুর করছো।
সপ্তকের কথায় বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে রিচা জবাব দিলো, আমি তো শুধু তোমায় চাই সপ্তক। এই ছোট্ট কথাটা তুমি বুঝতে পারছ না?
- তা হয় না রিচা। তোমায় আমার পছন্দ নয়।
- পছন্দ নয়! তুমি জান আমার পিছনে কত ছেলেরা পড়ে আছে?
- প্লিজ রিচা। তুমি তাদের সাথে মিশতে পারো। আমায় ডিস্টার্ব কোরো না। আমি শুধু শুধু তোমার সাথে বকে টাইময়েস্ট করতে পারবো না। এই নোটস গুলো আমায় আজ লিখে নিতেই হবে। নাহলে হয়তো কাল এই বইটা আর খুঁজে পাব না।
রিচা ছো মেরে বই টা তুলে নেয়। বই টা দেখে বলে,
- ওহ! এই বইটা? তোমায় এখুনি কিনে দিচ্ছি চলো।
সপ্তক রেগে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো, আমি গরিব হতে পারি রিচা, তবে আমরও একটা সন্মান আছে। যার তার থেকে অনুগ্রহ নিতে আমি অভ্যস্ত নই। নিজের প্রাপ্য জিনিস আমি নিজেই অর্জন করতে জানি।
সপ্তক বই টা রেখে দিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেল।
রিচা হা করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
Sonman part - 2 Bengali story| Bangla golpo| বাংলা
সন্ধেয় বেলা মৃনাল বাবু বাড়ি ফিরলেন। জুঁই তখন রান্নাঘরে তেলেভাজা ভাজতে ব্যস্ত। অনিক, সপ্তক , অহনা কাড়াকাড়ি করে তেলে ভাজা খাচ্ছে। ঘর ময় ছেলে মেয়ে গুলোর খুনসুটি দেখে মৃনাল বাবুর চোখ দুটি জড়িয়ে গেল। ঘরে ঢুকে জামা ছাড়তে ছাড়তে বললেন, জুঁই মা, এক গ্লাস জল দে তো মা...
বাবার গলা পেয়ে জুঁই তড়িঘড়ি গ্যাস অফ করে জল নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালো।
এক নিঃশ্বাসে অনেক খানি জল খেয়ে বললেন আহ! প্রাণ টা জুড়োলো।
আচ্ছা, জুঁই অনিক কোথায় রে... ওকে একটু ডাকতো। ওর সাথে আমার একটু কথা আছে।
- আমি এখুনি ডাকছি বাবা।
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ