চপ ওয়ালা ( বাংলা গল্প)

Chop oyala ( Bengali heart touching story)


 পরেশ দিন রাত পরিশ্রম করে রোজগার করে। ওর একটি রিক্সা আছে। পরেশ রিক্সা চালিয়েই সংসার চালাচ্ছে ত্রিশ বছর ধরে। আজকাল রিক্সা কেউ চড়তে চায় না। রাস্তা- ঘাটে যা অটো , টোটো র দৌরাত্ম তাতে পরেশ এর মত রিক্সা ওয়ালাদের খুব একটা সুবিধা হয় না। কিন্তু পরেশ এরই বা কি করার আছে! একটা নতুন তো দূরের কথা পুরোনো সেকেন্ড হ্যান্ড টোটো কেনারও ক্ষমতা পরেশ এর নেই। কারণ দিন শেষে ও যা টাকা রোজগার করে পুরোটাই ওর সংসার চালানোর কাজে লেগে যায়। পরেশ এর সংসার এ ওর ছেলে রিজু ছাড়া আর কেউ নেই। ঋজুর পড়াশোনার জন্যই পরেশ এর সংসারে এত খরচ। কিন্তু তা নিয়ে পরেশ মোটেও চিন্তিত নয়। ও জানে একদিন না একদিন সুদিন ঠিক আসবেই। পরেশ সৎ ভাবেই পয়সা রোজগার করে।  ও কোনো নেশা ভাঙ করে না। তবে মনের মধ্যে কখনো সখনো অবসাদ আসলে ও সামনেই একটি আশ্রম আছে সেখানে একটু সময় কাটিয়ে আসে। মানুষ মাত্রই অবসাদ আছে, কষ্ট আছে, হতাশা আছে, পাওয়া- না পাওয়ার বেদনা আছে। কিন্তু এইসব নেগেটিভ দিক গুলোকে পুষে রাখলে তো আর সামনের দিকে এগুনো যাবে না.....এগিয়ে চলতে হবে প্রতিনিয়ত। তেমনই পরেশ এর জীবনে একটি দিক হতাশায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তা নিয়ে পরেশ সকলের কাছেদুঃখ প্রকাশ করে না। বরং নিজে নিজের কাজ নিয়ে থাকতে পছন্দ করে।


(Bangla golpo/ Bengali short story  বাংলা গল্প)



আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে, সবজি ওয়ালী চাঁদনী কে পরেশ বিয়ে করে ঘরে তোলে। পরেশ এর মা, বাবা থাকতেন বিহারে। সেখানেও ছিল অভাব , অনটন। পাঁচ ভাই - বোনকে নিয়ে পরেশ এর বাবার অনেক বড় সংসার। সামান্য কয়েক কাটা জমি ছিল ওদের সম্বল। কিন্তু মাঠে খেটেও ওর বাবা পাঁচ ভাইকে ভালো মতো খাওয়াতে পারতো না। পরেশ ই ছিল বড়। পরেশ একটু বড় হতেই কলকাতায় চলে আসে রুজি রোজগারের জন্য। কিন্তু কলকাতা শহরে টিকে থাকা খুব শক্ত। সেই ছোটবেলা থেকেই পরেশ কলকাতার রাস্তায় রিকশা চালায়। প্রথম দিকে ভাড়া করা রিক্সা চালাত পরেশ। তারপর নিজে একটি রিক্সা কিনলো। তখন রিক্সার চল ছিল ভালোই। এখানেই একটি কলোনিতে ভাড়া থাকতে শুরু করলো। এই ভাবেই বিহার থেকে আসা পরেশ কলকাতা শহরটিকে আপন করে নিল। ও যে কলোনিতে ভাড়া থাকতো তার পাশের কলোনিতেই থাকতো চাঁদনী। চাঁদনী পেশায় সবজি ওয়ালী। ওর মা, বাবা নেই। আরো দুই - তিনটি সবজি ওয়ালির সাথে একসাথে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো ও। আসতে আসতে পরেশ এর সাথে চাঁদনীর আলাপ হয়। পাশাপাশি থাকার সুবাদে দুজনই দুজনকে খুব সাহায্য করত। আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ তা বেড়ে উঠলো। বিনা বাধাতেই মন্দিরে গিয়ে পরেশ ও চাঁদনীর বিয়েটা হলো। পরেশ অনেক গুলো বছর পর বউ নিয়ে গিয়েছিল বিহারে। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা, মা, ভাই দের দেখলো তার প্রতি কোনো ভালোবাসাই নেই। যেন তাদের হটাৎ আগমনে তারা বিব্রত বোধ করছেন। পরেশ বুঝতে পেরেছিল সবই। পরদিন ই আবার বউ নিয়ে চলে এসেছিলকলকাতায়। বছর দশেক ওদের সংসার ভালোই চলছিল। পরেশ রিক্সা চালাত। আর চাঁদনী সবজি বিক্রি করতো। পরেশ বিয়ের পর চাঁদনীকে সবজি বিক্রি করতে বারণ করেছিল। কিন্তু ও কোনো কথা শুনতে চায় নি। পরেশ তারপর আর বিশেষ কোনো বাধা দেয় নি। বিয়ের  বছর দুয়েক পর চাঁদনীরকোল আলো করে এলো রিজু। এবার চাঁদনী আর সবজি বিক্রি করতে বেরোতে পারলো না। ফলে সংসারে রোজগার কমতে থাকলো। শুরু হলো নিত্য অশান্তি। 

এরপরের কাহিনী ই পরেশ এর জীবনটা অন্যরকম করে তোলে। চাঁদনী একরত্তি রিজু কে রেখেই অন্যকারো হাত ধরে চলে যায় সুখে শান্তিতে থাকার জন্য । এটাই ছিল পরেশ এর জীবনের একটি মর্মাহত ঘটনা। পরেশ জানত চাঁদনী কার সাথে পালিয়েছে। কিন্তু পরেশ আর তাকে ফিরিয়ে আনতে যায় নি। যার মনে নিজের নাড়ি চেরা ধন ছেলেটার জন্য কোনো ভালোবাসা নেই। তাকে ফেলে নিজে ভালো থাকার জন্য অন্যকারো হাত ধরে চলে গেল। তার পরেশ এর প্রতি ভালোবাসা থাকবে কি করে। এবার পরেশ এর আরো কঠোর দিন শুরু হলো। একহাতে রিজু কে সামলানো অন্যদিকে রিক্সা চালানো। এইভাবেই কষ্ট করে পরেশ ঋজুকে মানুষ করতে থাকলো। আসতে আসতে রিজু বড় হলো। স্কুলে ভর্তি হলো। পরেশ পড়া- লেখা না জানলেও ঋজুকে পড়া লেখায় খুব আগ্রহ দেখাত। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে যা হোক দুটো কিছু রান্না করে সংসারের কাজ সামলে পরেশ বেরিয়ে পড়তো রিকশা নিয়ে। 


(Bangla golpo/ Bengali short story  বাংলা গল্প)


রিজু একটু বড় হতে বাবার এত কষ্ট সব বুঝে ও কিছু একটা করতে চাইল। রিজু তখন ক্লাস নাইন। স্কুল থেকে ফিরে রাস্তায় রাস্তায় পেন বিক্রি করতে বেরোত। প্রথম কয়েক সপ্তাহ রিজু কয়েক টাকা লাভ ও করলো। কিন্তু ও এইসব কিছুই ওর বাবাকে লুকিয়ে করতে চাইছিল। ওদের সংসারে যাতে একটু সুসার হয়, ওর বাবার একটু কষ্ট কম হয় তাই চেষ্টাই ও করছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ ই পরেশ এর চোখে পড়ে যায় রিজু রাস্তায় পেন বিক্রি করছিল। বাড়ি ফিরলে পরেশ ওকে খুব বকাঝকা করে। এখন তোর পড়াশোনার বয়স। এই বয়সে পেন বিক্রি করতে যেতে তোকে কে বলেছে। রিজু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, তোমায় এত খাটতে হয় আমার দেখে খুব কষ্ট হয়। তাই ভাবছিলাম, যদি এইভাবে তোমার পাশে একটু দাঁড়াতে পারি। " 

আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তোর সারাটা জীবন পরে আছে। এখন তোর মন দিয়ে পড়াশোনা করার সময়। পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে যখন দাঁড়াবি, তখন আমার সমস্ত দুঃখ লাঘব হয়ে যাবে। আর হ্যা, রিজু একটা কথা তুই ভালো করে মনে রাখিস কোনো কাজই ছোট নয়। নিষ্ঠার সাথে যে কোন কাজ সৎ ভাবে করলেই তুই মানুষ এর মত মানুষ হয়ে উঠবি।


(Bangla golpo/ Bengali short story  বাংলা গল্প)



তারপর থেকে রিজু পুরোপুরি পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। কিন্তু পরেশ আগে রান্না বান্না করে কাজে বেরোত। এখন রিজু  বড়  হয়েছে ও নিজেই রান্না করে। আর ওর রান্নার হাত ও খুব ভালো। দেখতে দেখতে রিজু অনেক বড় হয়ে গেল। এম. এ পাশ করে গেল। এবার বাবার পাশে দাঁড়ানো টা খুবই জরুরি। এত দিন ঋজুকে পড়াশোনার জন্য ওর বাবা অনেক টাকা খরচ করেছে। এবার তাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু রিজু অনেক  গুলো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ফরম ফিলাপ করেও পাশ করতে পারলো না। তাছাড়া এক একটা ফরম এর দাম ও অনেক। ওতো ওতো টাকা রিজু দের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে- মেয়ে দের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই রিজু সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে অন্যকিছু করবার কথা ভাবে। কলোনিতে তৈরি করে একটি কোচিং সেন্টার। ও কলোনির  ছোট বড় অনেক বাচ্চাদের পড়াতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেক স্টুডেন্ট হয় ওর। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাস গেলে কেউই মাইনে দেয় না। রিজু দেখে কলোনির বাচ্চা দের সকলের মা- বাবাই দিন মজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন অবস্থা। ওরা কি করেই বা পড়াশোনার খরচ যোগাবে। এইদিকে পরেশ এরও বয়স বাড়ছিল। আর রিজু   এরও চিন্তা বাড়ছিল। একদিন  রিজু রাতে শুয়েছিল।কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তখন ওর বাবার একটি কথা মনে পড়লো। কোন কাজই ছোট না। নিষ্ঠা আর সৎ ভাবে কাজ করলে যে কোন কাজই বড় হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রিজু দেখলো ও তো রান্নাটা ভালোই পারে। চপ, তেলেভাজা,  সিঙ্গারা, এইসব ভালোই করতে পারে। সাথে এগরোল, চাউমিন ও।


প্রথম প্রথম রিজু বাঁশ এর ঠেকনা দিয়ে টিরপল খাটিয়ে চপ, সিংগারা ভাজতে শুরু করলো। এগরোল, চাউমিন ও। বেশ কয়েকদিনের মধ্যেয়েই ওর অনেক উন্নতি হতে শুরু করলো। ব্যবসা টাকে আরো একটু বড় করে তোলার জন্য এবার ও একটি দোকান ভাড়া নিল। ভিড় আরো বাড়তে থাকল। ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছে দেখে রিজু তার বাবাকে আর রিক্সা চালাতে দিল না। পরেশ এখন ঋজুর দোকান এই থাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দেয়। কিন্তু এতেও রিজু আর পরেশ মিলে খদ্দের সামাল দিতে পারছিল না। রিজু তেলেভাজা ভেজে সামাল দিতে পারছিল না। এবার রিজু তার দোকানে আরো তিন জন কর্মচারী রাখলো। ধীরে ধীরে রিজু আরো উন্নতি করতে শুরু করলো। 


(Bangla golpo/ Bengali short story  বাংলা গল্প)




এবার রিজু নিজে একটি বড় দোকান খুলল।  পরেশ এর এবার বিশ্রাম এর দরকার। রিজু আর ওকে কোনো কাজ করতে দেয় না। রিজু র এখন অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। ও এখন সকাল এর দিকে কলোনির বাচ্চাদের ফ্রি তেই পড়ায়। রিজু মাস গেলে তার অর্জিত সব টাকা ওর বাবাকে দিয়ে দেয়। পরেশ বলে ধুস, এইসব আমি নিয়ে কি করবো, তুই বাড়িতে একটা বউ নিয়ে আয় সেই এইসব সামলাবে। রিজু লজ্জা পায়। বলে বাবা তুমি ঠিকই বলেছিলে। নিষ্ঠা দিয়ে কোনো কাজ করলে যে কোন কাজেই সফল হওয়া যায়। সে যেমনই কাজ হোক না কেন।


সমাপ্ত

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ